নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীন শিক্ষক নিয়োগের শর্তে এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি ‘অতিরিক্ত যোগ্যতা’ বা ‘অগ্রাধিকারভিত্তিক যোগ্যতা’ হিসেবে বিবেচিত হবে বলে উল্লেখ থাকে। উচ্চপদের বিজ্ঞপ্তিতে পিএইচডি না থাকলে অধিক বছর বেশি শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়।
ধরুন, সর্বোচ্চ পদের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি থাকলে ১৮ বছর, না থাকলে ২৫ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা লাগবে। তার মানে কারও এই ডিগ্রি অবসরপ্রাপ্তির পর তো বটেই, চাকরিরত অবস্থাতেও একটি অতিরিক্ত যোগ্যতা মাত্র! কেননা অঙ্কমতে শিক্ষকতা জীবনের রজতজয়ন্তীতে পিএইচডি ডিগ্রিটা ফ্রি হয়ে যায় না কি?
এবার গবেষণা পেশার দিকে নজর দেওয়া যাক। সেখানেও নবীন বিজ্ঞানী বা বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগদানে পিএইচডি ডিগ্রি একটি অতিরিক্ত যোগ্যতা। পরবর্তী পদে উন্নতির জন্য এটা অনেকটা একইরকম দেবতারূপে দেখা দেয়। অন্য পেশার চাকরিতেও যেমন প্রশাসন, পুলিশ, কাস্টমস, কর, সমাজকল্যাণ, শিক্ষা, ব্যাংকিং, সংস্কৃতি প্রভৃতি বিভাগে পিএইচডি নিছক একটি অপ্রয়োজনীয় যোগ্যতার নাম।
এসব প্রতিষ্ঠান থেকে যারা এই ডিগ্রি অর্জনের আহদ্মাদ দেখিয়েছেন, তারা জানেন কত তেল-খড় পোড়াতে হয়েছে এর পেছনে। তাহলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পিএইচডি ডিগ্রিধারীর প্রয়োজনীয়তার বালাই আছে কি? এই ডিগ্রি অর্জনের আদৌ কি কোনো বাধ্যবাধকতা নেই? পাঠক, এবার দয়া করে ভাবতে থাকুন।
প্রসঙ্গত দুই দশক আগের একটি ঘটনা বলি। স্বায়ত্তশাসিত একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে জীবনের প্রথম চাকরিতে যোগদান করে গবেষণা-পিএইচডির স্বপ্নে বিভোর ছিলাম। যোগদানের বছরখানেক পর জাপানের বিখ্যাত মনোবুশো বৃত্তিসহ একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির সুযোগ হলো।
আমার ইনস্টিটিউটের পরিচালক একজন ভালো গবেষক ছিলেন। তাকে খরবটা জানালাম। শুনে তিনি খুশি হলেন আর জিজ্ঞেস করলেন ডিগ্রি শেষে দেশে ফিরবো কিনা? হ্যাঁ সূচক জবাব শুনে, আমাকে শিক্ষাছুটির আবেদনের পরামর্শ দিলেন। আবেদন করলাম। ওই প্রতিষ্ঠানে সে সময় সরকারের উচ্চপর্যায়ের একজন আমলা ছুটি-সংক্রান্ত বিষয়ের দেখভাল করতেন। জাপানে পাড়ি জমানোর আগের দিন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত ছুটির জন্য তার দরজায় অপেক্ষা।
ফ্যাকাসে মুখে পরিচালক স্যার তার কক্ষ থেকে বের হলেন। তারপর বললেন, দুঃখজনক! বলতে চাইনি তবুও জেনে যাও। তিনি বললেন- পিএইচডি করে কী হবে!
প্রশ্ন হলো পিএইচডি কি তাহলে নিতান্তই লোক দেখানো কিছু, নাকি অন্যরকম গুরুত্বপূর্ণ কিছু? আসুন এবার এটা সম্পর্কে কিছুটা জানার চেষ্টা করি। পিএইচডি ডিগ্রি বোর্ডের একজন জ্যেষ্ঠ সদস্যের কাছে সাহস করে জানতে চেয়েছিলাম ‘মহোদয়, আমি কী পিএইচডি পাওয়ার যোগ্য!’
তিনি সরাসরি উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘নিজেকে জিজ্ঞেস কর; তুমি যদি মনে করো যে,
১. তোমার সাধ্যের মধ্যে গবেষণাযোগ্য ও মানবকল্যাণে প্রয়োজনীয় একটি গবেষণাক্ষেত্র চিহ্নিত করতে সক্ষম হবে,
২. তার জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণাকর্ম সম্পন্ন করতে পারবে,
৩. গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের ব্যাখ্যা দিতে সামর্থ্য হবে এবং
৪. গবেষণার ফলাফল প্রযোজ্য ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ ও তা কোনো জার্নালে প্রবন্ধ আকারে প্রকাশ করতে পারবে, তাহলেই বুঝবে যে, তুমি পিএইচডি ডিগ্রি পাওয়ার যোগ্য।’ তার মানে একজন পিএইচডি ডিগ্রিধারীকে এতগুলো অনন্য ও ব্যতিক্রমধর্মী যোগ্যতা-দক্ষতা অর্জন করতে হয়!
