বিদেশিরা কি জাপানে বাড়িঘর কিনতে পারে?
জ্বি, পারে। তবে বাড়ির জন্য লোন নিতে গেলে কমপক্ষে স্থায়ী বাসিন্দা হতে হয়।
-লোন? সুদ লাগেনা?
সুদ ছাড়া লোন হয় কি মহীতে? আছে এমন কোন ব্যাঙ্ক?
-বাড়িঘরের জন্য লোন নিলে সুদ কত পারসেন্ট?
-মাত্র 1%। নাহ আসলে তার ও নীচে। 0.5%, 0.7% এমন।
আপনি মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে চাকুরী নিয়েছেন। বিয়ে করেছেন। বাড়ি খুঁজছেন। হাতে টাকা নেই। আপনার বয়স আর চাকুরী আপনার সম্পদ। ৩৫ বছরের লোন নিয়ে এখন থেকেই নিজ বাড়িতে থাকুন।
জাপানি ডেভেলপাররা আপনাকে একটা সোজা হিসাব দিবে-
আপনি এখন যত টাকা বাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন, সেই টাকা টুকুই মাসে মাসে দিন। ৩৫ বছর পর আপনার লোন দেয়া শেষ। আলাদা কোন অর্থনৈতিক চাপ নিতে হলোনা। ব্যাঙ্ক আমরা পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।
সারা জীবন চাকুরী করে টাকা জমিয়ে বাড়ি কিনলেন, সে বাড়িতে আপনি থাকতে পারলেন না, লাভ কি হল?
১৯৯৫ সাল। আমার এক জাপানি বন্ধু বাড়ি কিনবে। সে বয়সে আমার ১২ বছর বড়। আমাকে নিয়ে গেল। জাপানি বাড়ি কিভাবে কিনতে হয় তা দেখাবে।
সে বলল- রিয়েল এস্টেট এর নাম সেক্সি হাউস। আমি ভাবলাম- হয়তো মার্কেটিং এর জন্য এই নাম দেয়া। এটা একটা মার্কেটিং টার্ম। সেক্সি মানে এট্রাক্টিভ। গিয়ে দেখি Sekisui House. মাঝে মাঝে এরা ভাওয়েল ছাড়া উচ্চারণ করতে পারেনা। আবার কোন সময় ভাওয়েল গুলোকে নাই করে ফেলে।
রিয়েল এস্টেট এজেন্ট সাহেবরা মারাত্মক লেভেল এর জ্ঞান রাখেন। আপনার একটা প্রোফাইল নিবেন। বাড়িতে কতজন এবং কে কে থাকবেন।
পরিবারের সদস্যদের বয়স অনুযায়ী বাড়ির ফাংশন গুলো লিস্ট করবেন। তারপর দেখানো শুরু করেন ম্যানুয়াল। ম্যানুয়াল গুলো কী যে পিক্টোরিয়েল হয়।
ঐ সময় কম্পিউটার দিয়ে আকিবুকি এতো উন্নত ছিল না। হাতে কার্টুন এঁকে ম্যানুয়াল তৈরি করা। ম্যানুয়াল দেখে পছন্দ হলে বলবে অমুক জায়গায় আমাদের এই বাড়ির একটা মডেল রুম আছে। গিয়ে দেখে আসুন।
চোখ টিপি দিয়ে বললেন, যার সাথে বসবাস করবেন তা সিলেক্ট করতে যত সময় নিয়েছেন, যেখানে বসবাস করবেন তা সিলেক্ট করতে সময় নেবেন না, তা তো হয় না। এটা তো আর ছোট খাট শপিং না, ভাল করে চিন্তা করুন। নিজের পছন্দের সাথে খাপ খাচ্ছে কিনা। বউকে নিয়ে যান।
