ভূগর্ভস্থ পানির যে রিজার্ভ সেটা মোবাইলের ব্যাটারির মত। এর চার্জিং ডিসচার্জিং সাইকেল আছে। বৃষ্টি, নদীর পানির প্রবাহ, পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝিরি এরকম নানান উৎস থেকে মাটি চুইয়ে তলায় বিভিন্ন স্তরে পানিটা জমা হয়।
এটা হল চার্জিং। আর আমরা যখন কৃষিতে সেচ, নগর থেকে গ্রামে ব্যবহারের জন্য ডিপ টিউবয়েল, শ্যালো টিউবওয়েল, সারফেস বা সাবমারমাসিবল পাম্প দিয়ে পানি উত্তোলন করি – তখন এটা ডিসচার্জ হয়।
এখন চার্জিং আর ডিসচার্জিং এর ব্যলেন্স না থাকলে অর্থাৎ কোনো কারনে চার্জিং কম, ডিসচার্জিং বেশী হলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমতে কমতে একসময় শুন্য হয়ে যায়। পৃথিবীর বহু জায়গায় ভূগর্ভস্থ পানি শেষ হয়ে গেছে এভাবে। পাশের দেশ ভারতেই বহু জায়গায় পানির তীব্র সংকট চলছে এই কারনে।
নগর সম্প্রসারণের ধরন এবং আমাদের উন্নয়ন মনস্তত্ব মিলে আমাদের ভূগর্ভস্থ জলাধার চার্জ হতে পারছেনা। একেতো জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে বৃষ্টি অনিয়মিত ও কমে গেছে। তারসাথে নগরের বেশীরভাগটাই সলিড কংক্রিটের পাকা এবং পিচ ঢালা সড়ক।
মাটি খুঁজে পাওয়া দুস্কর। ফলে যেটুকু বৃষ্টি হয় তাও মাটির তলায় যাবার সূযোগ পায়না। আমরা কেবল সবকিছু ইট সিমেন্টে পাকা করে ফেলতে পারলেই খুশি হয়ে যাই। আমাদের উন্নয়ন মানসিকতায় পাকা অবকাঠামোটা গেড়ে বসে আছে।
এর সাথে যুক্ত হয়ে আন্তঃনদী গুলোতে পানির হিস্যা নিশ্চিত না হওয়া। নদীর উপর নির্ভর করে বাংলাদেশে জনপদ, এর জীবনযাপন ও কৃষি নির্মিত। এখানে উজানের পানি যদি না আসে – স্বাভাবিকভাবেই দেশের উত্তরাঞ্চল মরুকরনের প্রক্রিয়ায় থাকে।
এই প্রক্রিয়া তরান্বিত করে জলবায়ু পরিবর্তন, জিএমও হাইব্রিড ভিত্তিক কৃষি ও অপরিকল্পিত নগরায়ন। সবমিলে একটা ভয়াবহ অবস্থা।
ধরে নেয়া হয় বা অনেকে মনে করেন ভাটির দেশ বলে উজানে ভারত পানি আটকে রাখলেও, তলা দিয়ে চুইয়ে পানি আসতেই থাকবে। ধরে নেয়া হয় এখানে ব্যাপক বৃষ্টিপাত পানির ঘাটতি পুরণে সাহায্য করবে।
দুটোই ভুল ধারনা। সেদিন খুব কাছে যখন পানির অভাবে বাংলাদেশের নগর, জনপদ, ইন্ডাস্ট্রি, বিদ্যুৎ কেন্দ্র সহ পুরো ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে।
সেজন্য আগে থেকেই সমন্বিত পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। যেমন –
১। বেশী পানি ব্যবহার হয় এমন বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা (যেমন – কয়লা, তেল, গ্যাস, পারমানবিক), কৃষি ব্যবস্থা পাল্টানো লাগবে। বিকল্প নবায়নযোগ্য শক্তি দিয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন অবকাঠামো নির্মান ও রাষায়নিক সার, উচ্চ সেচের চাহিদা মুক্ত কৃষির চর্চা করা লাগবে।
২। ইন্ডাস্ট্রিতে পানির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করে দিতে হবে।
