চাঁদ দেখা বিষয়ক আলোচনার শুরুতেই যে বিষয়াটা পরিষ্কার করা দরকার তা হচ্ছে, খালি চোখে নতুন চাঁদ দেখা (হিলাল) আর আরবি চন্দ্রমাস শুরু হবার মাঝে কিছুটা পার্থক্য আছে।
বর্তমানে সৌদি সরকার, তুরস্ক, ইউরোপিয়ান ফতোয়া কাউন্সিল এবং নর্থ আমেরিকা ফিকহ কাউন্সিল চন্দ্র মাসের হিসাব নির্ণয়ে লুনার পজিশান ফর্মুলা, লুনার ক্রিসেন্ট ভিজিবিলিটি ম্যাপ ব্যবহার করে হিজরি চন্দ্রবর্ষপঞ্জী তৈরি করে, সে মতে রোজা ও ঈদের পূর্বনির্ধারিত দিনক্ষণ অনুসরণ করেন।
এখানে হিলাল বা খালি চোখে নতুন চাঁদ দেখা যাবার সম্ভাবনাকে তেমন আমলে নেয়া হয় না বরং লুনার ক্রিসেন্ট ভিজিবিলিটি ম্যাপের যান্ত্রিক ভিত্তিতেই স্বয়ংক্রিয় গণনা পদ্ধতিতে মাস শুরু হয়। খালি চোখে চাঁদ দেখা বা হিলালের ক্ষেত্রে এই ফর্মুলা গুলোর শতভাগ সঠিকতা কিছুটা প্রশ্ন সাপেক্ষ।
সৌদি হিসাব পদ্ধতির ভিত্তিতে বলা হয় যদি মুন কনজাংকশন (পৃথিবী সূর্য ও চন্দ্র একই সরল রৈখিক অবস্থানে) সূর্যাস্তের আগে হয় এবং চন্দ্রাস্ত সূর্যাস্তের পরে হয় তাহলে নতুন চাঁদের মাস শুরু হবে। তবে এই পদ্ধতিতে ঠিক ঐ দিন চাঁদ দৃশ্যমান হতেও পারে আবার খোদ সৌদিতেই নাও হতে পারে। ফলে মাঝে মাঝে দেখা দেয় বিতর্ক।
আর বিশ্বব্যাপী একই দিনে খালি চোখে চাঁদ দেখা যায় না বলে একই দিনে ঈদ করা হবে কি হবে না এই নিয়ে রয়েছে বহু পুরানো বিতর্ক। এই বিতর্কের ভিতরে না ঢুকেই আমরা বাংলাদেশের চাঁদ দেখা কমিটির জন্য স্থানীয় সমাধান দিতে পারি।
আন্তঃধর্মীয় বিদ্যালয় ও বিভিন্ন দেশের মুসলমান সমাজগুলো একই দিনে ঈদ পালন না করলে পশ্চিমের দেশে বসবাসরত মুসলমানদের ব্যবসা অফিস ও স্কুলের ছুটিতে নানাবিধ ব্যবস্থাপনা সমস্যা তৈরি হয়। ঈদ ও অন্যান্য বড় ধর্মীয় দিবসে সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষের সাধারণ ছুটি থাকে বিধায় বাংলাদেশে চাঁদ দেখা সাপেক্ষে রোজা, ঈদ ও অন্যান্য ধর্মীয় দিবস পালন ব্যবস্থাপনা দিকে থেকে ঝামেলাহীন বলা চলে।
আবার বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেম সমাজও খালি চোখে চাঁদ দেখা সাপেক্ষে রোজার শুরু, শেষ এবং ঈদ করার পক্ষপাতী। এমতাবস্থায় দরকার শুধু তিনটি বিষয়ে মনোনিবেশ করা-
প্রথমত, আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের আলোকে নির্মিত চন্দ্রের অবস্থানকারী সফটওয়্যার গুলোর মাধ্যমে অতি সহজে যে কোন দিন ক্ষণে চন্দ্রের অবস্থান নির্ণয়ের জ্ঞান রাখা।
