বেশ কয়েক বছর আগের কথা।

ততদিনে পি.এইচ.ডি-র পাট চুকিয়ে দেশে ফিরে এসেছি।

ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে একটা গেট-টুগেদারে দেখা হল। ছোট বেলার বন্ধুদের সাথে দেখা হলে কার না ভালো লাগে! তাই আমিও খুশিতে আটখানা হয়ে গেলাম।

আর ছোটবেলার বন্ধুদের সাফল্য দেখলে নিজেরই বুকটা গর্বে ফুলে উঠে। এই গেট-টুগেদারে গিয়ে দেখলাম, আমার বুকটা গর্বে ফুলে উঠার মতই হুলুস্থল অবস্থা হয়েছে আমার বন্ধুদের।

গেট-টুগেদারে গিয়ে দেখলাম, সবাই বেশ হাসি-খুশি আর প্রাণবন্ত, জীবনে সাফল্যের রেশ সবার চোখে-মুখে ঝিলিক দিচ্ছে। মোটামুটি সবাই পাঁচ-সাত বছর চাকরি বা ব্যবসা করে একটা ভালো পজিশনে চলে গেছে।

দেখলাম সবাই গাড়িতে করে নিজের বউ-বাচ্চা নিয়ে গেট-টুগেদারে এসেছে। এবং একটা পর্যায়ে গিয়ে দেখলাম বন্ধুদের সবার আলোচনাই বৈষয়িক দিকে মোড় নিয়েছে; মানে বাচ্চাকে কে কোন স্কুলে পড়াবে, বসুন্ধরা নাকি বারিধারাতে বাড়ি অথবা প্লট কিনবে কিংবা আগে কেনা এপার্টমেন্ট অথবা গাড়ির ইনস্টলমেন্ট কিভাবে দিবে ইত্যাদি এই টাইপ আলোচনায় চারিদিক মুখর হয়ে গেল।

অন্যদিকে আমার ঝোলাতে তখন একটা প্রায় পি.এইচ.ডি ডিগ্রী ছাড়া আর তেমন কিছুই নাই। দেশে কোন চাকরি পাই নাই। পি.এইচ.ডি ওয়ালাকে এই দেশে কেউ ভয়ে চাকরি দিতে চায় না, তাই দেশে চাকরির অভিজ্ঞতাও নাই। এদিকে পকেটে টাকা-পয়সা তেমন নাই, গাড়ি-বাড়ির কথা স্বপ্নেও ভাবি না।

তবে আগে নিজের লেখা কিছু বই ছিলো, সেটার রয়ালিটি, আর জার্নালে এডিটর হিসাবে কাজ করে যা পেতাম তা দিয়ে কোনমতে দিন পার করতে হত। তাও আবার দেশে এইসব কাজকে চরম অসম্মান করা হত।

একবার নিউইয়র্ক থেকে জার্নাল-এডিটর হিসাবে কাজ করে পাওয়া টাকা আর বই লিখে রয়ালিটি হিসাবে পাওয়া টাকা দেশের এক ব্যাংকে আনা যাবে কিনা শুনে জনৈক ব্যাংক অফিসার তাচ্ছিল্যের সাথে বলেছিলেন, “ও আচ্ছা তাহলে আপনি ফ্রী-ল্যান্সিং করেন”।

ফ্রী-ল্যান্সীং অবশ্যই একটা মহান পেশা, কিন্তু সেটা কোনভাবেই আমার কাজের সাথে যায় না। মনের দুঃখে সেই টাকা আর দেশের কোন ব্যাংকে আনি নাই, মালয়শিয়ার একটা ব্যাংকে সেই টাকা জমা হত।

তবে এত কিছু না থাকার পরেও সেই সময় আমার পৃথিবীর একদম প্রথম সারির টপ ১০০ এর ভিতরে থাকা ইউনিভার্সিটিতে গবেষণার অভিজ্ঞতা ছিলো, পৃথিবী বিখ্যাত জার্নালগুলোতে মৌলিক গবেষণাপত্র ছিলো, পৃথিবী বিখ্যাত রিসার্স-জার্নাল প্রকাশণা সংস্থার নামজাদা জার্নালে এডিটর হিসাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিলো, পৃথিবীর প্রায় সব মহাদেশেই আমার ফিন্ডের কনফারেন্সগুলোতে পেপার প্রেজেন্ট করা হয়েছিলো।