তখন বাড়িঘর তেমন বুঝতাম না। পরে নিজের যখন সামর্থ হল বাড়িঘর কেনার, তখন ঢাকায় ফ্ল্যাট দেখছি। তুলনামূলক চিত্র অটোমেটিক্যালি মাথায় চলে আসলো।
(১) ঢাকার এজেন্টরা কোন ফ্যামিলি প্রোফাইল নেন না। ডাইরেক্ট জিজ্ঞাস করবেন, কত স্কয়ারফুটের বাড়ি চান? দাম হবে স্কয়ারফুট অনুযায়ী। তারপর রুমের সংখ্যা।
জাপানে স্কয়ারফুট একটা ফ্যাক্টর তবে ব্যাখ্যা করবে ফাংশন নিয়ে। বাড়ি মানে শুধু রুমের সাইজ আর লে আউট নয়।
(২) বাড়ির মাইক্রো-লেভেল এর ডিজাইন দেখার দায়িত্ব মহিলাদের। বিশেষ করে কিচেন। অনেক গুলো কম্পোনেন্ট। চুলা কয়টা হবে। সিঙ্কের সাইজ কত। চুলা ডান পাশে না বাম পাশে থাকবে। কালার কি হবে।
ডিশওয়াসার কত বড় চাই। যেখানে দাঁড়িয়ে রান্না করবে তার থেকে ফ্রিজের দূরত্ব কত হবে। হাড়ি-পাতিল রাখার র্যাক চুলার নিচে রাখবে নাকি পাশে রাখবে। কাঁচা ময়লা ফেলার জায়গা কোথায় হবে – কত কি?
জাপানি ডেভেলপররা কিচেনের অনেকাংশ অপশনাল রেখে দেন। বিভিন্ন রকম ডিজাইন দেখান। মহিলারা তাদের পছন্দসই জিনিশ শুরু থেকেই বলে দিতে পারেন।
বাংলাদেশে অধিকাংশ সময়ই কিচেন নিয়ে সমস্যায় পড়েন। ডেভেলপাররা যা বানিয়ে দেন তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করে ও মন থেকে মেনে নেন না। অমুকের বাসায় কিচেনের ডিজাইন দেখে বাসায় এসে ডেভেলপারদের দোষ দেন। স্বামীর ওপর মানসিক চাপ প্রয়োগ করেন – এতো করে বললাম ঐ ফ্ল্যাট টা নিতে। এখন নতুন করে কিচেন ডিজাইন করো। আর্কিটেক্ট ডাকো।
আর্কিটেক্ট সুন্দর ডিজাইন দেখান। ফার্নিচার দেখান। কিছু কিছু আর্কিট্যাক্ট এমন আচরণ করেন উনি কি আর্কিট্যাক্ট নাকি ফার্নিচারের এজেন্ট তা বোঝা যায়না।
বাড়ির গৃহিণীর চাপে কিচেনের ওয়াল ভেঙ্গে নতুন ডিজাইন বসিয়ে দেন। ৯০ লাখ টাকার ফ্ল্যাট, শুধু কিচেন পরিবর্তন করতে আরো ২০ লাখ টাকা ঢালেন। ৩ মাস ধরে চলে কাজ। আজ মিস্ত্রি নেই। কাল হেল্পার নেই। আর্কিট্যাক্ট সাহেবের ডিজাইন মিস্ত্রিদের পছন্দ হয় না।
আর্কিট্যাক্টের অনুপস্থিতিতে তিনি টুকটাক পরিবর্তন করেন। একসময় আর্কিট্যাক্ট এসে ধমকাধমকি করবেন। গৃহিণী অসন্তুষ্ট হন। আবার ১০ লাখ টাকা খরচ করে কিচেন দাঁড় করান। বাজেটের তিনগুন খরচ কি শুধু পদ্মা সেতুতেই হয়?
সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এসে বকাবকি করেন যে দেয়াল ভাঙতে নেই, সেই দেয়ালে হাত দেয়া হয়েছে। ফ্ল্যাট এর ম্যানেজমেন্ট এগুলো কিছুই জানেনা। জানলেও না জানার ভান করে থাকে। তার কিচেনে ও একই অবস্থা।
(৩) জাপানে পুরুষরা দেখেন এনার্জি সিস্টেম।
ডেভেলপাররা দেখান – তাদের সাথে অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররা আছেন। গবেষণা করে বের করেছেন ঘরে যত এনার্জি লাগে তা একটা ইউনিট থেকে আসলে খরচ কত কম হয়। কত গুলো লোগো দেখাবেন।
এনার্জি ব্যাপারটা শুধু পয়সার না। এনার্জি বাঁচালেন মানে পরিবেশ দূষণ থেকে রক্ষা করলেন। এই যে দেখেন আমরা কত পুরস্কার পেয়েছি। বেস্ট ডিজাইন পুরস্কার, বেস্ট পরিবেশ-বান্ধব পরিষ্কার। দেখিয়ে দেবেন – আপনার ঘরে রান্না করতে যে এনার্জি লাগে, বাথরুমে পানি গরম করতে যা এনার্জি লাগে, এয়ার-কন্ডিশন, ফ্যান, বাতি জ্বালাতে যা এনার্জি খরচ হয় সব আসবে – একটা ইউনিট থেকে।
হিসাব করে দেখাবে আপনি যদি সব বিদ্যুৎ থেকে নেন তাহলে খরচ কত। আর যদি চুলার জন্য নিলেন গ্যাস, আর বাকিগুলোর জন্য নিলেন বিদ্যুৎ – তাতে খরচের তফাত কত আসে। তাছাড়া বাড়ির ডিজাইন এমন ভাবে করেন তাতে ঘরে যথেষ্ট বাতাস আর আলোর খেলাধুলা চলে। একচিমটি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য কত গবেষণা।
প্রত্যেকটা কম্পোনেন্ট এর গ্যারান্টি ওয়ারান্টি আছে। ১০ বছর, ২০ বছর, ২৫ বছর, ১০০ বছর।
অধিকাংশ একা বাড়ি গুলোতে কোন না কোন উপায়ে রূপান্তর যোগ্য শক্তির উৎস থাকে। যেমন ধরুন সোলার প্যানেল।
টয়লেটের ট্যাঙ্কের ওপরে থাকে ছোট একটা বেসিন। উচ্চতা এমন যেন টয়লেট শেষে হাত ধোয়া যায়। যেহেতু ওয়াস্লেট ব্যবহার করছেন তাতে হাত তেমন ময়লা হয়না। তবু ও টয়লেট শেষে হাত ধোঁয়া জরুরি। হাত ধোঁয়া পানি গুলো টয়লেট ট্যাঙ্কে জমা হয়। এই এতটুকু পানি সাশ্রয় করার জন্য এই ব্যবস্থা।
(৪) জাপানের বাড়িগুলো বাইরে থেকে দেখতে মোটেই সুন্দর অথবা আকর্ষনীয় (আমার বন্ধুর ভাষায় সেক্সি) না। ইউরোপের বাড়িঘর বাইরে থেকে দেখতে কি সুন্দর দেখায়।
লিভিং রুম
তবে জাপানের মডার্ন বাড়িঘর গুলো ভেতর থেকে বেশ ফাংশনাল। স্পেস-বান্ধব, পরিবেশ-বান্ধব,এনার্জি-বান্ধব, গৃহিণী বান্ধব, বৃদ্ধ-বান্ধব, শিশু-বান্ধব।
একটা একটা ঘটনা ঘটে, একটা করে নতুন ফাংশন যোগ হয়। যেমন ধরেন, ১৯২৩ সালে জাপানে ভুমিকম্প হল – ১ লক্ষ ৪০ হাজার লোক মারা গেল। তখন বাড়িঘর গুলো ছিল কাঠের অবকাঠামোতে তৈরি।
যত মানুষ মারা গেল ভূমিকম্পে তার চেয়ে বেশি মারা গেল আগুনে পুড়ে। ভূমিকম্প থেকে গ্যাস লাইন ফেটে গেল। গ্যাস থেকে আগুন। আগুন থেকে মৃত্যু।
গ্যাস কোম্পানি গুলো গবেষক ডাকলেন, সমাধান দিলেন। বাড়িতে বাড়িতে সেন্সর বসানো হল। ভূমিকম্পে গ্যাস লাইন গুলো অটো স্টপ হয়ে যায়।
১৯৯৫ সালের ভূমিকম্পে মানুষ মারা গেল সাড়ে ছয় হাজারের মত। আগুনে পুড়ে মরার কাহিনি আশ্চর্যরকমের কমে গেল। মানুষ মারা গেল বাড়িগুলোতে আটকা পরে। নতুন বাড়ি আইন তৈরি হল।
পানির ট্যাপের ডিজাইন পরিবর্তন হল- যাতে উপর থেকে জিনিস পড়ে পানির ট্যাপ ওপেন হয়ে না যায়। নতুন ডিজাইনের ইলেকট্রিক সুইচ গুলো এখন আর উপরনীচ করলে অফ-অন হয়না। ডানে বামে করা হল। বাড়িতে বাড়িতে বিদ্যুৎ সংরক্ষণের ব্যবস্থা ও হল।
২০১১ সালের ভূমিকম্পে সারা টোকিও দুল দুল দুলুনিতে বাসা বাড়ি দুলে উঠলো, কিন্তু পড়ে গেল না।
বাসায় আটকে পড়া মানুষ মৃত্যুর সংখ্যা শূন্য।
ভূমিকম্পে কিচেনের ওপরের শেলফ থেকে কাঁচের আসবাবপত্র যেন পড়ে না যায় – তার জন্য শেলফগুলোর দরজায় লাগানো হয়েছে অটো-লক। মেকানিক পদ্ধতির। বিদ্যুত বা ব্যাটারি চালিত নয়।
(৫) বাড়ি গুলো বাচ্চা-বান্ধব, বৃদ্ধ-বান্ধব। বাচ্চারা হাঁটতে গিয়ে ঘরের কোনায় ফার্নিচারের কোনায় আঘাত পায়। এই বাড়িতে কোন কোণা নেই। মোনালিসার হাত পা আর চক্ষু নাকের মত সব গোল গোল। টয়লেটের দরজার প্রস্থ হুইলচেয়ার ঢোকার জন্য সুবিধাজনক করে তৈরি। টয়লেটে, বাথ রুমে ইমার্জেন্সি সুইচ দেয়া। যাতে বৃদ্ধরা পড়ে গেলে সাথে সাথে জানান দিতে পারে।
(৬) এবার এক বাড়ি দেখতে গেলাম। এজেন্ট ভদ্রলোক বাড়ির ডিজাইন দেখালেন। বললেন, করোনাকে মাথায় রেখে বাড়ি ডিজাইন করা হয়েছে।
-মানে কি?
বললেন, করোনা হয়তো থাকবে না। কিন্তু মানুষের অভ্যাস শীঘ্রই পরিবর্তন হবে না। বাড়ি থেকে হোম-অফিস যেন করা যায় এজন্য বাড়িতে ছোট হোম অফিস রুম ডিজাইন করা হয়েছে। ছোট একটা দোতলা বাড়ি। দেড় তলায় বানানো হয়েছে হোম অফিসটি। কাঁচ দিয়ে ঘেরা। নীচ তলায় বাচ্চা খেলাধুলা করলে হোম অফিস থেকে দেখা যাবে।
দেড় তলায় হোম অফিস
উপর থেকে দেখা হোম অফিস
রান্না ঘরের পাশে ও ছোট একটা চেয়ার টেবিল দেয়া। যাতে রান্না করতে করতে ও একটু বই পড়া, কম্পিউটার দেখার কাজ টুকু করতে পারেন।
কিচেনের পাশে পড়াশোনার টেবিল
এজেন্ট সাহেব পুরো বাড়ি ঘুরিয়ে দেখিয়ে জিজ্ঞাস করলেন- আশিরু সান, বাড়ির কোন ফাংশন আপনার সবচেয়ে পছন্দ হল?
আমি বললাম, হোম অফিস। বউ বলল, কিচেনের নিচে হিডেন স্টোর রুম।
লেখকঃ আশির আহমেদ
সহযোগী অধ্যাপক
কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান।