বাংলাদেশ সম্প্রতি বিশ্বের একটি জ্ঞানসূচকে কেবল সারা বিশ্বে বা এশিয়াতেই নয়, খোদ দক্ষিণ এশিয়াতেও পিছনের দিকে স্থান পেয়েছে।
এই ব্যাপারটা বেশ দুঃখজনক, কারণ বাংলাদেশে মেধাবী মানুষের কোন অভাব নেই। কিন্তু তার পরেও জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চার ক্ষেত্রে কেন পিছিয়ে থাকা? তাও এত ভয়াবহভাবে? এটা নিয়ে ভাবতে গেলে বেশ কিছু বিষয় মাথায় এলো।
কে গবেষণা করবেন? — গবেষণার বিষয়টা উঠলেই প্রথমেই প্রশ্ন জাগে, কে করবেন সেটা? নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাপত্রের সংখ্যা নিয়ে একটা তালিকা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। সেটা নিয়ে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হইচই করছেন। কিন্তু আসলে গবেষণা করা কার কাজ?
বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ই আসলে টিচিং ইউনিভার্সিটি। মানে সেখানে পাঠদানই মূল উদ্দেশ্য। তাতে সমস্যার কিছু নেই। কিন্তু টিচিং ইউনিভার্সিটি থেকে রিসার্চ বের হবে টপ টপ করে, সেটা দাবি করায় সমস্যা আছে।
কারণ রিসার্চ আর টিচিং দুইটা দুই রকমের ব্যাপার। টিচিং ইউনিভার্সিটিতে যারা শিক্ষক, তাঁদের মূল কাজ নানা কোর্স পড়ানো। প্রতি সেমিস্টারে হয়তো একাধিক কোর্স নিয়ে শিক্ষকে ব্যস্ত থাকতে হয়, খাতা দেখা নম্বর দেয়া, এসব তো আছেই। ফলতঃ শিক্ষা-প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করার সুযোগ কম।
পক্ষান্তরে গবেষণা প্রধান বা রিসার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করার জন্য শিক্ষকেরা কোর্স পড়ানোর চাপ থেকে কিছুটা মুক্ত থাকেন। দিনের বড় একটা সময় গবেষণার কাজে দিতে পারেন।
গবেষণার জন্য ফান্ড আসে সরকারী সংস্থা থেকে অথবা বেসরকারী উৎস থেকে। আর এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজটাতে শিক্ষকের সাথে কাজ করেন মাস্টার্স বা পিএইচডি লেভেল, অর্থাৎ গ্রাজুয়েট লেভেলের ছাত্রছাত্রীরা।
শিক্ষক দিকনির্দেশনা দেন, শিক্ষার্থীরা নানা তথ্য সংগ্রহ বা এরকম কাজ করেন। গবেষণার কাজ আগানোর সাথে সাথে তৈরী হয় এক রাশ নতুন গবেষক।
সমস্যাটা হলো, বাংলাদেশের ইউনিভার্সিটিগুলো সবভাবেই টিচিং ইউনিভার্সিটির পর্যায়ে আছে। কিন্তু আমরা আশা করছি গবেষণা হবে সেখানে, গবেষণার মান হবে বিশ্বমানের, আর সেটা দিয়ে আমরা রাতারাতি জ্ঞানসূচকে আগাবো।
এইটা কী আসলে সম্ভব? না, সম্ভব না।
এখন কী হচ্ছে? টিচিং মডেলে তৈরী করা ইউনিভার্সিটিগুলোর কয়েকটিতে গভেষণা হচ্ছে। শিক্ষকেরা আন্ডারগ্রাজুয়েট পর্যায়ের মানে ব্যাচেলর্স এর শিক্ষার্থীদের দিয়ে গবেষণার কাজ করাচ্ছেন।
পুরো বিশ্বে এই লেভেলের শিক্ষার্থীদের কিন্তু গবেষণা করার দায় নাই। দুই একজন প্রতিভাবান শিক্ষার্থী করতে পারে, কিন্তু মোটের উপরে ব্যাচেলর্স এ পড়া শিক্ষার্থীদের কাজ পড়াশোনা করা — তাদের কাজ মোটেও গবেষণা করে ফাটিয়ে ফেলা না।
আরো একটা বড় সমস্যা আছে। আমাদের ইউনিভার্সিটিগুলোতে রিক্রুটমেন্ট করা হয় লেকচারার লেভেলে। বলাই বাহুল্য, এসব লেভেলে যারা যোগ দেন, তাদের অধিকাংশেরই পিএইচডি থাকে না।
মাত্র ব্যাচেলর্স ডিগ্রি বা অল্প কিছু ক্ষেত্রে মাস্টার্স ডিগ্রি করেই রাতারাতি একজন শিক্ষার্থী লেকচারার হয়ে ক্লাসে পড়ানো শুরু করে দেন। আরো ভয়াবহ ব্যাপার — দুই বছর চাকুরির পরে তাঁরা অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর লেভেলে প্রমোশনও পেয়ে যান।
