১।
এলাকার মানুষ অনেকক্ষণ ধরে ট্রেনের পথ রোধ করে আছে। যাত্রীদের পালাবার পথ নেই। ট্রেনের মধ্যে খাবারদাবারও তেমন নেই যে দীর্ঘদিন এর ভেতর টিকে থাকা যাবে। আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটা ট্রেন ছিনতাই ছাড়া কিছু নয়।
কিন্তু এলাকাবাসী এটাকে ছিনতাই হিসেবে দেখছে না- দেখছে বিচারপ্রক্রিয়া হিসেবে। কিছুদিন আগে নাকি সাদা চামড়ার কেহ বা কাহারা তাদের গ্রামে গিয়ে দুই নম্বুরি ওষুধ বিক্রি করেছে। সেই ‘ওষুধের’ বিষক্রিয়ায় কিছু গ্রামবাসীর মৃত্যুও হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি যে ট্রেনে আছে এই ব্যাপারে গ্রামবাসীর সন্দেহ নেই। সেই ব্যাটাকে তাদের হাতে তুলে না দেওয়া পর্যন্ত ট্রেনসুদ্ধু লোক এই অজ পাড়াগাঁয়ে জিম্মি থাকবে।
ট্রেনের কেউ এই কাজের দায় নিচ্ছে না। মহা মুশকিল।
এগিয়ে এলেন ম্যাকগাইভার। ট্রেনের ডাক্তারদের কাছে প্রেশার মাপার যন্ত্র ছিল- তিনি সেটার সাথে একটা অ্যালার্ম ঘড়ি তার দিয়ে যুক্ত করে দিলেন। ম্যাকগাইভারের যুক্তি, এরকম পরিস্থিতিতে অভিযুক্ত ব্যক্তির নিশ্চয়ই প্রচুর ঘাম হচ্ছে। সেই ঘাম প্রেশার মাপার যন্ত্রের তার ছুঁলেই সাথে সাথে বর্তনী পূর্ণ হয়ে অ্যালার্ম বেজে উঠবে। যাত্রীদের হাতে এক এক করে সেটা লাগাতেই বেরিয়ে এল- কে মিথ্যা কথা বলছে।
এরকম যন্ত্র বাস্তবে সম্ভব কিনা সেটা খুবই বেরসিক একটা প্রশ্ন।
অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে ম্যাকগাইভার বলে একটা শব্দ পাবেন। ক্রিয়া। এর অর্থ হল হাতের কাছে পাওয়া যন্ত্রাংশ বা এটা সেটা ব্যবহার করে নতুন কিছু তৈরি বা মেরামত করা। নব্বইয়ের দশকে বিটিভিতে ম্যাকগাইভার দেখে থাকলে যে কেউ এই শব্দের সার্থকতা বুঝবেন। সামান্য জঞ্জাল বা যন্ত্রের কোন একটা অংশ একটা আরেকটার সাথে জোড়া দিয়ে পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যা সমাধান করার ব্যাপারে ম্যাকগাইভারের প্রায় অতিমানবিক একটা ক্ষমতা ছিল। লাই ডিটেক্টর ছাড়া আমার পছন্দের আর দু’য়েকটা উদাহরণ- একটা জেনারেটর, কিছু তার, আর দু’টো পয়সা দিয়ে ওয়েল্ডিং মেশিন তৈরি; গলার মাফলার, কিছু গ্যাস, গদির ভেতরের তুলো, আর গাড়ির গিয়ার স্টিক দিয়ে কামান তৈরি- ইত্যাদি।
জীববিজ্ঞানীদের একটা ম্যাকগাইভারগিরির গল্প শুনি চলুন।
২।
আমাদের জীবন রহস্য যে ডিএনএর মধ্যে ‘লেখা’ থাকে এটা তো মোটামুটি সবার জানা।
কম্পিউটারে কিছু লেখার কথা চিন্তা করুন। লেখার সময় আপনি কিছু অংশ কেটে বাদ দিতে পারছেন, নতুন যোগ করতে পারছেন, বানান ভুল-টুল চোখে পড়লে ঠিক করছেন। এগুলো লেখালেখির স্বাভাবিক অংশ। বিজ্ঞানীরা ভাবলেন- ডিএনএ তো ঘুরে ফিরে এক ধরণের ভাষাই বলা চলে। কম্পিউটারের মত লেখা সম্পাদনা কি ডিএনএর ক্ষেত্রে করা যায় না?
