“ইউজিসি কি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কলেজ বানাতে চায়” শিরোনামে গতকালকের প্রথম আলোতে প্রকাশিত ড. মো. ফজলুল করিমের লেখাটি পড়লাম। এই বিষয় নিয়ে আমিও কয়েকদিন আগে লিখেছি। আমারও প্রশ্ন আমাদের শিক্ষামন্ত্রণালয় আর ইউজিসি কি বিশ্ববিদ্যালয়ের সত্যিই উন্নতি চায়?

তাদের কাজ কর্মে কিন্তু তা প্রমাণিত হয় না। হয় তারা বিশ্ববিদ্যালয় কি সেটাই জানে না। সেক্ষেত্রে বলা যায় অজ্ঞতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উন্নত হচ্ছে না। আর যদি বিশ্ববিদ্যালয় সম্মন্ধে সম্যক ধারণা থাকে তথাপি এইরকম নীতিমালা করছে তাহলে বলতেই হবে তাদের এজেন্ডাই হলো শিক্ষার মান ধ্বংস করা।

লেখক ঠিক বলেছে যে “এই অভিন্ন নীতিমালা দেখে মনে হচ্ছে শিক্ষকেরা যাতে কম সময়ের মধ্যে অধ্যাপক না হতে পারেন, সেটির উপর জোর দেওয়া হয়েছে”।

যেখানে সৃষ্টিশীলতা থাকে, যেখানে জ্ঞান সৃষ্টির বিষয় জড়িত সেখানে শিক্ষকতার কত বছরের অভিজ্ঞতার গুরুত্বের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা। যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে গবেষণা এবং ছাত্র কর্তৃক শিক্ষক মূল্যায়ন।

ড. ফজলুল করিম লিখেছেন “জাপানে আমার পিএইচডি সুপারভাইজার খুব দ্রুত অধ্যাপক হয়েছিলেন। তিনি সহকারী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক হয়েছেন। তাঁকে বলা হয়নি তোমার সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে ন্যূনতম কয়েক বছর থাকতে হবে।

তিনি অধ্যাপক হয়েছিলেন ‘নেচার’ নামক বিশ্বখ্যাত জার্নালে পরপর দুটি আর্টিকেল প্রকাশ করার জন্য। তিনি এই কাজগুলো করেছিলেন আমেরিকায় বসে এবং তাঁর দেশ তাঁর কাজের সম্মান দিয়েছে।”

এই নীতিমালায় কোথাও গবেষণাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি। একজন শিক্ষক A-র যদি ৫০টি আর্টিকেল থাকে তম্মধ্যে বেশ কিছু আর্টিকেল যদি “নেচার”, “সাইন্স”, “PNAS”, “ফিজিক্যাল রিভিউ লেটার্স” ইত্যাদির মত জগৎ বিখ্যাত জার্নালে থাকে কিন্তু শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা কেবল ধরুন ৪ বছর। অন্য শিক্ষক B-র আর্টিকেল আছে ১২টি এবং সেগুলোও লোকাল গার্বেজ জার্নালে। কিন্তু তার শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা হলো ১৫ বছর। দ্বিতীয় অধ্যাপক হবেন আর প্রথমজন বড়জোর এসিস্টেন্ট প্রফেসর হবেন। অথচ একটি সভ্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয় হলে উল্টোটা হতো। ব্যতিক্রমী মেধাবীদের জন্য ব্যতিক্রমী নিয়ম না করলে ব্যতিক্রমী শিক্ষক পাবেন কিভাবে?

লেখক একদম ঠিক লিখেছেন যে, “বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কলেজ নয় যে এখানে বিরাট লম্বা সময় শিক্ষক হিসেবে সার্ভিস দেওয়ার ওপর প্রমোশন বা আপগ্রেডেশন নির্ভর করবে। শুধু সময় দ্বারা নির্ধারিত হওয়া প্রমোশন বা আপগ্রেডেশনের জন্য কেউ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হওয়ার জন্য আসে না। এখানে সবাই স্বাধীনভাবে ওপরে উঠতে চায়। নিজস্ব যোগ্যতাবলে ওপরে উঠতে চায়। বাইরের দেশে এই প্রতিভার মূল্যায়ন করা হয়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের প্রয়োজন অনুসারে এবং স্ট্যান্ডার্ড অনুসারে শিক্ষক নিয়োগ প্রমোশন বা আপগ্রেডেশনের ক্রাইটেরিয়া নির্ধারণ করে।”

এই অভিন্ননিতিমালায় আমাদের ব্রেইন ড্রেইনকে ব্রেইন গেইনে রূপান্তরিত করার কোন পরিকল্পনার ছাপ নেই। বরং আছে ইউরোপ আমেরিকায় যারা পিএইচডি বা পোস্ট-ডক করছে তারা যেন ফিরে না আসে। কেউ কদাচিৎ ফিরে আসলেও তাদের এমন মাসুল দিতে হয় যা দেখে এখন আর কেউ আমেরিকায় পিএইচডি করতে গেলে ফিরে আসছে না। পুরো নীতিমালায় পোস্ট-ডক শব্দটির উল্লেখ পর্যন্ত নাই।

অথচ বর্তমান বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা হলো অন্তত একটি পোস্ট-ডক্টরাল অভিজ্ঞতা যার মাধ্যমে একজন পিএইচডি ডিগ্রীধারী প্রমান করবে সে স্বাধীনভাবে গবেষণা করতে পাড়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে কিনা। এটাই হলো যোগ্যতার আল্টিমেট লিটমাস টেস্ট। তার উপর আমরা প্রভাষক নিয়োগে ৩০ বছরের বয়সসীমা নির্ধারণ করে দেই যেখানে অনেক পিএইচডি ডিগ্রীধারীও দরখাস্ত করতে হয় কারণ শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ব্যতীত সহকারী অধ্যাপক পদে দরখাস্তের সুযোগই রাখা হয়নি।

অথচ আমাদের শিক্ষক সমিতি বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশনের এইটা নিয়ে একটি কথাও বলছে না। বলছে না অন্যান্য শিক্ষক নেতারাও যারা সচরাচর রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে অনেক বলে বেড়ান। ধিক জানাই তাদের।

লেখকঃ অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়