বাংলাদেশে স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষাদানের জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) যে কম্পিউটার কৌশল বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয় তার প্রথম প্রধান ছিলেন অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিভাগটির ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই মাহফুজ স্যার মৃত্যুবরণ করেন এবং তৎকালীন উপাচার্য আব্দুল মতিন পাটোয়ারি স্যার ১৯৮৬ সালে বিভাগের দায়িত্ব সহকারী অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের হাতে ন্যস্ত করেন।
বুদাপেস্ট টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান হাঙ্গেরির বিশ্বখ্যাত গাঞ্জ ইলেকট্রিক ওয়ার্ক্সের মতো প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছিলেন। সেই দুর্লভ অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা কাজে লাগানোর অভিপ্রায়ে তিনি বিপুল আত্মবিশ্বাসে নতুন বিভাগটি চালুর কাজে নেমে পড়লেন।
১৯৮৬ সালে যে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়েছিলেন, এরশাদ আমলের সেশন জটের কারণে তাঁদের ক্লাস শুরু হলো ১৯৮৮ সালের ১০ আগস্টে। অর্থাৎ ১৯৮৬ ও ১৯৮৭ ব্যাচের ক্লাস একসঙ্গে শুরু হলো। ক্লাস শুরুর তিন মাস আগেই মাহবুবুর রহমান শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সুযোগসহ কম্পিউটারে হাতেখড়ির ব্যবস্থা করলেন। তখন বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম দিকে থাকা প্রায় সবাই কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং অপশন দিয়ে বসল।
এটি তখন এমন একটি বিভাগ, যাতে সিনিয়র ভাইবোন নেই, শিক্ষক নেই, পাঠ্যপুস্তক নেই, নোট নেই, আগের বছরের প্রশ্নপত্র নেই, ‘পলাশীর মোড় কিংবা নীলক্ষেতের মোড়ের সুবিধা’ নেই, ল্যাব নেই, পর্যাপ্ত জায়গা নেই, পরামর্শ দেওয়ার লোক নেই।
তরুণ অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমানের মাথায় তখন কত বড় বোঝা! সারা দেশের শ্রেষ্ঠ ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর গুরুদায়িত্ব তাঁর ওপর। তখনো সিলেবাস নেই, ল্যাব নেই। তখনো ইন্টারনেটের আশীর্বাদ শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীর অনেক আধুনিক দেশেই পৌঁছায়নি যে তা থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে।
একমাত্র সম্বল ইইই বিভাগ থেকে সদ্য পাস করা অত্যন্ত মেধাবী ও সাহসী স্নাতকেরা, যাঁরা এই বিভাগে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালনের জন্য যোগদান করেছেন (যদিও তাঁদেরও ধারণা নেই কী পড়ানো হবে)।
আমি অবশ্য এই বিষয়গুলো সরাসরি জানতাম না, কারণ বিভাগে আমার যাতায়াত শুরু হয় কেবল ১৯৮৭ সাল থেকে। ক্লাস শুরু হওয়ার পর কিছু কোর্সের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে তখন আমি কাজ শুরু করেছি। যেহেতু খণ্ডকালীন, তাই বিভাগের সম্পদ ও সুযোগের অভাব সম্পর্কেও আমার কোনো ধারণা ছিল না।
তবে এটা বুঝতে পারতাম, আমার থেকে মাত্র দুই বছর বড় মাহবুব ভাইকে দেশের শ্রেষ্ঠ মেধাবী ছাত্রদের যোগ্য শিক্ষা দেওয়ার জন্য তাঁর প্রাণান্ত চেষ্টা করে যেতে হচ্ছে।
নতুন শিক্ষকদের ক্লাসে যাওয়ার আগে কী কী পড়াতে হবে, তা বলে দেওয়া, ল্যাবে কী সুবিধাগুলো যোগ করতে হবে, তা নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেনদরবার করা, সিলেবাস তৈরি করা, পাঠ্যপুস্তক খুঁজে বের করা—আরও কত কী!