করা গেলে যে সেটা একটা বিশাল ব্যাপার হবে তাতে সন্দেহমাত্র নেই। কারো ডিএনএতে কোথাও ডায়াবেটিসের কথা লেখা থাকলে সেটা মুছে ফেলা যাবে। ধান-পাটের ডিএনএর যে জায়গাটাতে ফলন বা রোগ প্রতিরোধ সংক্রান্ত কথা লেখা থাকে- সেগুলো বদলে আমাদের পছন্দমত করে নেওয়া যাবে। গরু যাতে বেশি দুধ দেয় সেই ব্যবস্থা করা যাবে। মশার ডিএনএ পরিবর্তন করে লিখে দেওয়া যাবে- আমি অতি ভাল প্রাণী, রোগ টোগ ছড়ানোর মধ্যে আমি নেই। ডিএনএ পরিবর্তন করতে পারা মানে কার্যত জীবনের নীলনকশা বদলে ফেলা।
যেকোন লেখার মধ্যে একটা শব্দের বানানের জন্য গোটা বাক্যের অর্থ পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে, তা তো জানেন। ডিএনএর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য- অনেক সময় এক অক্ষর ডিএনএ এদিক ওদিক হওয়া মানে ক্যান্সার আর সুস্থতার পার্থক্য। কাজেই ডিএনএর একটা অক্ষর পরিবর্তন করতে শেখা আর ইঞ্জিন আবিষ্কার কাছাকাছি। বিজ্ঞানীরা এর গুরুত্ব ভালমতই বুঝেছেন।
বলছি নব্বইয়ের দশকের কথা, যখন এ বিষয়ে গবেষণা হাঁটি হাঁটি পা পা করে শুরু হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, লেখা সম্পাদনার সবচেয়ে সহজ ব্যাপারটা হচ্ছে কেটে বাদ দেওয়া। কাজেই ডিএনএ সম্পাদনার প্রথম ধাপ হিসেবে তারা সেটা নিয়েই পড়লেন- কীভাবে ডিএনএর কিছু অংশ কেটে বাদ দেওয়া যায়।
এই কাজের জন্য একটা বিশেষ যন্ত্র দরকার। ডিএনএ যেহেতু একটা অণু, কাজেই তাকে কাটার জন্য দরকার আণবিক যন্ত্র। সেই আণবিক যন্ত্রের নাম হল প্রোটিন। প্রোটিন মানে এখানে কথ্য ভাষার আমিষ নয়। আমাদের দেহের প্রত্যেকটা কোষের মধ্যে সবসময় হাজার রকম কাজ চলতে থাকে- কোষের বাইরে থেকে মালমশলা আনা, সেই মালমশলা জায়গামত পাঠানোর ব্যবস্থা করা, সেটা ভেঙ্গে শক্তি উৎপাদন করা, অপ্রয়োজনীয় জিনিস বেশি হয়ে গেলে সেটা ‘রিসাইকেল’ করার ব্যবস্থা করা, ইত্যাদি। এগুলো এবং আরো কোটি রকমের কাজ করার জন্য কোষ যে অতিআণুবীক্ষণিক যন্ত্রগুলো ব্যবহার করে, সেগুলোই প্রোটিন। এসব প্রোটিন-যন্ত্রের আবার অসংখ্য শ্রেণীবিভাগ আছে- দু’টো জিনিস জোড়া লাগানোর প্রোটিন, কোন বড় জিনিসকে ভেঙে টুকরো করার প্রোটিন, মালবাহী গাড়ির মত প্রোটিন, মোটরের মত প্রোটিন, হেলিকপ্টারের পাখার মত প্রোটিন, ইত্যাদি।