এবং কেবল তার পরেই পিএইচডি করতে বাইরে যান (ইউনিভার্সিটি গুলোও তার আগে শিক্ষা ছুটি দিতে চায় না।) কিন্তু অন্যান্য দেশে কী হয়? ইউরোপ আমেরিকার কথা বলতে যাবো না। ভারতের আইআইটি গুলোর দিকেই তাকাই।
তাদের রিক্রুটমেন্ট হয় অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর লেভেলে। যোগ্যতা হল পিএইচডি থাকা। অর্থাৎ তারা শিক্ষানবিস কাউকে নয়, বরং টার্মিনাল ডিগ্রি পিএইচডি করার পর গবেষণার কাজে সম্পূর্ণ প্রস্তুত কাউকে সরাসরি নিয়োগ দিচ্ছে।
এমনকি আমি দেখেছি, আইআইটি থেকে আমেরিকার নানা ইউনিভার্সিটিতে রিক্রুটমেন্টের জন্য টিম গেছে। ফলতঃ আইআইটিগুলোর রিসার্চ আউটপুট বিশ্বমানে চলে এসেছে।
এমন না যে যারা লেকচারার হয়ে বাংলাদেশের নানা ইউনিভার্সিটিতে ঢুকছেন তাঁরা প্রতিভাবান না। কিন্তু প্রতিভার সাথে সাথে শিক্ষা ও জ্ঞানের গভীরতা বাড়াবারও দরকার আছে, যা পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণার ৪/৫ বছরে অর্জিত হয়।
বাংলাদেশের ইউনিভার্সিটিগুলোতে লেকচারার পর্যায়ে নিয়োগের আরেকটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রছাত্রীরা অনেক সময়ে সেখানেই লেকচারের হিসাবে ঢুকে যান পাস করার পরে পরে।
ঢুকেই কোর্স পড়ানোর বড় একটা চাপের মুখে পড়তে হয়। সেসময়ে গবেষণা করার কোন সুযোগ থাকে না। কিন্তু পিএইচডি করার জন্য শিক্ষাছুটি পেতে হলে ২/৩ বছর অন্তত অপেক্ষা করতে হয়।
একজন গবেষকের জীবনে গবেষণায় দক্ষতা বাড়াবার, ভালো কাজ করার স্বর্ণালী সময়টা চলে যায় লেকচারার হিসাবে চাকুরি পাকা করতে। সেটা নিশ্চিত করে ত্রিশের কোঠায় এসে তবেই পিএইচডি শুরুর সুযোগ পান।
আর মাঝে স্টাডি গ্যাপও হয়ে যায়। পড়ার মধ্যে থাকলে পিএইচডি করা যত সহজ, স্টাডি গ্যাপ হলে সেটা অত সহজ হয় না।
এর পাশাপাশি গবেষণা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ কত কম তা নিয়ে লিখতে গেলে রচনা হয়ে যাবে। প্রায় সব সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ১/২ কোটি টাকা মাত্র।
আর মাস্টার্স বা পিএইচডি লেভেলে রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্টদের বেতন দেয়ার ফান্ড নাই তেমন। ফলে গবেষণাটা করবে কে? গবেষণা তো আর চেহারা দেখে বা ডিগ্রি দেখিয়ে হয় না — সময় লাগে সরঞ্জাম লাগে, মানুষ লাগে।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যদি গবেষণার জন্য প্রণোদনা না আসে, অথবা সরকার থেকে গবেষণার ফান্ডিং এর নানা সুযোগ না থাকে নিয়মিতভাবে, তাহলে কার টাকায় হবে গবেষণা?
তাই যদি জ্ঞানসূচক টাইপের কোন সূচকে বাংলাদেশের নাম পিছনে থাকে, খুব অবাক হবার অবকাশ আছে কি?
আশা করি বাংলাদেশে রিসার্চ বা গবেষণা প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার জন্য সরকারী পর্যায়ে নীতিনির্ধারকেরা ভেবে দেখবেন। আর আরেকটা ব্যাপার বলতে হবে — সবার কিন্তু রিসার্চ ইউনিভার্সিটি হওয়ার দরকার নাই।
দেশের আনাচে কানাচে গবেষণা করার দরকার বা সামর্থ কোনটাই নাই। এর বদলে দেশে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণা-প্রধান করে গড়ে তোলার জন্যই সরকারের দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
সরকারী নীতিনির্ধারকেরা কেউ শুনছেন কি এই গরীবের কথা? বাসি হবার আগে?
– রাগিব হাসান