দ্বিতীয়ত, ভুল দিনে চাঁদ দেখার চেষ্টা না করা না কিংবা ভুল দিনে চাঁদ উঠার তথ্য সংগ্রহ শুরু না করা। এতে করে কিছু দায়িত্বহীন সোর্স ভুল তথ্য দিয়ে বা শুনা কথায় চাঁদ দেখা কমিটিকে বিতর্কিত করে।
তৃতীয়ত, খালি চোখে চাঁদ দেখা (হিলাল) আর আরবি চন্দ্র মাস শুরু হবার মাঝে কিছুটা পার্থক্যকে কারিগরি দিকথেকে সঠিক ভাবে বুঝার চেষ্টা। পাশাপাশি লুনার কনজাংকশনের ধারণা রাখা এবং লুনার কনজাংকশনের সাথে খালি চোখে চাঁদ দেখা যাবার পদ্ধতিগত সম্পর্ক তৈরি করা।
আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের মাধ্যমে নিখুঁত ভাবে লুনার কনজাংকশন, সূর্য ও চন্দ্রের কৌণিক দুরুত্ব, চন্দ্রাস্ত এবং চন্দ্রের অবস্থান নির্ণয় করা যায়। তথাপি খালি চোখে ঠিক প্রথম কোন দিন চাঁদ দেখা যাবে তা নিয়ে কিছুটা সন্দেহ থাকে, আবার আকাশ কতটা মেঘমুক্ত, কুয়াশা ও ধোঁয়াহীন পরিষ্কার তার উপরও চাঁদ দেখা (হিলাল) নির্ভর করে। তবে এটা নিয়েও আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের নির্দেশনা আছে। খালি চোখে চাঁদকে দেখতে হলে লুনার কনজাংকশনের ঠিক পরেই চন্দ্র আর সূর্যের মাঝে প্রায় দশ বা সাড়ে দশ ডিগ্রি কৌণিক অবস্থা থাকতে হবে, এবং চন্দ্রাস্ত সুর্যাস্তের পর হতে হবে। একই সরল রেখায় পৃথিবী সূর্য ও চাঁদ আসার পর (মুন কনজাংকশন) এই কোন তৈরি করতে অন্তত ১৫ থেকে ২৩ ঘন্টা সময় লাগে। জোতির্বিদ্যার তথ্য অনুযায়ী মুন কনজাংকশন পরবর্তী ১৫-২৩ ঘন্টার মধ্যে নতুন চাঁদের ক্রিসেন্ট বা হিলাল দেখা যাবে খালি চোখে। মুন কনজাংকশন কখন হবে তা জোতির্বিজ্ঞান ১০০% নির্ভুল হিসাব করতে পারে। যে সমস্ত অঞ্চলে মুন কনজাংকশন পরবর্তী ১৫-২৩ ঘন্টার মধ্যে সূর্যাস্ত হবে সেই সমস্ত অঞ্চলে খালি চোখে চাঁদ দেখা যাবে। মুন কনজাংকশনের পর ১৫ ঘন্টা অতিবাহিত হবার আগে আগে কেউ খালি চোখে চাঁদ দেখার দাবি করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
অর্থাৎ বাংলাদেশ বা ঢাকার চাঁদ দেখা কমিটি দেশের একাধিক (যেমন দক্ষিণ উত্তরের কোনাকুনি টেকনাফ-তেতুলিয়া কিংবা পশ্চিম পূর্বের কোনাকুনি সাতক্ষীরা-সিলেট) স্থানে মুন কনজাংকশনের হিসেব করবে সফটওয়্যারের মাধ্যমে। এর জন্য www.timeanddate.com/astronomy/moon, www.mooncalc.org, www.theskylive.com কিংবা অন্য যে কোন নির্ভরযোগ্য অনলাইন ফ্রি সফটওয়্যার টুল ব্যবহার করা যেতে পারে। তারপর নিচের তিনটি পদ্ধতি প্রয়োগ করবে-
ক। এই স্থানগুলোর বা দেশের অন্য কোথাও মুন কনজাংকশনের পরবর্তিতে সূর্যাস্তের আগে সুর্য ও চন্দ্রের মধ্যে অন্তত সাড়ে দশ ডিগ্রি কৌণিক অবস্থান তৈরি হতে পারে কিনা?