কোষের মধ্যে এরকম এক শ্রেণীর প্রোটিন-যন্ত্র হল কাঁচির মত। এই কাঁচি-প্রোটিনগুলোর কাজ হল ডিএনএকে কাটা। এটা এমনিতে খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। ডিএনএ জীবন রহস্য বলে কোষ এটাকে খুব যত্ন করে রাখে। ডিএনএর কোথাও ক্ষত সৃষ্টি হলে কোষ চেষ্টা করে নিখুঁতভাবে তার মেরামত করার। এই অস্ত্রোপচারটা করার জন্য ডিএনএ কাটাকুটির প্রয়োজন হতে পারে। এর জন্যই কাঁচি হিসেবে কোষ প্রাকৃতিকভাবেই আলাদা একসেট প্রোটিন বানিয়ে রেখেছে।
ডিএনএ সম্পাদনায় উৎসাহী বিজ্ঞানীদের কাছে এই প্রোটিনগুলো খুব পছন্দ হল, তারা ভাবলেন- কোষের ভেতরের এই প্রাকৃতিক ছুরিকাঁচিগুলো দিয়েই দেখি ডিএনএকে সুবিধামত কাটা যায় কিনা। সেটা করার জন্য প্রথমে বিজ্ঞানীদের বুঝতে হল কোষের ভেতর এই ছুরিকাঁচিগুলো কীভাবে ডিএনএ কাটে।
ডিএনএ কাটার সাথে একদিক দিয়ে ফিতা কাটার মিল আছে, প্রক্রিয়াটা মোটামুটি আঙুল জাতীয় কিছু দিয়ে ধরে জায়গামত কাঁচি বসিয়ে ঘ্যাঁচ করে কেটে দেওয়ার মত। জায়গামত ধরার চেয়ে কেটে দেওয়ার অংশটা সহজ- প্রোটিনের ক্ষুরের মত জায়গাটা ডিএনএতে লাগালেই সপাং করে ডিএনএ ফালি হয়ে যায়। কিন্তু কাঁচি-প্রোটিনগুলো কীভাবে বোঝে ডিএনএটার ঠিক কোন জায়গায় ধরে কাটতে হবে?
খুব সহজ করে বললে- এই প্রক্রিয়াটা এক ধরণের ভাষার মত। ঠিক যে জায়গাতে প্রোটিনের কাঁচি বসার কথা, ডিএনএর সেই জায়গাটাতে কিছু সাংকেতিক বর্ণমালা দেওয়া থাকে। এই সংকেতটার বক্তব্য হয়ত মোটামুটি এরকম- “তের নম্বর কাঁচিটা এখানে বসবে”।
কিন্তু এতে তো কিছু সমাধান হচ্ছে না। বর্ণমালা থাকলেই তো হবে না, প্রোটিনের কাঁচিগুলোকে তো সেটা পড়ে বুঝতে হবে। প্রোটিন কি পড়তে পারে? পারে, তবে অন্ধ মানুষের মত। অন্ধ মানুষ যেমন ব্রেইল ভাষায় লেখা সংকেত ‘ছুঁয়ে’ বুঝতে পারেন লেখার বক্তব্য কী, প্রোটিনও সেরকম ডিএনএ ছুঁয়ে ছুঁয়ে (অনেকটা ‘স্ক্যান’ করে) বুঝতে পারে কোথায় কি লেখা আছে। এই দিক থেকে আমাদের আর কোষের প্রযুক্তি কীভাবে যেন মিলে গেছে।
এক কথায় বলতে গেলে, কাঁচি-প্রোটিনগুলো ডিএনএ ছুঁয়ে অনুভব করে কোথায় কাটতে হবে, তারপর সেখানে ক্ষুর বসিয়ে কেটে ফেলে। এজন্যই বলছিলাম ফিতা কাটার মত।
এই ব্যাপারটা বোঝার পর থেকে বিজ্ঞানীরা খানিকটা ধরতে পারলেন, ডিএনএ কাটার জন্য তাদের যন্ত্রগুলোর নকশা কীরকম হওয়া চাই। প্রত্যেকটা কাঁচি-প্রোটিনের দু’টো অংশ থাকা লাগবেই- এক হল ক্ষুর, যেটা দিয়ে কাটার কাজটা হয়, আরেক হল হাত, যেটা দিয়ে ডিএনএ ছুঁয়ে সে বুঝতে পারে কোথায় কাটতে হবে।