আসলে পিএইচডি হলো- একজন স্বনির্ভর গবেষক তৈরির কৌশল। আর এটা অর্জনের অনুভূতি সবাইকে সহজে বোঝানো যায় না। যেমন একজন নারী তার মা হওয়ার অনুভূতি যিনি মা হননি তাকে বোঝাতে সক্ষম হন না।
প্রতি বছর হাজারো শিক্ষার্থী পিএইচডি করার জন্য বিদেশে পাড়ি জমায়। হরেক রকম বিশেষায়িত গবেষণা করে তারা এই ডিগ্রি অর্জন করে। তারপর তাদের প্রায় সবাই বিদেশেই থেকে যায়। এদিকে আমরা আলোচনা সভায় ও খবরের পাতায় আফসোস করি; দেশের ‘মেধা পাচার’ হয়ে যাচ্ছে বলে।
যাহোক ডিগ্রি শেষে তারা বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা শিল্পকারখানায় তাদের যোগ্যতা-দক্ষতার সমকক্ষ কোনো না কোনো চাকরিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিদেশেই রয়ে যায়। বিদেশে এসব পদে পিএইচডি থাকাটা ঐচ্ছিক নয়, বরং বাধ্যতামূলক।
তাছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে অবসরপ্রাপ্তদের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে যোগদানের জন্য বিশেষ আমন্ত্রণও জানানো হয়ে থাকে। তাহলে বিদেশে পিএইচডি ডিগ্রি ‘অতিরিক্ত যোগ্যতা’ নয় এবং তা কারও জীবদ্দশায় কখনওই ফ্রি হয়ে যায় না।
সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমাদের দেশে লক্ষাধিক ভারতীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। প্রশ্ন করা যেতে পারে, এই লক্ষাধিক ভারতীয় কি শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত? উত্তর, না।
আসলে তারা বিশেষজ্ঞ শ্রেণির চাকুরে; বিভিন্ন শিল্পকারখানায় যেমন টেপটাইল, লেদার, গার্মেন্টস, ইলেকট্রনিপ, টেলিকমিউনিকেশনস, অটোমোবাইলস প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে উচ্চ বেতনে কর্মরত। ভারত ছাড়াও চীন, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশের আরও হাজারো বিদেশি নাগরিক এসব প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
অন্যদিকে বিদেশে চাকরিরত আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞদের এর চেয়ে কম বেতন দিলেও অনেকেই এসব পদে আগ্রহী হবেন। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। অনেকটা ‘বাড়ির গরু হয়ে উঠানের ঘাস পছন্দ না করা’র মতো অবস্থা আর কী! তাহলে আমরা কি নিজের মেধা বিদেশে পাচার করে চড়া দামে অন্যের মেধা ক্রয় করছি না?
আমাদের কাছে অবশ্য বিদেশি জিনিসের কদর একটু বেশি। আর কেউ বিদেশি ভাষায় কথা না বললে তাকে বিশেষজ্ঞ বলে মনেও হয় না। সাধারণভাবেও আমরা দেখি, যে বক্তা কথার মধ্যে দু-একটা ইংরেজি ঝাড়তে পারেন আলোচনা সভায় আনতে তাকে একটু বেশি সম্মানী দিতে হয়।
লেখায় কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতার চিত্র তুলে ধরেছি নিছক পিএইচডি ডিগ্রি যে একটি অতিরিক্ত যোগ্যতা নয় তা বোঝাবার জন্য। উন্নত সমাজে সর্বত্রই বিশেষায়িত জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন রয়েছে।
পিএইচডি গবেষকের মাধ্যমে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হয়। উন্নত বিশ্বে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ-অণুবিভাগ সৃষ্ট নতুন জ্ঞানকে জনকল্যাণে প্রয়োগের ব্যবস্থা করে। তাহলে অন্য ক্ষেত্রগুলোর পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে পিএইচডি ডিগ্রিধারী কর্মী ‘অ্যান্টিনা’ হিসেবে থাকতে হবে।
গবেষণায় অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সরকারের এ সকল দক্ষ কর্মী অন্যের গবেষণালব্ধ নতুন জ্ঞানের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবেন ও তা সমাজে প্রয়োগের ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু সে জন্য আমাদের যেতে হবে বহুদূর; পুরোনো ধ্যান-ধারণা বা বিধি-বিধানগুলো ঝেড়ে-মুছে ঠিকঠাক করে নিতে হবে।
২০৪০ সালের মধ্যে আমরা উন্নত দেশ গঠনের স্বপ্টম্ন দেখছি। সে অনুযায়ী পরিকল্পনা-মহাপরিকল্পনা হচ্ছে। দেশে গবেষণা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এসব পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়-গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও শিল্পকারখানার সঙ্গে সেতুবন্ধ স্থাপনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
ফলে দেশজ সমস্যা সমাধানে পিএইচডি-পোস্টডক্টোরাল গবেষণা বৃদ্ধি পাবে। আর আমরা ঈপ্সিত এসডিজির লক্ষ্য অর্জন ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার মহাসড়কে উঠতে পারবো।
ড. মো. মমিনুল ইসলাম
অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Email: [email protected]