বাংলাদেশ নামের ভৌগলিক এলাকাটি গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের মূল ভূখণ্ড। গঙ্গা নদীর বয়স প্রায় পাঁচ কোটি বছর — এই এতোটা সময় ধরে নদীটি হিমালয় থেকে পাথর-নুড়ির ক্ষুদ্রতম ভগ্নাবশেষ ভাসিয়ে নিয়ে বাংলাদেশের উপর দিয়ে সাগরে যাচ্ছে। গাঙ্গোত্রী নামের গ্লেসিয়ার থেকে যাত্রা করে এই নদী ২,৫২৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়।
যদিও গঙ্গোত্রী থেকে উৎসারিত নদীটিই মূল ধারা, এর সাথেই মিশেছে নারায়ণী, গোমতী, ঘাঘরা, গন্ধকি, সপ্তকোশী ও কোশী নদীর মূলধারা ও উপধারা। এরই মাঝে (গোমতী ছাড়া) সবক’টি নদী হিমালয় থেকে উৎসারিত। ব-দ্বীপের পলিগঠনে হিমালয় থেকে উৎসারিত নদীগুলোর ভূমিকা ব্যাপক।
জার্মানির কুয়েল এবং মার্কিন গুডব্রেড হচ্ছেন গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র -মেঘনা (GBM) অববাহিকার পলির অবমোচন, সঞ্চরণ ও পতন বিষয়ক সবচেয়ে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী। শেষোক্ত জনের আইসোটোপ চিহ্নিতকরণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রাপ্ত পরিমাপ অনুযায়ী GBM system-এ নদীবাহিত পলির গড় পরিমান বছরে ১.৬৭ বিলিয়ন টন। উল্লেখ্য, এই বিপুল পরিমান পলির ২ শতাংশেরও কম ব-দ্বীপে পতিত হয়ে ভূমি গঠনে সহায়তা করে। বাকিটা বঙ্গোপসাগরে হারিয়ে যায়।
আবহমান কাল ধরেই পলি অবমুক্ত হচ্ছে, ভাসছে, আসছে, পড়ছে, জমছে এবং “না জমতে পারার দুঃখ নিয়ে” হারিয়ে যাচ্ছে।
নদীর পানি সাগরে গিয়ে আবার হয়তো বাষ্পীভূত হয়ে মেঘের আকারে কিংবা হিমালয়ের ঠান্ডায় জমে বরফকুচি হয়ে, পরে গলে গলে নতুন এক স্রোতধারা হয়ে ফিরে আসছে। তবে পলি হারিয়ে যাওয়ার পর আর ফিরছে না এই ভূখণ্ডে।
নদীর প্রবাহে পানি থাকে, আর থাকে অনেক দূষণের সাথেই পলি ও বালুকণা। না, ভুল হলো। বড়-ছোট পাথরও থাকে। উদাহরন — উত্তর পূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী যদুকাটা ও পিয়াইন নদী।
এই পাহাড়ী নদীগুলো বর্ষায় খরস্রোতা, শীতে স্রোত খুবই হালকা। জলধারা বর্ষায় ব্যাপক, শীতে শীর্ণকায়া। বিপুল জলরাশি দূর্বার স্রোতে বালুকণা ও পাথর ভাসিয়ে/গড়িয়ে সমতলে আনে, পানি থাকে ঘোলা। শীতে কিন্তু পরিষ্কার টলটলে পানি, নদীর তলদেশ দিব্যি দেখা যায়!
এই মোহনীয় শীতের রূপ দেখতে অনেকেই সাদাপাথর ও জাফলং বেড়াতে যান। স্বচ্ছ পানিতে পলি প্রায় থাকেই না।
তাহলে যা বোঝা গেল, শীতের প্রবাহ ক্ষীণকায় হলেও নদীর পানিতে পলি ব্যাপক মাত্রায় কম থাকার সুবাদে শীতকালে পলি পতনের হার ব্যাপক মাত্রায়ই কম হয়। উজানের নদীগুলো যে উৎসমুখ থেকেই এদেশে আসুক (ভারত, ভূটানে, চীন কিংবা নেপাল), শীতকালে নদীর পানিতে পলি খুব কম থাকে।
তাহলে অভিন্ন নদী পলি বহন করে এনে বর্ষার জলধারা আটকে দেয় কোন্ প্রক্রিয়ায়?
