করোনা ভাইরাস সমাচার ( আদি থেকে অন্ত )

করোনা ভাইরাস পরিচিতি :
“করোনা” শব্দটার আক্ষরিক অর্থ হলো মুকুট। গঠনগতভাবে করোনা ভাইরাস একটা বিশাল আরএনএ (RNA) ভাইরাসের পরিবার। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের তলায় এই পরিবারের ভাইরাসকে অনেকটা রাজার মাথার মুকুটের মতন দেখায়, সেই থেকে এই নামকরণ )। অন্যসকল ভাইরাসের মতো এরাও জীবনধারণ ও বংশবৃদ্ধির জন্য কোন না কোন একটা প্রাণী বা উদ্ভিদ কোষের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে।এই ভাইরাসের সবচেয়ে বাইরের অংশে থাকে গ্লাইকোপ্রোটিনের স্পাইক বা কাঁটা যেগুলোর সাহায্যে ভাইরাসটা জীবন্ত কোষে আটকে গিয়ে সংক্রামিত হয়।

কোভিড -১৯ ( COVID -19) কি?

নতুন আবিষ্কৃত বা নভেল করোনা ভাইরাসের সংস্পর্শে মানুষের দেহে যে ছোঁয়াচে রোগ সৃষ্টি হয়, সেই রোগের নাম কোভিড-১৯ (COVID-19) বা করোনা ভাইরাস ডিসিজ (coronavirus disease)। ২০১৯-এর ডিসেম্বর মাসে চীনদেশের ইউহান প্রদেশে সর্বপ্রথম এই রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। ভাইরাস সংক্রমণ সব বয়েসের মানুষের মধ্যে হলেও যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং যারা বয়স্ক, তাদের এই রোগে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি [১]।

বহুরূপী করোনা ভাইরাস :

করোনা ভাইরাসের গঠন কি অপরিবর্তনশীল না পরিবর্তনশীল?এই প্রশ্নটা জরুরি কারণ ভাইরাস-কে একটা অপরিবর্তনশীল বস্তু বলে ভাবলে চলবে না। যেকোনো আর.এন.এ (RNA) ভাইরাসের মতো এটি খুব সহজেই তার গঠন বদলাতে পারে। অর্থাৎ, ভাইরাস যখন বংশ বিস্তার করে তখন যেমন খুশি নিজেদের জিনের সজ্জা বদলে ফেলতে পারে। এই জিনের পরিবর্তিত সজ্জা নিয়েই ভাইরাস এক মানব দেহ থেকে অন্য মানব দেহে সংক্রামিত হয়।
এখনও পর্যন্ত, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও প্রায় ১০০বার মিউটেশান লক্ষ্য করা গেছে। বার বার মিউটেশানের ফলে ভাইরাস খুব সহজেই নতুন নতুন পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়ে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। কিন্তু এই মিউটেশানের প্রভাবে কোভিড-১৯ যুক্ত রোগীর উপসর্গে কি পরিবর্তন হচ্ছে তা এখনি বলা সম্ভব নয়। তাঁর জন্য প্রচুর নমুনা সংগ্রহ করে ভাইরাসের জিনোম সিকয়েন্সিং করে পরিবর্তন লক্ষ্য করতে হবে [২]।

বহুরূপী করোনা ভাইরাসের আয়ুস্কাল :

কোভিড-১৯ (COVID-19) একটা সংক্রামক রোগ। এটি মানুষ থেকে মানুষে ড্রপলেট ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে ছড়ায়। অর্থাৎ, কোনো আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির সময় যে অতি সূক্ষ্ জলের ফোঁটা বা এরোসল তৈরী হয় তার মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। সেইজন্য এই নভেল করোনা ভাইরাস কোনো জিনিসের পৃষ্ঠতলে ঠিক কতক্ষণ বাঁচতে পারে সেইটা জানা অত্যন্ত প্রয়োজন। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেল্থ-এর একদল বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, এই ভাইরাসটা এরোসলে অর্থাৎ বাতাসে সূক্ষ্ম ড্রপলেট অবস্থায় প্রায় ৩ ঘন্টা পর্যন্ত বাঁচতে পারে। কার্ডবোর্ড-এর উপর ভাইরাসটা প্রায় ২৪ ঘন্টা এবং প্লাষ্টিক বা স্টেইনলেস স্টিল এর উপর প্রায় তিন দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে সক্ষম ।