৩। নগরে সুপেয় নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা ও অপচয় বন্ধ করার সব ব্যবস্থা নিতে হবে।
৪। শত শত পয়েন্টে বোর হোল করে বৃষ্টির সময় পানি ভূগর্ভস্থ জলাধারে পৌছার ব্যবস্থা করতে হবে।
৫। উন্নয়নের নামে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর, অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মান বন্ধ করতে হবে।
৬। গাছ কাটা যাবেনা।
শুধু এই ছয়টিই নয়। ফোরকাস্টিং, সুষ্ঠু আগাম পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও আরো কিছু ব্যবস্থার সমন্বয়ে ভূগর্ভস্থ ও উপরিতলের পানির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের করে পরিবেশের সুরক্ষা করতে হবে। যাতে শুধু মানুষ না – সকল জীব-বৈচিত্র এর সুবিধা নিতে পারে। পানির জন্য আমাদের শিশুরা কষ্ট পাচ্ছে এই দৃশ্য খুব কাছেই।
জরুরী
———–
“ভূগর্ভস্থ মিঠা পানির স্তর কমে যাবার কারনে দক্ষিনাঞ্চলে এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে। উজান থেকে মিঠা পানির প্রবাহ থাকা এবং ভূগর্ভস্থ মিঠা পানির পর্যাপ্ত উপস্থিতির কারনে এর একটা প্রাকৃতিক চাপ থাকে দক্ষিনে অবস্থিত সমুদ্রে। ফলে সমুদ্র থেকে মাটির অভ্যন্তর দিয়ে নোনা পানি ঢুকতে পারেনা। এখন একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়েছে, আরেক দিকে মাটির অভ্যন্তরে মিঠা পানির স্তর নেমে গেছে।
এই দুইয়ের প্রভাবে ভূগর্ভস্থ সমস্ত জলাধারে নোনা পানি ঢুকে সারা দক্ষিনাঞ্চলের মাটি, পানি নোনা হয়ে যাচ্ছে। সাতক্ষীরা, বাঘেরহাট, বরিশালের অনেক জায়গায় পুকুরের পানি পর্যন্ত লবনাক্ত হয়ে গেছে। কিছু কিছু জায়গায় টিউবঅয়েলে নোনা পানি উঠে। আর কিছু কিছু জায়গায় বছরের ৬/৭ মাস টিউবওয়েলে পানিই উঠেনা। এই পরিস্থিতিতে মানুষের জীবন, জীবিকা ও খাদ্য উৎপাদন ভয়াবহ রকমে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
তৈরী হচ্ছে স্থায়ী অনাবাদি জমি। ফলে হাজার হাজার মানুষ কার্যত বেঁচে থাকার উপায় না পেয়ে উত্তর দিক অর্থাৎ ঢাকা বা আশেপাশের জেলাগুলোতে মাইগ্রেট করে বিভিন্ন শ্রমে যুক্ত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।
তবে যা পরিস্থিতি তাতে ঢাকার কাছাকাছি অর্থাৎ কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফরিদপুর, শরীয়তপুর পর্যন্ত ভূগর্ভস্থ জলাধারের পানি নোনা হয়ে যাবার সম্ভাবনা ব্যাপক। এই অবস্থাটা তৈরি হবার সাথে কেয়ামতের খুব বেশী তফাত নেই।
এ ধরনের পরিস্থতি আসলে যে মানবিক সংকট তৈরি হবে তা এড়ানোর জন্য – সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নীতিনির্ধারক সহ সমাজের সকল স্তরের মানুষের বিষয়টি নিয়ে এখনই কাজ করা উচিত।”
লিখেছেন – তড়িৎ প্রকৌশলী এবং পরিবেশ বিষয়ক গবেষক মাহবুব সুমন