তবে এত কিছুর পরেও আমি ততদিনে বুঝে গিয়েছিলাম যে এই দুনিয়াতে বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার চেয়ে মানুষের বৈষয়িক বিষয় নিয়ে গবেষণাই বেশি সমাদৃত।

তাই বন্ধুদের গেট-টুগেদারে যখন গাড়ি তো দূরের কথা বাসা থেকে হেঁটে বাস স্টপে গিয়ে, বাসে করে গেট-টুগেদারের কাছাকাছি এক জায়গায় নামলাম তখন আকাশ মেঘ করে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নেমেছে।

এরপর আধা-বৃষ্টিতে প্রায় আধা কিলোমিটার হেঁটে গেট-টুগেদারে পৌছালাম তখন আমার কাক-ভেজা শরীর দেখে বউ-বাচ্চার সামনে আমার অনেক বন্ধুই অপদস্থ হয়ে গেল। সত্যি বলতে কি, ঢাকার রাস্তায় বেশি হাঁটার কারণে আমার জুতাগুলোও নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো আর আমার কখনোই খুব বেশি সংখ্যক ভালো জামা-কাপড় ছিলোনা।

আমি আমার জীবনে সবসময় মিতব্যায়ী হবার চেস্টা করেছি, প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস কখনোই কিনতাম না এবং অল্পতে তুষ্ট থাকার চেষ্টা করতাম। তো আমার এই অবস্থা দেখে কথা প্রসঙ্গে আমার এক বন্ধু ভাবীদের সামনে বলেই ফেলল,

“আমাদের আরাফাত সবসময় ভালো ছাত্র ছিলো, মেট্রিকে মন্ত্রীর কাছ থেকে গোল্ড মেডেল পেয়েছিলো, টেস্টে ফার্স্ট বয় ছিলো, ইন্টারমেডিয়েটে কলেজ থেকে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েছিল, বুয়েট থেকে পাশ করে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিল, পি.এইচ.ডি শেষ করেছে কিন্তু বেচারা এখন চাকরিই পাচ্ছেনা। অথচ, আমাদের ভিতর সবচেয়ে খারাপগুলোও তো এখন বড় বড় অফিসার হয়ে গেছে। আহারে আরাফাত!”

কথাটার মধ্য এমন কি হাসির ছিলো বুঝি নাই, কিন্তু সবার হাসির কারণ হতে পেরে সেদিন বেশ ভালোই লেগেছিল।

তবে সেদিন এটাও বুঝে গিয়েছিলাম যে শুধু জ্ঞান আর বুদ্ধি দিয়ে এই দুনিয়াতে বৈষয়িক সফলতা অর্জন করা যায় না, সেটা অর্জন করতে গেলে আরো কিছু স্কিল থাকা লাগে যেই স্কিল আবার আবার জ্ঞান-বুদ্ধিওয়ালা সবার ভেতর থাকেনা।

আর বৈষয়িক সফলতা অর্জন সবার প্রায়োরিটিও নয় এটা হয়ত অনেকেই বুঝতে চায় না। গাড়ি আর বাড়ি থাকাই সাফল্যের মাপকাঠি নয়। স্পিরিচুয়ালি স্যাটিসফাইড থাকাটাও অনেকের কাছে বিশাল এক বিশাল প্রায়োরিটি যেটা এই জামানায় অনেকেই বুঝবেনা।

অপ্রিয় কিন্ত একেবারে বাস্তব সত্য যে, অনাদিকাল থেকে এখন পর্যন্ত এবং সুদূর ভবিষ্যতেও এই দুনিয়াতে মানুষের আউট লুকটাই ম্যাটার হবে, মানি ম্যাটার হবে, ক্ষমতা ও দম্ভ ম্যাটার হবে।

তাই এই জামানায় সবাই ফিল্মের গ্লামারাস নায়ক-নায়িকা চিনলেও বেশিরভাগই জানেনা পোলিও ভ্যাকসিন আবিস্কারক Jonas Salk-কে যিনি তাঁর আবিস্কারটাকে পেটেন্ট করলে আজ পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ও ক্ষমতাশালীদের মধ্য একজন হতেন।

প্রায় বিনে পয়সায় পাওয়া পোলিও ভ্যাকসিনের জনক Jonas Salk না থাকলে হয়ত আজকে অনেকেই এই পৃথিবীর রং-রূপ থেকে বঞ্চিত হত, অথচ তাঁকে কেউ এই জামানার মনে রাখে নাই। Marie Curie সহ আরো কতশত বিজ্ঞানী নিজের জীবনের বিনিময়ে এই পৃথিবী গড়ে দিয়েছেন তাঁদের কতজনই বা আজ সাধারণ মানুষের কাছে সমাদৃত হয়েছেন?

অথচ কত যুদ্ধবাজ, দূর্নীতিপরায়ণ, কুচক্রী মানুষেরা দাপটের সাথে এই দুনিয়া শাসন করে গিয়েছে, মানুষের কাছে হয়েছেন মহান, অমর ও সমাদৃত।

এই পৃথিবীতে এটাই বাস্তব যে, স্পিরিচুয়ালি স্যাটিসফাইড হয়ে বৈষয়িক সফলতা আসবেনা। তাই যারা জ্ঞান-বিজ্ঞান অথবা মানবতার পথে সামনে যেতে চায় তাঁরা হয়ত কোনদিন বিলাসী গাড়িতে চড়তে নাও পাড়ে, সুরম্য অট্টালিকা তাঁদের নাও থাকতে পারে; কিন্তু যাদের জীবন-জীবিকা গাড়ি-বাড়ি ঘিরে চালিত হয় তাদের উপকারে তিনি আসতে পারেন।

আমাদের দেশের শিক্ষার অন্যতম একটা খারাপ দিক যে, এটা শুধু টাকা পয়সা ও বৈষয়িক সফলতা ঘিরেই আবর্তিত হয়। তাই সন্তান রেজাল্ট খারাপ করলে বাবা-মা রিশকাওয়ালাদের উপহাস করে বলেন

“পড়াশুনা না করলে ভবিষ্যতে রিশকাওয়ালাদের মত রিকশা চালাতে হবে”।

অথচ, আমাদের দেশে কোন বাবা-মা তার ছেলেকে হয়ত কোনদিন বলেন নাই “পড়াশুনা করো, পড়াশুনা করলে ভবিষ্যতে তুমি রিশকাওয়ালাদের উপকার করতে পারবে।” (কোটেট অংশটুকু Rafid Al Zahur, KUET এর)

এক স্বার্থপর সমাজের ফল আজকের এই প্রজন্ম। অনেক আগে আমি একবার ভেবেছিলাম, আজ থেকে হয়ত পঞ্চাশ বছর পরে পৃথিবীতে এমন এক সমাজ আসবে যারা একটা ইলেকট্রিক গাড়ি, একটা মোবাইল আর আর আশি বর্গফুটের একটা এপার্টমেন্টে থেকে জীবনের মানে খুঁজে বেড়াবে।

যারা ভাববে তাদের জীবন অনেক বর্ণিল, অনেক স্বপ্নময়। আর ঠিক সেই সময় পৃথিবীর আরেক প্রান্তে কিছু প্রচন্ড ক্ষমতাশালী মানুষ থাকবে যারা আসলে এইসব আপাত খাঁচায় বন্দী মানুষের হাতে একটা ইলেকট্রিক গাড়ি, একটা মোবাইল আর আর আশি বর্গফুটের একটা এপার্টমেন্টে দিয়ে তাদের জীবনকে মহান, বর্ণিল ও স্বপ্নময় ভাবতে শেখাবে।

আজ থেকে ২০০ বছরের মধ্য মানুষকে হয়ত অক্সিজেন পর্যন্ত কিনে নিঃশ্বাস নিতে হবে। সেই পৃথিবীতে যার সামর্থ থাকবে শুধু সেই বেঁচে থাকবে। যে বেঁচে থাকবে সে আসলে হবে খাঁচায় বন্দী দাস, অথচ সে ভাববে জীবন অনেক মহান, অনেক বর্ণিল, অনেক স্বপ্নময়।

আজকাল বাজারে গেলে অনেক ফলেই আর বীজ থাকেনা। জিনেটিক মডিফিকেশন করার ফলে বাজারে বিক্রিযোগ্য অনেক ফলের আর বীজ হয় না। তাই ভবিষ্যতে কেউ একটা ফলের গাছ চাইলেও মাটিতে লাগাতে পারবেনা।

সেই ফলের বীজ সহ যাবতীয় সব কিছুর কলকাঠি থাকবে অসীম ক্ষমতাবান কিছু মানুষের কাছে যারা মানুষের লোভ, আকাঙ্ক্ষা আর বিলাসিতাকে পুঁজি করে সাধারণ মানুষদের দাস করে রেখে দিবে। এভাবেই একদিন সবকিছু পুঁজিবাদের তলায় হারিয়ে যাবে।

মানুষের হাসি, কান্না, ঘৃণা, ভালোবাসা সবই হয়ে যাবে “ক্লোজআপ কাছে আসার গল্প”-এর মত বিক্রয়যোগ্য। সেই পুঁজিবাদ ইচ্ছা করলেই মানুষের হাতে বিলাস দ্রব্য ধরিয়ে দিয়ে খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান সহ মৌলিক চাহিদাতে টান দিবে। যতদিন দাস হয়ে থাকা যাবে, ততদিনই মিলবে আপাত মুক্তি।

যেই পানির অপর নাম জীবন, সেই পানি এই জামানায় এসে কিনে খেতে হয়। সরাসরি পানযোগ্য পানি এই জামানায় কোন শহুরে মানুষের হাতের নাগালে নেই। ভবিষ্যতে হয়ত, সবাইকে পানি কিনতে বাধ্য করা হবে।

জীবন দিয়েই ভবিষ্যতে জীবন কিনে নিতে হবে। হয়ত, ভবিষ্যতে সূর্যের আলোটাও আর বিনে পয়সায় মিলবেনা। অথচ, পোলিও ভ্যাকসিন আবিস্কারক Jonas Salk তাঁর ভ্যাকসিন প্যাটেন্ট না করা প্রসঙ্গে বলেছিলেন “সূর্যের কি কখনো প্যাটেন্ট হয়?” অথচ পুঁজিবাদের কোপে একদিন সূর্য, সূর্যের আলো, সৌরশক্তি সবই কিনে নিয়ে বাঁচতে হবে।

বিলাসিতার নেশা মাদকের চেয়েও ভয়াভহ। স্পিরিচুয়ালি স্যাটিসফাইড না হলে মানুষ আসলে কোনদিনও স্যাটিসফাইড হবেনা। মানুষের আকাঙ্ক্ষা আর চাহিদা হবে আকাশচুম্বী।

তাই সবার আকাঙ্ক্ষা কমুক, যতটুকু দরকার ততটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকুক।

Writer: Arafat Mahmood.

Work

City, University of London
Marie Curie Research Fellow
November 2020 – Present।London, United Kingdom

University of Malaya
January 29, 2019 – 2020
Kuala Lumpur, Malaysia

BUET
August 1, 2017 – January 28, 2019
Dhaka, Bangladesh

Elsevier
Review Editor
2016 – 2017

University of Malaya
Graduate Teaching Assistant
2011 – 2016
Kuala Lumpur, Malaysia

University of Malaya
Researcher
2008 – 2017
Kuala Lumpur, Malaysia

Education

University of Malaya
PhD
Class of 2012

BUET
Materials and Metallurgical Engineering
Class of 2008

Dhaka Residential Model College
High School
Class of 2001