কোভিড -১৯ এর উপসর্গ :

জ্বর, শুকনো কাশি, ক্লান্তি। এছাড়া সর্দিকাশি, শ্বাসকষ্ট, গলাব্যাথা, ডায়েরিয়া-ও হতে পারে।সাধারণ ফ্লু বা সর্দিজ্বরের সঙ্গে এর অনেক মিল পাওয়া যায়। আক্রান্ত হবার পর প্রথম দিকে উপসর্গ খুবই কম থাকে, তারপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কখনও কখনও এর পরিণামে নিউমোনিয়া ও শেষে মাল্টি অরগ্যান ফেইলিওর বা দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে মৃত্যুও ঘটতে পারে (১৪%)। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির কোন উপসর্গই থাকে না বা তারা অসুস্থ বোধ করেন না। প্রায় ৮০% আক্রান্ত মানুষই সেরকম কোন চিকিৎসা ছাড়াই সেরে ওঠেন।জ্বর হলে, কাশি বা শ্বাসকষ্ট হলে দ্রুত নিকটস্থ ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। তিনি বিষয়টা খতিয়ে দেখে প্রয়োজন বুঝলে পরীক্ষা করাতে বলবেন। প্রতি ছ’জন আক্রান্তের মধ্যে, একজনের শ্বাসকষ্টজনিত গুরুতর অবস্থা হতে পারে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, এবং যারা বয়স্ক ( বিশেষত যাদের উচ্চ-রক্তচাপ, হার্টের সমস্যা বা ডায়াবেটিস রয়েছে) তাদের এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে [৩]।

” তাপমাত্রা বাড়লে ভাইরাসের প্রকোপ কমবে বলে শোনা তথ্যটি আদৌ সত্য নাকি নিতান্তই গুজব ? ”

অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ডঃ মেরু শীল জানাচ্ছেন, এরকম কোনো পরিষ্কার সম্ভাবনা এখনো দেখা যায়নি যাতে করে এটা বলা যায় যে পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রা বাড়লে করোনা ভাইরাসের বাড়বাড়ন্ত কমে। বিজ্ঞানীদের হাতে এখনও এব্যাপারে যথেষ্ট তথ্য নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা বা WHO-এর মতেও এই ভাইরাস উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু যুক্ত অঞ্চলেও ছড়াতে পারে [৪]।

কোভিড -১৯ ছড়ানোর ধাপ :

কোভিড -১৯ মূলত ৪ টি পর্যায়ে ছড়াচ্ছে বর্তমান সময়ে –
পর্যায় ১. বিদেশ থেকে আগত রোগীর মাধ্যমে (Imported Cases) – যে সমস্ত দেশে আগেই সংক্রমণ ঘটেছে সেই অঞ্চল থেকে কেউ সংক্রমণের শিকার হয়ে নিজের দেশে ফিরলে, তাকে প্রথম পর্যায়ের সংক্রমণ বলা হয়।
পর্যায় ২. আঞ্চলিক সংক্রমণ (Local Transmission) – বিদেশ থেকে আগত রোগীর সান্নিধ্যে এসে কেউ নিজে সংক্রামিত হলে তাকে দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ বলা হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, একজন আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে অন্য সুস্থ মানুষের সংক্রমণের সম্ভাবনা যথাসম্ভব কমিয়ে আনা, যাতে সংক্রমণের শৃঙ্খলটাকে (transmission chain) কেটে দেওয়া যায়। ভারতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এখন এই পর্যায়ে আছে এবং সকলে সামাজিক দূরত্ব (social distance) বজায় রাখলে তবেই সংক্রমণ এই পর্যায়ে রোখা যাবে।
পর্যায় ৩. পারস্পরিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সংক্রমণ (Community Transmission) – বিদেশ থেকে আগত রোগীর বা যেকোন করোনা আক্রান্ত রোগীর সান্নিধ্যে না এসেও কেউ যখন সংক্রামিত হয় তখন তাকে তৃতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ বলা হয়। এই পর্যায়ের সংক্রমণ অনেক দ্রুত, অনেক বড় এলাকা জুড়ে হয়।
পর্যায় ৪. মহামারী (Epidemic) – এটা শেষ এবং সবথেকে খারাপ পর্যায় যখন সংক্রমণ অত্যন্ত দ্রুত মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এই পর্যায়ের সংক্রমণ একবার হয়ে গেলে কবে, কিভাবে আটকানো যাবে, তা বলা অসম্ভব।