এর মধ্যে ৫৫-৬০ জন শিক্ষার্থীর জন্য অতি প্রয়োজনীয় কম্পিউটার ছিল মাত্র দুটি। সুতরাং অফিস সময়ের বাইরে দীর্ঘক্ষণ ল্যাব খোলা রাখার ব্যবস্থা করলেন মাহবুব ভাই। যদিও ইএমই ভবনের প্রহরীরা ১০টায়ই চলে যেতেন, তবে দুজন শিক্ষকের স্বাক্ষরে ল্যাব খুলে রাখা হতো রাত ১২টা পর্যন্ত।
তাই প্রহরীরা চলে যাওয়ার সময় সিভিলের প্রহরীদের ডাকাডাকি করে ইএমই ভবনের গেট খুলে বের হতে হতো। দুই ব্যাচের প্রায় ৬০ জন ছাত্রের অভিভাবক হয়ে উঠলেন মাহবুব ভাই। ছাত্রদের সব প্রয়োজনেই ছিলেন মাহবুব ভাই।
তাঁর অভিভাবকত্বেই সিএসই ফ্যামিলির গোড়াপত্তন। অনেকটা এক ফ্লোরের বাসিন্দা।
বয়সে কাছাকাছি হওয়ায় এবং বিভাগে আমাদের বয়সী শিক্ষক না থাকায় মাহবুব ভাইয়ের সঙ্গে নানা রকম কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার। তাঁর প্যান্টে ঝুলত বিভাগের গোটা বিশেক চাবি। এই চাবিসহ ঝুলে পড়া প্যান্টে তাঁকে কখনো স্মার্ট মনে হতো না।
চলনে-বলনে অতি সাধারণ, কিন্তু তাঁর বিষয়ের পারদর্শিতায় তাঁর তুলনা ছিল না। কঠিন বিষয় সহজ করে উপস্থাপন করে ছাত্রদের মুগ্ধ করে দিতে পারতেন তিনি। এ জন্য তিনি ইউনেসকো-রোটস্কা ৮৫ পুরস্কারও পেয়েছিলেন।
একসময় তাঁর পদোন্নতি-নিয়োগকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত জটিলতায় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে বাধ্য হন। আমরা সব নবীন শিক্ষক এ বিষয়ে তদানীন্তন উপাচার্যের সঙ্গে আলাপ করতে গেলে তিনি আমাদের আশ্বস্ত করলেন।
কিন্তু মাহবুব ভাইয়ের বিদায় ঠেকানো গেল না। তিনি অস্ট্রেলিয়া চলে গেলেন। তারপর সেখান থেকে আমেরিকা। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মিনেসোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি ম্যানকাটোর বিভাগীয় প্রধান ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সম্পূর্ণ হার্ডওয়ারভিত্তিক হওয়া সত্ত্বেও অন্য যেকোনো কোর্স পড়াতে তাঁর কখনোই আপত্তি ছিল না।
তিনি পাঁচ-ছয়টি বই লিখেছেন, যা মাল্টিমিডিয়া এবং ই-কমার্সসংশ্লিষ্ট, যার সঙ্গে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার তেমন যোগাযোগ নেই। অসংখ্য কনফারেন্সের চেয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কম্পিউটারের হেন কোর্স নেই যা তিনি পড়াননি।
দেশে এলে বিভাগে আসার জন্য মাহবুব ভাই উন্মুখ হয়ে থাকতেন। বিভাগের কলেবর বৃদ্ধি, অগ্রগতি দেখে খুব খুশি হতেন।
২০১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর আমি আমার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মিনিয়াপোলিসে আমাদের স্নাতক মাহবুব ও নাদিয়ার বাসায় যাই। মাহবুব ভাই সেখানে চলে আসেন। আমাদের এই স্নাতকদের সঙ্গে মাহবুব ভাইয়ের কোনো দিন দেখা না হলেও সিএসই পরিবারের সদস্য হিসেবে তিনি অত্যন্ত সহজভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ থেকে রাতে ফিরে যান।
১৪ এপ্রিল ইউটি ডালাসের অধ্যাপক লতিফ ই-মেইলে জানালেন, মাহবুব ভাইয়ের শরীর ভালো নয়, তিনি মায়ো হাসপাতালে আছেন। ঘণ্টাখানেক পর মাহবুব খানের ই-মেইল—‘মাহবুব ভাই মারা গেছেন’।
বাংলাদেশে কম্পিউটার শিক্ষার গোড়াপত্তন করার জন্য মাহবুব ভাই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। যে বিভাগ মাহবুব ভাই তৈরি করেছেন অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে, উঁচু মান বজায় রেখে, তার সবটুকু উপভোগ করে আমি এখন অবসরে। মাহবুব ভাই তৈরি করেছেন, আমি তৈরি করিনি, কিন্তু তা সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করেছি। তাঁর কাছে আমার অনেক ঋণ, বিভাগের অন্যদের উপলব্ধিও সম্ভবত একই রকম হবে।
লেখকঃ মোহাম্মদ কায়কোবাদ,
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক ও বাংলাদেশ একাডেমি অব সাইন্সেস এর ফেলো।