বিজ্ঞানীরা আরো বুঝলেন, প্রোটিনের ক্ষুরের অংশটা বানানো সেরকম কঠিন নয়- এরকম অজস্র ক্ষুর প্রকৃতিতেই পাওয়া যায়। কিন্তু খালি ক্ষুরটা দিয়ে তাদের কোন কাজ হবে না। একরাশ ডিএনএর মধ্যে এরকম একটা ক্ষুরকে বেখাপ্পাভাবে ছেড়ে দিলে সে এদিক সেদিক কেটে সব ফালাফালা করে ফেলবে। এটা আমাদের কাম্য নয়। আমরা চাই সে যাতে ডিএনএর একটা নির্দিষ্ট জায়গায় কাটে- আমরা যে জায়গায় কাটতে বলব সে জায়গায়। ধরুন আমরা চাই ডিএনএর যেখানে ডায়াবেটিস বা ক্যান্সার সংক্রান্ত ব্যাপার লেখা আছে, ঠিক সে জায়গার লেখাগুলো কাটতে। তা না করে যদি ক্ষুর বাবাজি মগজে রক্ত চলাচল জাতীয় কোন সিরিয়াস কথাবার্তাঅলা ডিএনএ কেটে দেয়- তাহলে তো মহাবিপদ। এই বিপদ এড়ানোর জন্য এমন বুদ্ধিমান প্রোটিন বানাতে হবে, যাতে সে আমাদের পছন্দমত ডিএনএর সংকেত বুঝতে পারে।
অন্যভাবে বলতে গেলে, কাঁচি-প্রোটিনের হাতটাকে এমনভাবে বানাতে হবে যাতে তারা ডায়াবেটিসঅলা ডিএনএ কাটার সংকেত ছুঁয়ে সেখানে ক্ষুরটাকে ঠেকাতে পারে।
ঠিক এই জায়গাটাতে এসে বিজ্ঞান বেশ অনেকদিন আটকে ছিল।
৩।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা এই প্রোটিনের হাত বানানোর সমস্যাটাকে দু’ভাবে ঘায়েল করার ধান্ধা করছিলেন। একদল চেষ্টা করছিলেন একদম গোড়া থেকে নতুন কাঁচি-প্রোটিন বানাতে। কিন্তু প্রোটিন তো আর দালান নয় যে ইটের পরে ইটের স্তর রেখে কংক্রিট ঢেলে দিলেই তৈরি হয়ে যাবে। এই গোড়া থেকে শুরু করে প্রোটিন বানানোর ব্যাপারটা আদৌ সফল হচ্ছিল না সেরকম।
আরেকদল বিজ্ঞানীর খেয়াল ছিল- আমরা নতুন প্রোটিন বানানোর চেষ্টা না করে প্রকৃতিময় খুঁজে দেখি আমাদের পছন্দের কাঁচি-প্রোটিন মিলে যায় কিনা। পৃথিবীতে প্রাণের বয়স কম করে হলেও সাড়ে তিনশ’ কোটি বছর। এই পুরো সময়টা ধরে প্রাকৃতিকভাবে জীবজগতে কাটাছেঁড়া এক্সপেরিমেন্ট তো কম চলেনি। প্রকৃতিই জীববিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় গবেষণাগার। যে প্রকৃতিতে হংসচঞ্চুর মত অদ্ভুত প্রাণী থাকতে পারে, হয়ত সেখানে ডায়াবেটিস কাটনেঅলা প্রোটিন-কাঁচিও থাকতে পারে। চিন্তাটা বেশ ইন্টারেস্টিং ছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু এই পদ্ধতিও তেমন একটা কাজে লাগছিল না।
সমাধানের জন্য এগিয়ে এলেন একজন ম্যাকগাইভার ও তার দলবল। ভদ্রলোকের নাম অবশ্য ম্যাকগাইভার ছিল না, ছিল শ্রীনিবাসন চন্দ্রশেখরন।
জন্স হপকিন্সের এই বিজ্ঞানী যেটা ভাবলেন- প্রকৃতিতে আমাদের পছন্দমত একটা আস্ত প্রোটিন বা তার হাত খুঁজে পাওয়া যাবে, এমন আশা সম্ভবত দুরাশা। কিন্তু হাত না পেলেও ছোট ছোট আঙুল তো খুঁজে পাওয়া যাবে। সেই আঙুলগুলো একসাথে জোড়া দিলেই তো একটা হাত হলে গেল। তারপর সেই হাতটাকে যেকোন একটা ক্ষুরের সাথে জোড়া লাগিয়ে দিলেই কাঁচি-প্রোটিন তৈরি।
