পুরো পৃথিবী যখন করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে, ঠিক তখনি বিজ্ঞানীরা পরিবেশে করোনার আশ্চর্যজনক প্রভাব লক্ষ্য করলেন। পরিবেশের উপর করোনার প্রভাবই বর্তমান আলোচনার মূল একটি অংশ।

বায়ু দূষণ শব্দটির সাথে আমাদের পরিচিতি অনেক। কিন্তু করোনা এ বিষয়টিকে আবার নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে। করোনার কারনে বায়ু দূষণ ব্যাপকহারে কমছে। কারণ,মানুষ এখন বেশিরভাগ সময়ই অফিসে থাকার চেয়ে ঘরেই থাকছে। আমেরিকান মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা প্রথম চীনের হুবেই প্রদেশে বায়ুদূষণের এ আশ্চর্যজনক পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। হুবেই ছিল প্রথম লকড ডাউন অঞ্চল।
করোনার প্রভাবে চীন প্রায় ২৫ ভাগ কার্বন নিঃসরণ কমিয়েছে। মার্শাল বুর্কে, স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক তুলে ধরেন যে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশ চীনে কার্বন নিঃসরণ কমানোর ফলে দেশটিতে প্রায় চার হাজার শিশু এবং পঁচাত্তর হাজার বয়স্ক মানুষের জীবন বাঁচাবে। যা সংখ্যায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মানুষের চেয়ে বিশগুণ বেশি। বিবিসি তাদের একটি প্রতিবেদনে বলেছে যে, রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কমায় গত বছরের চেয়ে এ বছরে প্রায় ৫০ ভাগ কার্বন নিঃসরণ কম হবে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জন্য দায়ী আরেকটি মারাত্মক গ্যাস, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের হারও অনেক কমে গিয়েছে।

মানুষের চলাচলের জন্য অন্যতম আবিষ্কার যানবাহন। এটির কালো ধোঁয়া বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ।কিন্তু রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কমে যাওয়ায় বায়ুদূষণও কমছে। মাদ্রিদ ট্রাফিক পুলিশের পরিচালক জানিয়েছেন
– করোনা ভাইরাস প্রকোপের প্রথম কয়েকদিনে রাস্তায় ব্যাস্ত সময়ে গাড়ির সংখ্যা প্রায় ১৪ ভাগ কমে গেছে। তাছাড়া মেট্রোরেলে চলাচলও নেমে এসেছে ৩৫.৮ ভাগে। বেলজিয়ামের সরকার সে দেশে প্রয়োজন ছাড়া গণপরিবহন এড়িয়ে চলতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। তাই বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস প্রকোপ ঠেকাতে বিভিন্ন দেশের এসব সিদ্ধান্ত বায়ু দূষণ রোধে কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে। ফলাফল স্বরূপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো ভারতের কিছু অঞ্চল থেকে হিমালয় অঞ্চল দেখা যাচ্ছে।

প্লেন চলাচল কমে যাওয়ার কারণেও বায়ু দূষণ কমছে। একটি জরিপ থেকে বলা যায়, ২০২০ সালের প্রথম তিন মাসে গত বছরের ঐ সময়ের চেয়ে প্রায় ৬৭ মিলিয়ন কম যাত্রী প্লেন ব্যবহার করেছে। আইটিএ নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে, বিমান চলাচল কমে যাওয়ার কারনে এখাতে প্রায় ১১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হবে। কারণ হিসেবে দায়ী শুধু করোনা ভাইরাস।

অন্যদিকে পানি দূষণ থেকেও মিলছে মুক্তি। ভেনিস শহরের বর্তমান পানির অবস্থা এমনকি কয়েক মাস আগের অবস্থার চেয়েও বেশি ভালো। যে শহর সবসময় পর্যটকে ভর্তি ছিল, সেটি এখন একদম ফাঁকা। বিভিন্ন স্থানে সামুদ্রিক প্রাণিদের ডাঙ্গায় উঠে আসার কথা প্রায়ই শোনা যায়। এমনকি, কক্সবাজারে গোলাপি রঙের ডলফিন ও দেখা গিয়েছে।

পাশাপাশি করোনা ভাইরাসের পরিবেশগত কিছু খারাপ দিকও লক্ষ্যণীয়। ইউরোপের বিভিন্ন কফি ও চেইন শপগুলো রিসাইক্লিং কাপের বদলে রি সাইক্লিং করা যায় না এমন কাপ দিচ্ছেন। এসব কাপের অতিরিক্ত ব্যবহার পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। ইউরোপের খাদ্য নিরাপত্তা সংস্থা অধিভুক্ত দেশগুলোর নাগরিকদের আগেই প্যাকেট করা হয়েছে এমন খাবার এড়িয়ে চলতে বলেছেন। যার কারণে বিপুল পরিমাণ খাদ্য নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

অতিরিক্ত মানুষ, অতিরিক্ত সময় ঘরে থাকার কারণে আরো বেশি পরিমাণ শক্তি দরকার হচ্ছে। দে সিক্স নামের একটি জার্মান ইন্টারনেট প্রোভাইডর সংস্থা জানিয়েছেন তারা দিনে ৯.১ টেরাবাইট গতিতে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করছেন যা আগে কখনো ঘটেনি। মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আরো একটি বড় সমস্যা। চীনে প্রতিদিন প্রায় ২০০ টন মেডিকেল বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলে। পৃথিবীতে এমন প্রায় কয়েক হাজার টন বর্জ্য দৈনিক পোড়ানো হয় যা বায়ু দূষণে প্রভাব ফেলবে।

সবশেষে এটা বলা যায় যে, স্বল্প সময়ের জন্য হলেও পরিবেশের এ উন্নতি আমাদের জন্য কল্যাণমূলক। তবে আমাদের নিজেদের স্বার্থে নেতাদের ও পরিবেশ কর্মীদের এ মহামারী থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করে আমাদের ভালোবাসার পৃথিবীকে একটু সুষ্ঠু পরিবেশ উপহার দিতে হবে।

লেখকঃ

শেখ মোঃ আরিফুল ইসলাম

শিক্ষার্থী –
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।