খ। মুন কনজাংকশনের পরবর্তিতে অন্তত ১৫ ঘন্টার পরে কোথাও সুর্যাস্ত হবে কিনা? এবং চন্দ্রাস্ত সুর্যাস্তের পর হবে কিনা। হলে ঐদিন চাঁদ দেখা যাবে।
গ। ক এবং খ পদ্ধতির উভয়টিতেই একেবারে সঠিক ভাবে জানা যাবে কোন বিশেষ দিনে বাংলাদেশের আকাশে চাঁদ দেখা যাবে কি যাবেনা। কঠিন মনে হলে আরেকটি সহজ পদ্ধতি আছে। সেটি হচ্ছে www.mooncalc.org বা এরকম সফটওয়ার সাইটে গিয়ে দেশের একাধিক স্থানের অবস্থানে দেখাতে হবে নতুন চাঁদ উঠার সম্ভাবনা কত শতাংশ। যদি নতুন চাঁদ দৃশ্যমান হবার সম্ভাবনা আধা শতাংশের নিচে থাকে, তাহলেও এটা নিশ্চিত যে খালি চোখে দেশের কোথাও চাঁদ দেখা যাবে না। অর্থাৎ সুর্যাস্তের আগে সুর্য ও চন্দ্রের কৌণিক অবস্থান সাড়ে দশ ডিগ্রির কম হলে, মুন কনজাংকশনের ১৫ ঘন্টার আগেই সুর্যাস্ত হয়ে গেলে কিংবা নতুন চাঁদের আধা শতাংশের কম দেখা গেলে বাংলাদেশের আকাশে চাঁদ দেখার কোন সম্ভাবনা থাকবে না। জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি ঐ দিনে তার আঞ্চলিক উৎস থেকে চাঁদ উঠার তথ্য সংগ্রহ করবে না। কেউ দাবি করলে বৈজ্ঞানিকভাবে তা অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে এবং সেভাবে বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্তসহ সংবাদ বিজ্ঞপ্তি তৈরি করবে।
অন্যদিকে সুর্যাস্তের আগে সুর্য ও চন্দ্রের কৌণিক অবস্থান সাড়ে দশ ডিগ্রি বা বেশি হলে, মুন কনজাংকশনের ১৫ ঘন্টার পরে দেশের আকাশে সুর্যাস্ত হলে গেলে কিংবা নতুন চাঁদের এক বা দেড় শতাংশের কাছাকাছি দেখা গেলে বাংলাদেশের আকাশে চাঁদ দেখা যাবে অবশ্যই, তখন শুধু উৎস থেকে নিশ্চিত হবার আনুষ্ঠানিকতা বাকি থাকবে। মেঘলা কিংবা ধোঁয়াশা-কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশ থাকলে আল হাদিসে বর্ণিত ধর্মীয় নিয়মের উপমহাদেশীয় পদ্ধতি মেনে কিংবা ৩০ দিন পূর্ণ হওয়া সাপেক্ষেও সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। উল্লেখ্য যে, হাদিস শরীফে আছে, হিলাল যদি দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায় তাহলে (রোজার) গণনা ত্রিশ পূর্ণ করো। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০৭।
ঘ। আরেকটি সহজ পদ্ধতি হচ্ছে, নিউ ক্রিসেন্ট ভিজিবিলিটি ম্যাপ দেখা। পৃথিবীর কোন অঞ্চলে কোন তারিখে খালি চোখে যন্ত্র ছাড়া কিংবা যন্ত্রের সাহায্যে নতুন চাঁদ দেখা যাবে তার নির্ভরযোগ্য ম্যাপ বেশ কিছু সাইটে পাওয়া যায়। এমনকি কোথায় চাঁদ দেখা যাবে না, ডেনিয়ন বা ড্যাঞ্জন লিমিট সহ এইসব ম্যাপ পাওয়া যায়। এরকম কিছু সাইট হচ্ছে, https://www.moonsighting.com/visibility.html, http://www.crescentwatch.org/cgi-bin/cw.cgi,
https://www.staff.science.uu.nl/~gent0113/islam/islam_lunvis_current_year.htm#08,
