সন্ধ্যার পরে বুয়েট থেকে পাঠাও কল করলাম বাসায় আসার জন্য৷ রাইডার আসার পর বললাম যে ভাই, ক্যাম্পাসের ভিতর দিয়ে ৬ নাম্বার গেইট দিয়ে বের হন।

ক্যাম্পাসের ভিতর দিয়ে যাওয়ার কথা শুনে তিনি একটু কেমন বিব্রত হলেন৷ বাইকে উঠার পর আমাকে জিগ্যেস করলেন যে আমি কোন ডিপার্টমেন্টে পড়ি। ক্যাম্পাসের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় আমি তাকে বলছিলাম কোন্ দিক দিয়ে বের হবেন।

সিভিল বিল্ডিং এর উল্টা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি হেসে বললেন, “ভাই, আমি চিনি৷ এইযে এইটা আমার বিল্ডিং ছিল।” প্রথমে বুঝে উঠতে পারি নাই। পরে তিনি বললেন, “আমি অনেক পুরান পাপী ভাই, ২০১০ সালে এখানের সিভিল থেকে পাশ করছি।” ঘটনার আকস্মিকতায় এতটায় চমকায়ে গেছিলাম যে ঘটনাটা ঠিক হজম হইলো না!

এরপর ভাই শুরু করলেন তার কাহিনী। ২০১০ সালে পাশ করেছেন, খুব সম্ভবত ০৩ অথবা ০৪ ব্যাচ। বললেন, “ক্যাম্পাসের ক্যান্টিনটা খুব প্রিয় জায়গা ছিল। এখন কেমন লাগে এখানে?” বললাম যে, টিভিটা নাই, এখন আর আগের মত খেলা টেলা দেখা হয় না ক্যাফেতে।

বর্তমানে কী করছেন তিনি জিগ্যেস করার কৌতূহল সম্বোরণ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল আমার পক্ষে। তবুও ভাই নিজে থেকে বলবেন বলেই কিছু আর জিগ্যেস করি নাই। বললেন, “লজ্জায় কাউকে বুয়েটিয়ান পরিচয় দিই না, গত ১.৫-২ বছর ধরে বেকার। অথচ পাশ করার ১৭ দিনের মাথায় চাকরিতে ঢুকেছিলাম।”

নাভানা কোম্পানির কোনো একটা কনস্ট্রাকশনে ছিলেন। সেখানেই চাকরি করেছেন ৮ বছর প্রায়। কোভিড সিচুয়েশনের আগে থেকেই স্যালারি নিয়ে ঝামেলা করছিল।

সুইচ করার কথা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ কোভিডের থাবা এসে হাজির, তিনি কোম্পানি ছাড়ার আগেই কোম্পানি তাকে ছাঁটাই করে দিলো লাস্ট প্রায় ১ বছরের বেতন না দিয়েই। সেই বেতন পাওয়ার জন্য অনেক লড়েছেন, কিন্তু পাননি।

সেই থেকে আর কোনো চাকরি পাননি। অবাক হলাম খুব, দেশের সবচেয়ে স্বনামধন্য ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটি থেকে পাশ করে এত বছরের এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে চাকরি পাচ্ছেন না, ব্যাপারটা হজম হচ্ছিল না।

জিগ্যেস করতেই বললেন- ” এই দেশে চাকরি যে কী, সেটা চাকরির বাজারে ঢুকলেই বুঝতে পারবেন ভাই। অফার যে পাই নি, তা না। কিন্তু যে স্যালারি অফার করে, তাতে ফ্যামিলি নিয়ে এই শহরে থাকা যায় না। এই দেড় বছর বাইক চালায়েই যাচ্ছি।

ভালো লাগে না ভাই, কালকে সারাদিন চালায়ে রাত ১ টায় বাসায় গেছি, পিঠের ব্যথায় উঠতে পারি না আর।” আমি থ হয়ে পিছনে বসে উনার কথা শুনছি।

অবস্থা খারাপ হওয়ার পর কোনো বন্ধু বান্ধবও তেমন একটা খোঁজ খবর নেয় নাই। তবে ভাই হাল ছাড়েন নাই, চেষ্টা করতেছেন বাইরে যাওয়ার, দুবাইয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করতেছেন। সরকারি চাকরির এপ্লাইয়ের বয়সটাও শেষ। বুয়েটের এই ক্লাস পিছানোর বেশ সমালোচনা করলেন।

ক্যাম্পাস জীবনটা বেশ মিস করেন, বোঝা যায়। শেষের দিকে বললেন, “আপনি বুয়েটের বলে এতগুলা কথা বলে ফেললাম ভাই। কত মানুষ বাইকে উঠে, একসময় বুয়েটের ছাত্র বলে যে সম্মান পেতাম, কেউ এখন ছিঁটেফোঁটাও দেয় না।” বাইক থেকে নেমে দুইজনে একটা হাসি বিনিময় করে দুইদিকে চলে গেলাম। মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল!

এইযে বুয়েটের মানুষজন বিসিএসে চলে যাচ্ছে বলে হায় হায় করা মানুষজন জানেও না যে, এইদেশে ইঞ্জিনিয়ারদের কীভাবে ট্রিট করে। এই মেধাবী ইঞ্জিনিয়ারগুলো কেনোই বা এই দেশে থাকবে বলতে পারেন?

দেশীয় প্রাইভেট কোম্পানিগুলা কীভাবে এমপ্লয়িদের শোষণ করে, তার গল্পটা কানে আসে। আজ আমার থেকে প্রায় ১৪ বছরের সিনিয়র এক ভাই এর জীবন সংগ্রাম অনেক না জানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেল। কী অমানুষিক একটা পড়াশোনার মধ্যে দিয়ে ৪-৫ বছর কাটায়ে বের হওয়ার পরেও এইসব স্ট্রাগলের গল্প! কেউ জানে না, শোনে না!

বিদ্রঃ একটা ফ্রী উপদেশ দিই। জীবনে কম বন্ধু রাখুন, কিন্তু বন্ধুর মত বন্ধু রাখুন।

From Facebook Status of Avijit Saha