এটা সম্পূর্ণ সত্যি কথা যে ভারত উজানের দেশ হয়ে সীমান্তের ওপারে এজমালি নদীগুলোয় অনেক বাঁধ ও ব্যারেজ নির্মাণ করেছে। কিজন্য? Run of the river বাঁধ দিয়েছে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য, যার spillway পার হওয়া পানি আমরা ভাটির নদীতে পাই। আর ব্যারেজ দিয়েছে শুকনো মৌসুমে “একতরফা” পানি সরিয়ে অন্য কোথাও ব্যাবহারের জন্য। নদীর ইকোসিস্টেম-কে বঞ্চিত করে এবং ভাটির দেশের মানুষকে ঠকিয়ে একতরফা (অর্থাৎ চুক্তি ও জবাবদিহিতা বিহীন) পানি নিয়ে নেওয়া অন্যায়। আগে ন্যায্যতার চুক্তি হবে, তারপর হিস্যার বুঝে নেওয়ার অবকাঠামো নির্মাণ। গঙ্গার পানি বন্টনের চুক্তি ব্যাতিরেকে বেশীরভাগ নদীর ক্ষেত্রে ভারত এখনো চুক্তিতে আসেনি, করা মৌসুমের সমস্যা কেবল পুঞ্জিভূত হচ্ছে।
ব্যারেজের মাধ্যমে যেটুকু পানি প্রত্যাহার করে সরিয়ে নেওয়া হলো, নদী তার প্রবাহ থেকে ততটুকু পানি হারিয়ে ফেলে। আর বাংলাদেশ যেহেতু অববাহিকার সর্বনিম্ন এলাকায় (downstream-এ), আমরাও প্রত্যাহারকৃত পানিটুকু শীত মৌসুমে পাই না। এতে নদীর বাস্তুসংস্থান চাপে পড়ে যায়।
শীতে অভিন্ন অববাহিকার নিন্মাঞ্চলে পানি কম পেলে বা শীতকালীন ধারা সঙ্কুচিত হলে নদী ও শাখা নদীগুলো আরো শীর্ণ হয়, বিধৌত এলাকায় সেচ-নির্ভর চাষবাস ব্যাহত হয়। উপকূলে জোয়ারের ঢেউয়ে আনুভূমিকভাবে বহুদূর লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়ে। লবণে চাষবাস আরোই ব্যাহত হয়। পানীয় জল পেতে নারীদের কয়েক কিলোমিটার হেঁটে ঘর্মাক্ত হতে হয়। সে এক দুর্দশাগ্ৰস্ত জীবন!
শীতের এই দুঃখের আখ্যান ও ভারতের সাথেই অভিন্ন নদীর পানির হিস্যার নিয়ে বিবাদ তাই দশকের পর দশক ধরে চলছে, যা বর্ষার বন্যা সমস্যা থেকে ভিন্নতর।
কিন্তু বাঁধ ও ব্যারেজের মাধ্যমে বাড়তি পলি ছেড়ে দিয়ে নিন্মাঞ্চলের নদীগুলোর তলদেশ “ভরিয়ে ফেলে” “ভারত বন্যার প্রকোপ বাড়াচ্ছে” — এটা বিজ্ঞানসম্মত নয়।
পলি উজানের সবক’টি দেশ থেকে নদীবাহিত হয়ে ব্যাপক পরিমাণেই আসে। ঐ পলি দিয়েই আমাদের ভালোবাসার ব-দ্বীপটি গঠিত। এটাই বাস্তবতা।
ভারতের সাথে অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা নিয়ে ট্র্যাক-২ অনেক কাজে অংশ নিয়েছি, Interlinking of Rivers প্রকল্প ঠেকাতে আন্তর্জাতিক মানের এ্যকাডেমিক বই লিখেছি/সম্পাদনা করেছি, কিন্তু বিজ্ঞানমনস্কতা বিসর্জন দিয়ে নয়।
দেশের মতোই, দেশপ্রেম কারো বাবার একক সম্পত্তি নয়!!
স্বগোতক্তিঃ (GBM পলিপতন বিষয়ক অথরিটি গুডব্রেড-কে একসময় প্রশ্ন করেছিলাম, তোমার আইসোটোপ প্রয়োগকৃত “পানির অনু” সাগর থেকে বাষ্পীভূত হয়ে, ফের বৃষ্টি হয়ে নদীতে জলকণা হিসেবে কখনো খুঁজে পেয়েছিলে কি? মৃদু হেসে সে বলেছিল, “তোমার দেশের নদী, তুমি খুঁজে নিও। আমি বরং পলি নিয়ে মেতে থাকি।”
না বন্ধু, আমি বরং আঠারো কোটি মানুষের মধ্যে “মুগ্ধ”দের খুঁজবো। “পানি লাগবে, পানি, পানি?”
বন্যায় মুগ্ধ-রা একভাবে প্রাসঙ্গিক, শীতে মুগ্ধ-রা অন্যভাবে প্রাসঙ্গিক।
আমার শোক হোক আমার শক্তি।)
(লেখাটি আহসান উদ্দিন আহমেদ-এর খেরোখাতা থেকে সংগৃহীত, বন্যা ২০২৪ নিয়ে তৃতীয় পর্ব।)