এরকম ‘আঙুল’ যে প্রকৃতিতে আছে তা বিজ্ঞানীরা আগেই জানতেন। কিন্তু একটাকে আরেকটার সাথে জোড়া দিয়ে হাত বানানো বা তাদের সাথে ক্ষুর লাগানোর চিন্তা তাদের মাথায় আসেনি। আসেনি যে সেটা স্বাভাবিক। এই আঙুলগুলো একেকটা প্রকৃতির একেকরকম প্রোটিনের যন্ত্রাংশ হিসেবে কাজ করে। এদেরকে জোড়া দিতে হলে প্রত্যেককে তাদের যন্ত্রগুলো থেকে খুলে নিয়ে আসতে হবে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন যন্ত্র থেকে পার্টস খুলে জোড়া দেওয়া- জিনিসটার মধ্যে কীরকম একটা ধোলাইখাল গন্ধ আছে। এরকম ম্যাকগাইভারগিরি শুধু টেলিভিশন শোতেই সম্ভব, বিজ্ঞানে হয়ত নয়। কাজেই এই ব্যবস্থা যে আদৌ কাজ করবে, সেরকম ভরসা বিজ্ঞানীদের ছিল না।
চন্দ্রশেখরন এসে বিপ্লবটা করলেন। তার গবেষণাগারে তিনি প্রথম দেখালেন, এক প্রোটিন থেকে নেওয়া ক্ষুরের সাথে আরেক প্রোটিনের আঙুল জোড়া দিলে দিব্যি নতুন আরেকটা আণবিক কাঁচি তৈরি হয়ে যাচ্ছে। সেই কাঁচিটা ডিএনএ কাটাকাটিও করছে, এবং সেটা করছে বেশ ওস্তাদির সাথেই।
এই এক গবেষণা জীববিজ্ঞানে নতুন আবিষ্কারের এক প্লাবন নিয়ে এল। বিজ্ঞানীরা বুঝে গেলেন- প্রোটিন জিনিসটা অনেকটা মানুষের তৈরি যন্ত্রের মতই। ম্যাকগাইভার যেমন জেনারেটরের মোটর আর গাড়ির ব্যাটারি খুলে তার সাথে লাঠি লাগিয়ে নৌকার বৈঠা বানাতে পারেন, আমরাও একইভাবে প্রোটিনের যন্ত্রাংশ খুলে খুলে একটা আরেকটার সাথে লাগিয়ে হাজারটা নতুন প্রযুক্তি বানাতে পারি। জেনারেটরের মোটর বলে সে যে জেনারেটর ছাড়া আর কোথাও কাজ করবে না, এমনটা ভাবার যেমন কারণ নেই, তেমনি এক প্রোটিনের অংশ যে অন্য যন্ত্রের অংশ হিসেবে কাজ করতে পারবে না এমন কোন কথা নেই।
এই প্রযুক্তির সবচেয়ে আশ্চর্য এবং একই সাথে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ব্যবহার হচ্ছে সবুজ আলোর প্রোটিন। সেই ষাটের দশকে বিজ্ঞানীরা জেলিফিশের দেহে একটা বিশেষ প্রোটিন আবিষ্কার করেছিলেন, যেটা থেকে একধরণের সবুজ আলো বের হয়ে অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে। এমনিতে অন্যান্য প্রোটিনের নিজস্ব সেরকম রঙ নেই, কাজেই কোষের মধ্যে কোন প্রোটিন কোথায় কি করছে সেটা দেখা যায় না। মাইক্রোস্কোপ লাগালেও না।