ক্রিসেন্ট ওয়াচ ডট ওয়ারজি ক্রিসেন্ট ভিজিবিলিটি ম্যাপ এবং প্রথম হিলালের ছবি ও প্রমাণাদি সাইটে আপলোড করে রাখে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০২১ সালের ১২ এপ্রিল হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলেস, মেক্সিকো, এবং কয়েকটি ক্যারিবীয় উপদ্বীপ থেকে পরিষ্কার আকাশ থাকা সাপেক্ষে যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই খালি চোখে চাঁদ দেখা যেতে পারে, পরের দিন বিশ্বের অন্য সর্বত্রই খালি চোখে চাঁদ দেখা যাবে বলে আশা করা যায়।
২০১৯ সালের ঈদুল ফিতরের আগে শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, এরকম প্রায়ই হয়েছে অতীতে। এরপরে ধর্ম মন্ত্রণালয় তাদের হাতে টেলিস্কোপ থাকা সত্ত্বেও সেগুলা পুরানো বলে নতুন করে থিওডোলাইট জাতীয় টেলিস্কোপ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যার প্রতিটির দাম পড়বে নূন্যতম ৫০ লাখ টাকার মতো। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব ও মন্ত্রীর এমন সিদ্ধান্ত আপাতদৃষ্টিতে আধুনিক মনে হলেও কারিগরি দিকে থেকে এমন সিদ্ধান্ত অগ্রহণযোগ্য। এমনটা রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয়ের নতুন আরেকটা খাতই শুধু তৈরি করবে।
উপরোক্ত কারিগরি পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে যে, আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান এতটাই এগিয়েছে যে চাঁদ দেখায় আলাদাভাবে থিওডোলাইট টেলিস্কোপ বা অন্য যে কোন টেলিস্কোপ ব্যবহারের কিংবা কেনার প্রয়োজন একেবারেই নেই। আবার যে চাঁদ খালি চোখে দেখা যাবে না তা অতি উন্নত টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলে সুন্নত নিয়মের হিলালও হয়ে যাবে না। আবার অ্যামেরিকান উপকূলের প্রশান্ত মহাসাগরীয় ও হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ, মধ্য এমেরিকা, পশ্চিম আফ্রিকা, সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্যে (সাধারণ এই কার্ভে নতুন চাঁদ দৃশ্যমান হয়) চাঁদ উঠার তথ্য পাওয়া সাপেক্ষে রোজা বা ঈদ শুরু হলে পুরা ব্যাপারটা আরো সহজ, এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চাঁদ দেখা কমিটির অতিরিক্ত কোন খরচের দরকারই পড়ে না।
ফলে অপ্রয়োজনীয় খরচে না যেতে আমরা চাঁদ দেখা কমিটিকে পরামর্শ দেই বিপরীতে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের কারগরি তথ্য বিশ্লেষণ ভিত্তিক চাঁদ দেখা ব্যবস্থাপনা সাজাতে পরামর্শ দেই। নবীজি (সা) অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই বলেই অক্ষায়িত করেছেন। এখানে আরো উল্লেখ্য যে, টেলিস্কোপ সহ বর্তমানের চাঁদ দেখা যন্ত্রপাতি গুলো অব্যবহৃত না রেখে সেগুলোকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করাই অধিক যুক্তিযুক্ত। প্রয়োজনে চাঁদ দেখা কমিটি সময়ে সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কারগরি সহায়তায় নিতে পারে। উন্নত যন্ত্রপাতি অলস ফেলে না রেখে শিক্ষায় ব্যবহারকেই অধিক যুক্তিযুক্ত মনে করি। চাঁদ দেখা নিয়ে ফিবছর চলে আসা বিতর্কের অবসান হোক এই কামনা করি।
লেখক: ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থের রচিয়তা। প্রকৌশলী, ইইই, বুয়েট। সফটওয়্যার আর্কিটেক্ট, ভোডাফোন নেদারল্যান্ডস। ই-মেইল: [email protected]