” কোভিড -১৯ এর প্রতিষেধক আর কত দূর ? ”

ইতিমধ্যে এই প্রানঘাতি করোনা ভাইরাসের প্রতিষেদক নিয়ে আশানুরূপ কাজ হচ্ছে৷ প্রানঘাতি করোনা ভাইরাসের প্রথম পরীক্ষামূলক মানবদেহে অলরেডি প্রয়োগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সিয়াটলে অবস্থিত জাতীয় ইনস্টিটিউট অফ হেলথে প্রাথমিক অবস্থায় একজন মানুষের দেহে এ পরীক্ষা চালিয়েছেন চিকিৎসকরা৷ পর্যায়ক্রমে আরো ৪৫ জন শারীরিক ভাবে সুস্থ মানুষের উপর এই প্রয়োগ করবে চিকিৎসকরা। [৫ ]
চীন, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় অ্যান্টিবডি দিয়ে ওষুধ তৈরির গবেষণা চলছে । করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর যারা বেঁচে ফিরেছেন, তাদের রক্ত থেকে অ্যান্টিবডি নিয়ে ওষুধ তৈরির চেষ্টা চলছে৷ এমন ওষুধ দিয়ে আক্রান্ত রোগীদের কয়েক সপ্তাহ চিকিৎসা দেয়া যেতে পারে৷সারা বিশ্বে এখন পর্যন্ত প্রায় ৮৬ হাজার করোনা-আক্রান্ত মানুষ সুস্থ হয়ে উঠেছেন৷ এদের শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অ্যান্টিবডি তৈরি করেছে, যা পরবর্তীতে শরীরকে আবারও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করবে৷ সুস্থ হয়ে ফেরা এই ব্যক্তিদের অ্যান্টিবডি আক্রান্ত রোগীর শরীরে ঢোকালে ঐ শরীরে ‘প্যাসিভ ইমিউনিটি’ গড়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা । [ ৬]
নেদারল্যান্ডের ইরাসমাস মেডিকেল সেন্টার (Erasmus Medical Center)-এর বিশেষজ্ঞরা করোনা ভাইরাসের চিকিৎসায় বিশেষ একটি এন্টিবায়োটিক তৈরি করেছে। [৭ ]
তাই প্রকৃতপক্ষে আশা রাখা যায় যে এই ঘাতক করোনা ভাইরাসের সফল প্রতিষেধক হয়তো আবিস্কার সম্ভব৷ কিন্তু তার জন্য কি পরিমান সময় আবশ্যক তা বলা অত্যন্তই কঠিন। তা পরবর্তীতে আরো মানুষের উপর পরীক্ষামূলক প্রয়োগে কি পরিমান সফলতা আসছে তার উপর নির্ভর করবে৷

তথ্যসূত্র :
১। www.who.int/emergencies/diseases/novel-coronavirus-2019/technical-guidance/naming-the-coronavirus-disease-(covid-2019)-and-the-virus-that-causes-it
২। www.abc.net.au/news/science/2020-03-17/how-viruses-work-explainer/12059904
৩ । www.who.int/news-room/q-a-detail/q-a-coronaviruses
৪। www.theguardian.com/world/2020/mar/17/what-effect-will-winter-have-on-coronavirus-in-australia
৫। www.somoynews.tv/pages/details/203061/করোনা-ভাইরাসের-প্রতিষেধক-প্রয়োগ-আজ
৬। www.dw.com/bn/করোনা-সম্পর্কে-জ্ঞান-ছাড়াই-টিকা-বা-ওষুধ-কতটা-কার্যকর-হবে/a-53016771
৭৷ www.ekushey-tv.com/করোনা-ভাইরাস-নিয়ে-সুখবর/94830

– মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়