আমার যদি আলাদিনের চেরাগ থাকতো, তাহলে দৈত‍্যকে ডেকে এনে বসাতাম। হুকুম দিতাম—আমার দেশের ইউনিভার্সিটিতে যেসব ছেলে-মেয়েগুলো দলকানা রাজনীতি করে, তাদেরকে দুনিয়ার ভালো কিছু ইউনিভার্সিটি ক‍্যাম্পাসে ঘুরিয়ে নেয়ার বন্দোবস্ত করো।

হুকুম মতো দৈত‍্য সে ব‍্যবস্থা করতো। ছেলে-মেয়েগুলো গিয়ে দেখতো, তাদের বয়সী তরুণরা কী করে জগৎ পাল্টে দেয়া চিন্তা করছে। তারা গিয়ে দেখতো, তেইশ-চব্বিশের ছেলে-মেয়েরা পিএইচডি করছে। দেখতো, কুড়ি-বাইশের তরুণরা কী করে আত্মমর্যাদা ও আত্মনির্ভরশীলতা নিয়ে বেঁচে আছে।

দেখতো, কী করে তাদের বয়সী তরুণরা নোংরামি না করে স্বপ্ন জয়ের নেশায় দিন-রাত ছুটছে।

এইগুলো দেখে, সেই তরুণদের ভিতর আত্মপোলব্ধি হতো। তারা অনুতপ্ত হতো। যুগপৎ উজ্জীবিত হতো। আমি নিশ্চিত, দেশে ফিরে গিয়ে, তাদের নব্বইভাগ এই পশ্চাৎদেশলেহী রাজনীতি ছেড়ে নিজের স্বপ্নকে জাগ্রত করার জন‍্য সংগ্রাম করতো। কিন্তু হায়, আমার সে চেরাগ নেই! আমার সে সামর্থ‍্য নেই!

আমি তাই সামান‍্য লিখে, তাদের সামনে দুনিয়ার সুন্দরতম সত‍্য চিত্রটি তুলে ধরার চেষ্টা করি। দুনিয়ার বহু ইউনিভার্সিটির চিত্রগুলোকে শব্দে বয়ান করি। তারপরও যখন দেখি, একটি সম্ভাবনাময়ী তরুণ, নেতার লেজ ধরে বসে আসে, নেতার পূজা করে ক্ষুদ্র জগৎ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকছে—তখন আমার খুব কষ্ট হয়। সে তার জীবন থেকে কতো কী হারাচ্ছে—সে ভেবে দুঃখ বোধ করি। বিচলিত হই!

আমার দেশের বিশ্ববিদ‍্যালয়ে যে রাজনীতি, সেটার সহজ বাংলা হলো গুণ্ডামি আর পাণ্ডামি। সে রাজনীতিতে মিথ‍্যে গল্প, মিথ‍্যে বুলি আর মিথ‍্যে আবেগ ছাড়া কিছু নেই। মিথ‍্যে দেশপ্রেম ছাড়া কিছু নেই। ধস্তা-ধস্তি, মারামারি, মাস্তানি ছাড়া কদাচিৎ ভালো কিছু হয়।

একটা যুবক, যে নিরন্তর তার স্বপ্ন দেখবে, যে ন‍্যায়-নীতির সাথে আত্মনির্ভরশীল হবে, দেশের ক্ষতি করবে না, পরিবারের জন‍্য বোঝা না হয়ে অবলম্বন হবে—সেই কী দেশপ্রেমিক নয়? সেই কী দেশের কারিগর নয়? আর যে সত‍্যিকারের রাজনীতি করবে, সে তো নেতার দাস না হয়ে, রাজ‍্যের দাস হবে।

নিজের শাণিত মেধা ও দর্শনের দাস হয়ে, সমাজকে আলোকিত করবে।

আমাদের ছাত্ররাজনীতি ছেলে-মেয়েদের কী শেখায়? —নেতার মুখের বুলি শেখায়। —নেতার সামনে সত‍্যকে লুকাতে শেখায়। —নেতার পদলেহন করে পদলোভী হতে শেখায়। —নেতার সামান‍্য দয়া-দাক্ষিণ‍্য নিয়ে একটা চাকুরি পেতে শেখায়। —গাড়ি ভাঙ্গতে শেখায়।

—চাঁদাবাজ হতে শেখায়। —নেতার খুদ খুঁটে খুঁটে খেয়ে পাতিনেতা হতে শেখায়। —নেতার পেশীর বলে পুতুলনাচ দিতে শেখায়। যে দেশের বিশ্ববিদ‍্যালয়ের যুবকরা এমন হীনকর কাজে ব‍্যস্ত থাকে, সে দেশ হলো দুর্ভাগা জননী। যে দেশের বিশ্ববিদ‍্যালয়ের তরুণরা এমন মেরুদণ্ডহীন পোষ‍্য তোতাপাখি হয়ে যায়, সে দেশ বড়ো অভাগিনী!

আমি জানি, আমাদের দেশ তাঁর তরুণদের ভালো শিক্ষক দিতে পারে না, ভালো আবাস দিতে পারে না, ভালো পাঠ দিতে পারে না, ভালো উপলব্ধিটুকুও তাই জন্মায় না। কিন্তু এটা যে একুশ শতক! তাদের কী নিজেদের উপলব্ধি জন্মায় না?

তারা কী জানে না, তাদের দিকে তাকিয়ে আছে তাদের বাবা। মমতাময়ী মা। স্নেহের ভাই-বোন। তাদের সাফল‍্যের দিকে তাকিয়ে আছে পরিবার। অন্তরে বাহিরে দাসত্ব গ্রহণ করে রাজা হওয়ার চেয়ে, মুক্ত স্বাধীন চিন্তা-চেতনার ক্ষুদ্রতম ফড়িং হয়ে বেঁচে থাকা উত্তম—এই বোধটুকু কী তাদের জাগে না?

আহা, আমার যদি আলাদিনের চেরাগ থাকতো, আমি তাদেরকে পৃথিবীর সুন্দরতম বিদ‍্যাপীঠের আলোকভুবনে এনে তাদের আত্মপোলব্ধির একটা বন্দোবস্ত করতাম! —কিন্তু এই অক্ষমতার জন‍্য, আমি অসহায় বোধ করি।

Rauful Alam
নিউজার্সি, যুক্তরাষ্ট্র।