সালেহ হাসান নাকিবঃ

মানুষ ব্র্যান্ডের ভক্ত। জামা, জুতো, সেল ফোন, কম্পিউটার, যাই বলা হোক না কেন। দুনিয়াজুড়ে শিক্ষা নিয়েও ব্র্যান্ডিং-এর কাজটা খুব চলছে। আমাদের দেশেও এটা আছে ষোলআনা। হয়ত তার চেয়েও একটু বেশি। এটা বেশি করে বোঝা যায় ভর্তি পরীক্ষার মৌসুমে। ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রী আর তাদের অভিভাবকদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ পর্যন্ত সুযোগ হয়! ভর্তির মৌসুম দরজায় কড়া নাড়ছে।

একটা কথা বলে রাখি, ব্র্যান্ডিং হচ্ছে ওভাররেইটেড। এর মুল্য নেই তা একেবারেই বলছি না। মুল্য আছে, কিন্তু এই মুল্য হচ্ছে গড়পড়তা। একটু ব্যাখ্যা করি।

বাংলাদেশের নামীদামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্বল ছাত্র ও শিক্ষকের সংখ্যা কম নয়। তবে গড়পড়তা, তুলনামুলক ভাবে অবশ্যই কিছুটা ভালো। হিসাবটা সব সময় গড়পড়তা। এই গড় হিসাব যখন কোন একজন ব্যক্তিকে মূল্যায়নের কাজে স্ট্যান্ডার্ড হিসাবে ব্যবহার করা হয় তখন বড় ভুলের সম্ভাবনা থেকে যায়। গড় ধারণা আর ইন্ডিভিজ্যুয়াল কেইস এক কথা না।

পরিসংখ্যানে কতগুলো টার্মস্‌ আছে। ডিসপার্শন আর স্ট্যান্ডার্ড ডেভিয়েশন। আমার দেশের বড় এবং ছোট সব ধরণের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের মান সম্পর্কে একটি মোটামুটি ধারণা আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামডাক যেমনই হোক না কেন, ছাত্রছাত্রীদের গুণগত মানে বিশেষ পার্থক্য নেই।

কথিত বড় এবং ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা গড়ে একটু এগিয়ে আছে। এরর বার (error bar) বিবেচনায় আনলে এই পার্থক্য আরো ইনসিগনিফিকেন্ট বলে মনে হয়।

প্রায় তেইশ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা। এখনো আমি নিশ্চিত নই, কী করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মান যেমনই হোক না কেন, আমাদের কিছু ছাত্রছাত্রী কিছুটা হলেও এই দেশে পদার্থবিজ্ঞান শিখছে। গড়পড়তা শিক্ষকতার তেমন কোন মানই নেই। ছেলেমেয়েরা স্কুল এবং কলেজে বারোটি বছর মোটামুটি নষ্ট করে, বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য অনুপযুক্ত হয়ে লেখাপড়া শুরু করে।

এদের বেশিরভাগের জীবনযাত্রার মান, আবাসস্থান, ভাষা এবং ভাব প্রকাশে অপারগতা ইত্যাদি বিবেচনা করলে, কেউ কেউ যে কিছু শিখছে সেটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় আর শিক্ষকতার মান কোন বড় ফ্যাক্টর নয়।

আমার মতে এই সমস্ত ছাত্রছাত্রীরা, যারা শিখছে, তারা সবাই এক ধরণের অ্যানোম্যালি (anomaly)। ফ্ল্যাকচুয়েশন। এমন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটু বেশি। এরচেয়ে বেশি আর কিছু না।

কাজেই যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য তোড়জোড় করছে তাদের মনে রাখা উচিৎ, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ মিলল সেটা খুব বড় কথা নয়। তেমন উনিশবিশ হবে না। দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রকৃত পক্ষে পঠনপাঠন এবং গবেষণায় মনোযোগ নেই। সব বিশ্ববিদ্যালয়েই আছেন কিছু anomalous শিক্ষক, কিছু anomalous ছাত্রছাত্রী।

কম আর বেশি। নতুন যারা ভর্তি হবে তাদের উচিৎ এই anomalous-দের খাতায় নাম লেখানোর চেষ্টা করা।

কোথায় ভর্তি হলে, সেটা বড় কথা না। বড় কথা হল যে বিষয়ে পড়তে যাচ্ছ, তা তোমার প্রিয় বিষয় কি না? ক্লাসরুম থেকে খুব একটা কিছু শেখা যাবে না, যদি না প্রবল ইচ্ছা থাকে। Are you ready to walk the extra mile? Are you ready to do the hard yards?

ভালোবাসার বিষয়টি খুঁজে পাওয়া আর তা নিয়ে প্রচুর পরিশ্রমের মানসিকতা, এই দুটো হচ্ছে আসল কথা।

 

লেখকঃ অধ্যাপক, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়