চন্দ্রশেখরনের আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানীরা যেটা করলেন- জেলিফিশের সেই প্রোটিন-বাতিটা খুলে অন্যান্য বিভিন্ন প্রোটিনের সাথে জোড়া দিয়ে দিলেন। দেখা গেল এই বর্ণহীন প্রোটিনগুলোও এখন মাইক্রোস্কোপের নিচে সবুজ হয়ে জ্বলছে। এর অদ্ভুতুড়েমির কোন সীমা নেই- একটা যন্ত্র সমুদ্রের তলার জেলিফিশের গায়ে, আরেকটা যন্ত্র মাটির মানুষের গায়ে। দু’টো একসাথে জোড়া দেওয়ার পরে একটা নতুন যন্ত্র তৈরি হয়ে গেছে, এবং সেটা চমৎকার কাজ করছে। ব্যাপারটা অনেকটা গাড়ির হেডলাইট খুলে বাসায় এনে লাগিয়ে দেওয়ার মত।
এই প্রোটিন দেখার প্রযুক্তি যে জীববিজ্ঞান গবেষকদের জীবন কতটা সহজ করে দিয়েছে তার কোন হিসাব নেই।
৪।
গল্পটার আসল “টুইস্ট”-টাই এখনো আপনাদের বলিনি।
চন্দ্রশেখরের এই আবিষ্কার হয়েছে আজ থেকে বছর চব্বিশেক আগে। কিন্তু চন্দ্রশেখর এর প্রথম আবিষ্কারক নন। প্রোটিন নিয়ে ম্যাকগাইভারগিরির ‘আবিষ্কার’ এর আগেই হয়েছে, কিন্তু সেটা হয়েছে প্রকৃতিতে, হয়ত কয়েকশ’ কোটি বছর আগে।
প্রকৃতির হাজার প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা সাংঘাতিক মুন্সিয়ানার কাজ। এর জন্য দরকার প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি শুধু জীববিজ্ঞান গবেষণাগারেই নয়, প্রতিটি জীবকোষের ভেতরেও প্রয়োজন। যেমন ধরুন, কিছু জীবাণু নিয়ে আপনি তাদেরকে খানিকটা অ্যান্টিবায়োটিকে ছেড়ে দিলেন। এ অবস্থায় তারা বাঁচার জন্য কি করবে? খুব ভাল হয় যদি তারা একটা পাম্প জাতীয় যন্ত্র পেয়ে যায়- তাহলে কোষের ভেতর থেকে বজ্জাত অ্যান্টিবায়োটিকের অণুগুলোকে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। এরকম আরো হাজারটা প্রেক্ষিতে জীবজগতের নানারকম যন্ত্র বানানোর প্রয়োজন হয়।
প্রকৃতিতে এরকম অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া গেছে, যেখানে এ ধরণের বিপদের মুখে পড়ে জীবকোষ এর-ওর কাছ থেকে যন্ত্রাংশ ধারদেনা করে ঠিক তাদের পছন্দমত প্রয়োজনীয় যন্ত্র বানিয়ে নিয়েছে।
ধরে নিন একটা প্রোটিনের কাজ ডিএনএ মেরামত করা- ডিএনএর গায়ে কোন একটা জায়গায় বসে সে তার সেলাইয়ের কাজ করে। কিন্তু ডিএনএ তো লম্বা সুতোর মত- একে মেরামত করার জন্য তার একজায়গায় থিতু হয়ে বসে থাকলে চলবে না, বরং ডিএনএ বরাবর সরসর করে চলার একটা উপায় থাকতে হবে। ঠিকই দেখা গেল এই প্রোটিনগুলোর মেরামতের যন্ত্রাংশের সাথে একটা চলাচলের মোটর জোড়া দেওয়া। এরকম উদাহরণ প্রকৃতিতে এত বেশি যে আলাদা করে এদের কথা বলতে গেলে বছর পেরিয়ে যাবে।
