বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষকদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন সদ্য প্রয়াত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত ইউজিসি অধ্যাপক এ এম হারুন-অর-রশিদ। এই একজন মানুষ শত শত পদার্থবিজ্ঞানী তৈরী করে গিয়েছেন এবং পদার্থবিজ্ঞানের অসংখ্য শিক্ষার্থীর অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করেছেন।

আমি যখন ছাত্র হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই আমাদের প্রথম ক্লাসটিই ছিল হারুন স্যারের। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কেমন হওয়া উচিত, কেমন করে কথা বলা উচিত, হাঁটা চলা উচিত সেই চিত্রটি আমাদের মানসপটে উনিই আমাদের এঁকে দিয়েছিলেন এবং সেটি এখনো আমার মানসপটে গেঁথে আছে।

সম্প্রতি দুইজন শিক্ষক অধ্যাপক এস ড. এম মুজিবুর রহমান এবং অধ্যাপক ড. আরশাদ মোমেন যথাক্রমে প্রথম আলো এবং bdnews২৪.com-এ লিখেছেন। স্যারকে নিয়ে লেখার এবং বলার আরো অনেক মানুষ আছে এবং নতুন প্রজন্মের জন্য হলেও আমাদের আরো বেশি করে লেখা ও বলা উচিত।

স্যারের সরাসরি ক্লাস পেয়েছি মাস্টার্সে উঠে। তিনি আমাদের কোয়ান্টাম মেকানিক্স পড়াতেন। যেমন করে অধ্যাপক ড. আরশাদ মোমেন তার bdnews২৪.com-এ লিখেছেন যে স্যার ছিলেন সকালের পাখি।

সত্যিই তাই উনি আমাদের সকাল ৮ টায় ক্লাস নিতেন এবং কোনদিন এমন হয়নি যে স্যার ৮ তার পরে ক্লাসে এসেছেন। ইদানিং শুনি কারো ৬০ ক্লাসের ১৩ টা ক্লাস নিয়ে কোর্স শেষ করে ফেলেছেন বা ৩০ টা ক্লাসের জন্য নির্ধারিত কোর্স ১০ টি ক্লাসেই শেষ। কারা করে এমন? যারা রাজনীতি করে শিক্ষকতাকে পার্ট-টাইম বানিয়ে ফেলে। অথচ এদেরই কি দাপট?

অথচ হারুন স্যারের মত একজন পন্ডিত শিক্ষককে জাতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপযুক্ত সম্মাননা দিতে পারলো না। অধ্যাপক ড. আরশাদ মোমেনের মত করেই বলতে হয় এই গ্লানি নিয়ে আমরা সবসময়ই বেদনা বোধ করতে থাকবো।

আমরা না তাকে করতে পেরেছি জাতীয় অধ্যাপক, না করতে পেরেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমেরিটাস অধ্যাপক। কারো প্রতি অশ্রদ্ধা না জানিয়ে বলছি, হারুন স্যারের তুলনায় অনেক কম যোগ্যতার অনেক শিক্ষক এরকম পদে আসীন হয়েছেন।

এটাই এই জাতির সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। যদিও স্যারকে ২১-শে পদক এবং স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়েছে কিন্তু একজন অধ্যাপক এবং জাত শিক্ষকের কাছে জাতীয় অধ্যাপক এবং এমেরিটাস অধ্যাপকই সবচেয়ে আরাধ্য।

গ্লানি শুধু এখানেই শেষ না। আমাদের আরো গ্লানি আছে। মৃত্যুর পর স্যারের নামাজ-এ-জানাজায় শুধু যে স্যারের ছাত্র এবং সহকর্মীদের উপস্থিতি খুবই নগন্য ছিল তাই নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনেরও উপস্থিতি ছিল শূন্য।

তবে সুখের কথা হলো প্রধানমন্ত্রী ঠিকই শোকবার্তা জানিয়েছেন। হারুন স্যারের মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন পর আরেক বরণ্য শিক্ষক মারা যান তিনি হলেন বুয়েটের ড. এনামুল হক। তার শিক্ষকতার চেয়ে বড় পরিচয় ছিল তিনি একজন খ্যাতিমান নাট্যকর্মী ছিলেন।

নাটক ও মঞ্চে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি মানুষের মন জয় করেছেন। তিনিও ২১-শে পদক ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত। তার নামাজ–এ-জানাজায় মন্ত্রী এমপিসহ অনেক মানুষ উপস্থিত ছিলেন। আমার ধারণা সেটি ড. এনামুল হকের শিক্ষক পরিচয়ের জন্য নয়।

সেটি ছিল তার নাট্যকর্মী পরিচয়ের জন্য। এতে প্রমাণিত হয় এই দেশে কেবল ভালো শিক্ষক ও গবেষক পরিচয়ে তেমন সম্মান পাওয়া যায় না। সম্মান পেতে হলে শিক্ষকতার বাহিরে কিছু করতে হবে যেমন রাজনীতি, অভিনয় ইত্যাদি। ভালো গবেষনা, ভালো শিক্ষক হলে কোন কিছু পাওয়ার সম্ভবনা নেই।

এমনকি নিজ কর্মস্থলের সহকর্মীরাও সম্মান দেয় না। এমন একটি দেশে গুণী শিক্ষক, গুণী গবেষক কিভাবে জন্মাবে?

লেখকঃ অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়