সম্প্রতি একটা গবেষণাপত্রে রীতিমত গবেষকদের চোখের সামনে এই প্রক্রিয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। একটা ফ্লাস্কের মধ্যে তারা মোটামুটি দুর্ভিক্ষের পরিবেশ বানিয়ে সেখানে একদল জীবাণুকে দিনের পর দিন আবাদ করছিলেন। তাদের ইচ্ছা ছিল দেখা, এই দুর্ভিক্ষে পড়ে ব্যাটারা বুদ্ধি করে অখাদ্য হজম করার জন্য কোন যন্ত্র বানিয়ে ফেলে কিনা। হলও তাই। দিন কয়েক যেতে না যেতেই জীবাণুটা তার কোষের একটা পুরোনো যন্ত্রকে প্রথমে দু’কপি বানিয়ে ফেলল। তারপর তার সাথে আরেক যন্ত্র থেকে ধার করা সুইচ বসিয়ে নিল। তৈরি হয়ে গেল অখাদ্য হজম করার যন্ত্র। ব্যাস, এই নতুন প্রযুক্তি দিয়ে সে প্রতিকূল পরিবেশেও বেঁচে রইল দিব্যি হেসেখেলে।
এখানেই ব্যাপারটার নাটকীয়তা শেষ নয়। এরকম আলাদা যন্ত্রাংশ জোড়া দিয়ে নতুন যন্ত্র বানানোর জন্য কোষের মধ্যে আলাদা একটা প্রক্রিয়াই রয়েছে। কোষ তার ডিএনএ থেকে যেকোন প্রোটিন-যন্ত্র তৈরির সময় একটা চালাকি করে- সে পুরো যন্ত্রটা একসাথে বানায় না, সাধারণত প্রত্যেকটা যন্ত্রাংশ আলাদা আলাদা করে বানায়। এই সময়টাতেই এক যন্ত্রাংশ আরেকটার সাথে লেগে নতুন কিছু তৈরি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমাদের ডিএনএটার কিছু অংশ “পড়তে” গেলে বোঝা যায়- প্রত্যেকটা যন্ত্রাংশ তৈরির কথাবার্তা আলাদা আলাদাভাবে লেখা, মাঝখানে কিছু অংশ বাদ রেখে।
ব্যাপারটা অনেকটা এরকম- কোষের প্রত্যেকটা যন্ত্রের মধ্যে যন্ত্রাংশগুলো স্ক্রু দিয়ে আটকানো, ওয়েল্ডিং করে নয়। সেই স্ক্রু খোলার স্ক্রু ড্রাইভারও কোষের মধ্যে আছে। আবার একটার সাথে আরেকটা জোড়া লাগানোর জন্য আলাদা স্ক্রুও আছে। দেখে কেমন যেন সন্দেহ হয়, ব্যাটা ইচ্ছে করেই এমনভাবে তৈরি হয়েছে যাতে যন্ত্রাংশগুলো তৈরির সময় একটু ম্যাকগাইভারগিরির সুযোগ থাকে।
বিশ শতাব্দীর শেষ মাথায় এসে বিজ্ঞানীরা যেটা বুঝলেন, কোনভাবে প্রকৃতি সেটা আরো অনেক আগেই বুঝে ফেলেছে এবং নিত্যদিনের ঝামেলা সামলানোতে ব্যবহার করছে।
৫।
এই উদাহরণ একমাত্র নয়। যন্ত্রাংশ এদিক ওদিক করে নতুন যন্ত্র বানানো ছাড়াও আরো অনেক ক্ষেত্রেই জীববিজ্ঞানের ম্যাকগাইভারগিরির পরিচয় পাওয়া গেছে। একজন বিজ্ঞানী পুরো ব্যাপারটার নাম দিয়েছেন ন্যাচারাল জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং- অর্থাৎ প্রত্যেকটা কোষ প্রাকৃতিকভাবেই একেকজন ইঞ্জিনিয়ার।
এটা জানার সাথে সাথে একগাদা বৈজ্ঞানিক এবং কিছু ক্ষেত্রে দার্শনিক প্রশ্ন চলে আসে- কোষ তো জড়বস্তু, সে আবার ইঞ্জিনিয়ার হল কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞানীরা এখনও খুঁজে চলেছেন। তবে এটা না জানার জন্য তাদেরকে দোষ দেওয়া যায় না- ব্যাপারটা আমরা বুঝতে পেরেছি খুব বেশিদিন হয়নি।
বিজ্ঞানের, অন্তত জীববিজ্ঞানের যেকোন বড় আবিষ্কারের পর আমরা মোটামুটি দু’টো পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যাই। প্রথম পর্যায়ে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করেন ব্যাপারটা সম্পর্কে যতদূর সম্ভব জানতে, এবং কেন হয় কীভাবে হয় গোছের প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করতে। এই পর্যায়টাকে বলতে পারেন মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকা পর্যায়।
দ্বিতীয় পর্যায়টা হল এই চমৎকার জিনিসটার উৎপত্তি কোথা থেকে হল সে নিয়ে চিন্তাভাবনা করা।
ন্যাচারাল জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনও দ্বিতীয় পর্যায়ে আসেননি- তারা এখনো এর দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন।
——————————————
পরিশিষ্ট ও তথ্যসূত্র
ডিএনএ সম্পাদনা প্রযুক্তি সম্পর্কে লেখা বইয়ের সংখ্যা কম নয়। আমার পড়া একটা চমৎকার বই হল জেনিফার ডাউডনা ও স্যাম স্টার্নবার্গের লেখা A Crack in Creation: Gene Editing and the Unthinkable Power to Control Evolution। সচরাচর আমি তথ্যসূত্রে বইয়ের উল্লেখ করি না, গবেষণাপত্রেই থাকতে পছন্দ করি। কিন্তু ইতিহাস জানার জন্য এই বইটা আসলেই জম্পেশ, এবং জলবৎ তরলং ভাষায় লেখা। এ ব্যাপারে খানিকটা উৎসাহ আর ইংরিজির মোটামুটি গম্যি থাকলে অবশ্যই পড়বেন।
প্রোটিনের যন্ত্রাংশ এদিক ওদিক করে নতুন যন্ত্র বানানোর যে প্রক্রিয়ার কথা বললাম, লিটারেচারে তার নাম exon shuffling। যন্ত্রাংশগুলোকে বিজ্ঞানীরা বলেন domain, কাজেই protein domain rearrangement নামেও এর পরিচিতি আছে। এটা যে বাস্তবে আদতেই হয় সেটা নিয়ে বিজ্ঞানীমহলে কোন দ্বিমত নেই। এটা এবং প্রকৃতির আরো হাজার রকমের ম্যাকগাইভারগিরির গল্প পাবেন এই চমৎকার গবেষণাপত্রটাতে- Shapiro J. Living organisms author their read-write genomes in evolution. Biology. 2017 Dec;6(4):42.
গবেষণাগারে জীবাণুদের নতুন যন্ত্র তৈরি করার যে গল্প বললাম, সেটা অবশ্য exon shuffling প্রক্রিয়ায় হয়নি। সেটার গবেষণাপত্র এই- Van Hofwegen DJ, Hovde CJ, Minnich SA. Rapid evolution of citrate utilization by Escherichia coli by direct selection requires citT and dctA. Journal of bacteriology. 2016 Apr 1;198(7):1022-34.
– হাসান উজ্জামান শ্যামল
আমাদের বিজ্ঞান গ্রুপে যোগ দিন বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা