আপনি কি উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকায় গ্রাড স্কুলে ভর্তি হতে চান? কিন্তু বুঝতে পারছেন না মাস্টার্সে যাবেন না পিএইচডিতে? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য।
মার্কিন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাইরেক্ট পিএইচডি করার সুযোগ আছে। অর্থাৎ, বিএসসি ডিগ্রিধারীরা সরাসরি পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তির সুযোগ পান। বাংলাদেশে অনেকের মাঝে একটা ভুল ধারণা দেখেছি — পিএইচডি করতে গেলে আগে মাস্টার্স থাকা প্রয়োজন।
অন্তত মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটা ঠিক না — সুযোগ্য প্রার্থীদের সরাসরি পিএইচডিতে ভর্তি করা হয়। আর পিএইচডি করতে করতে মাস্টার্স ডিগ্রিটা নেয়া বা না নেয়া অনেক জায়গাতেই ছাত্রের ইচ্ছার উপরে নির্ভর করে।
যেমন, আমার গ্র্যাড স্কুল ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্স করতে হলে ৬টা কোর্স আর থিসিস লিখতে হতো। অনেক জায়গায় আবার ৬/৭টা কোর্স করলেই মাস্টার্স নেয়ার সুযোগ আছে।
আমি বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অফ অ্যালাবামা অ্যাট বার্মিংহাম এর কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগে সহযোগী অধ্যাপনার কাজ করছি, গ্রাজুয়েট ভর্তি প্রক্রিয়ার সাথে ভালো ভাবে জড়িত আছি। আমার বিভাগে মাস্টার্স করতে মোট ৩০ ক্রেডিট কোর্সওয়ার্ক লাগে, অথবা কিছু কম কোর্স কিন্তু থিসিস অপশনও আছে।
সম্প্রতি প্রতি সেমিস্টারে অন্তত ৩০-৫০ জন নতুন ভারতীয়/চীনা/পাকিস্তানী/নেপালী শিক্ষার্থী আসছে মাস্টার্সে, সেটা নিয়ে একটু পরেই লিখছি, আগে দেখা যাক, মাস্টার্স আর পিএইচডির মধ্যে সুবিধা অসুবিধা কেমন।
১) ফান্ডিং: মাস্টার্স পর্যায়ে ফান্ড পাওয়াটা বেশ কঠিন। মার্কিন অর্থনীতির এই দুর্দিনে মাস্টার্স পর্যায়ের ফান্ড প্রায় গায়েব হয়ে গেছে। কাজেই মাস্টার্সে ভর্তি হলে অন্তত ১ম সেমিস্টারে ফান্ড পাওয়াটা প্রায় অসম্ভব। সেক্ষেত্রে টিউশন ফি দিয়ে পড়তে হবে, যা অনেক ক্ষেত্রেই নাগালের বাইরের পর্যায়ে। তবে কিছু “কিন্তু” আছে এই জায়গাটায়।
স্টেইট ইউনিভার্সিটি, অর্থাৎ রাজ্য সরকারের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টিউশন কম। যেমন, ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয়ে এক সেমিস্টারে খরচ পড়ে প্রায় ৩ থেকে ৬ হাজার ডলার, তবে বিদেশী ছাত্রদের জন্য বেশি চার্জ সহ মোট ফি প্রায় ১০/১২ হাজার ডলারের মতো।
আর বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় হলে সেই ফি এর পরিমাণ বেড়ে যাবে অনেকখানি। আমার এক সময়ের কর্মস্থল জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব দিতে পারি, এখানে মাস্টার্স পর্যায়ে প্রতি সেমিস্টারের ফি প্রায় ২২ থেকে ২৫ হাজার ডলার।
তবে অনেক জায়গায় বিশেষ করে আমেরিকার দক্ষিণের দিকে টিউশন ফি অনেক কম। আমার এখনকার কর্মস্থল ইউনিভার্সিটি অফ অ্যালাবামাতে প্রতি সেমিস্টারে আউট অফ স্টেট ফি ৯ হাজার ডলারের মতো।
মোট ৩ সেমিস্টারে মাস্টার্সের কাজ সারতে পারলে মোট খরচ আসলে ৩০ হাজারের নিচেই পড়বে।
মাস্টার্সে ১ম সেমিস্টারে ভালো কাজ দেখিয়ে প্রফেসরের কাছ থেকে রিসার্চ অ্যাসিস্টান্টশিপ (আরএ) যোগাড় করতে পারলে টিউশন মাফ হতে পারে, আর বেতনও পাওয়া যেতে পারে।
আবার ফান্ডিং না পেলেও ক্যাম্পাসে এটাসেটা কাজ করে অনেকেই কিছুটা কাজ চালিয়ে নিচ্ছে দেখেছি।
পক্ষান্তরে, পিএইচডিতে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়েই ফান্ড দেয়া হয়, টিচিং/রিসার্চ অ্যাসিস্টান্টশিপ বা ফেলোশিপের মাধ্যমে। এর সাথে টিউশন ফীও মাফ করা হয়। যা বেতন দেয়া হয়, তা খুব বেশি না, তবে এদিক সেদিক করে বিদেশী ছাত্ররা ভালোই থাকতে পারে।
মাস্টার্সে ফান্ড দেয়া কম হয় বলে ভর্তির কড়াকড়িও কম, অ্যাডমিশন পাওয়া সহজ। মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের ভর্তির সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়ে আমরা জিআরই চাই না ইউএবিতে, আবার টোফেলও মোটামুটি হলেই চলে।
পক্ষান্তরে পিএইচডির অ্যাডমিশন পাওয়াটা কঠিন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই কয়েকশ মাস্টার্স ছাত্র থাকে, কিন্তু পিএইচডি ছাত্র নেয়া হয় জনা দশেক/বিশেক প্রতি বছরে।
ইদানিং আমার ইউনিভার্সিটি (UAB) এ প্রচুর এশিয়ার ছাত্র আসছে, তাদের কেউ ফান্ড নিয়ে আসে নাই। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের বোকামি নিয়ে আমার আক্ষেপের অন্ত নাই, বাংলাদেশের হাজার হাজার শিক্ষার্থী এই ভারতীয়/চীনা/পাকিস্তানী শিক্ষার্থীদের সমান বা অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো বেশি মেধাবী, কিন্তু ফান্ডিং না পেলে পড়বো না এই গোঁ ধরে থাকায় তারা দেশেই পড়ে আছে, যেখানে বাকি দেশের ছেলেপেলে দেড় বছরে মাস্টার্স সেরে ফেলে চাকুরিতে ঢুকে যাচ্ছে অনায়াসে। এরা ফান্ড পায় কই?
আসল ঘটনা হলো এরা এক সেমিস্টারের খরচ যোগাড় করে এসে পড়ে, কারণ জানা কথা একবার এসে পড়তে পারলে এটা সেটা করে ফান্ডিং মিলবেই।
২) সময়: মাস্টার্সে সময় লাগবে দেড় থেকে দুই বছর। আর পিএইচডিতে জায়গা ভেদে ৫ থেকে ৭ বছর (যদিও UABতে আমার অধীনে কাজ করা আমার দুই তুখোড় ছাত্র সরাসরি পৌনে চার বছরে পিএইচডি করেছে বটে, তবে তারা ব্যতিক্রম)। কাজেই ভেবে নিন, আপনার হাতে এতোটা সময় আছে কি না।
জব মার্কেটের অবস্থা পাল্টায় নিয়মিত। আর বিষয়ও পাল্টে যায় — আজ যে বিষয়টি একেবারে হট টপিক, ৫ বছর পরে সেটার কথা ভুলে যেতে পারে সবাই।
আমার অধ্যাপনা জীবনে দেখলাম, উদ্যমী ছেলেপেলে দেড় বছরে মাস্টার্স শেষ করে ফেলছে। এক ভারতীয় ছাত্রের সাথে কথা হলো, সে দেড় বছরেই মাস্টার্সের কোর্সওয়ার্ক শেষ করেছে, আর ছাত্রাবস্থাতেই চাকুরি খুঁজছে। বলাই বাহুল্য, কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসাবে চাকুরি এটা হোক সেটা হোক সে পেয়ে যাবে অচিরেই।
দেড় বছরের মধ্যে ডিগ্রি সহ প্রতিষ্ঠা। এই ব্যাপারটা অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যদি আপনার একাডেমিয়াতে যাবার ইচ্ছা না থাকে, লক্ষ্য যদি হয় ইন্ডাস্ট্রির চাকুরি, তাহলে মাস্টার্স করাই ভালো।
দুই ডিগ্রির মাঝে সময়ের পার্থক্য ৩ থেকে ৬ বছর। যদি পাস করে কোনো কোম্পানিতেই যোগ দেন এন্ট্রি লেভেলে, পিএইচডি অতিরিক্ত খুব একটা কাজ দেবে না, বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া (আর অ্যান্ড ডি ল্যাব, রিসার্চ ল্যাব ইত্যাদি বাদে)।
কাজেই কেবল ডক্টর তকমা লাগাবার এই সময়টা ছাত্রবেতনে কাটিয়ে পরিবারপরিজন ও নিজেকে অর্থকষ্টে রাখার মানেই হয় না।
বিশেষ করে যখন দেখবেন আপনি ৬/৭ বছর পিএইচডি করে দারিদ্রসীমার নীচে পরিবারকে রাখছেন যেখানে আপনার পাশের অনেকেই বুদ্ধি করে মাস্টার্স নিয়ে সম্মানজনক বেতনের চাকুরিতে আছে দুই বছরের মাথায়।
৩) খাটুনি: মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যায়ের খাটুনির মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। মাস্টার্সের কোর্স রিকয়ারমেন্ট পিএইচডির প্রায় অর্ধেক, আর থিসিসের পার্থক্যও বিশাল। মাস্টার্সের থিসিস প্রায় ক্ষেত্রেই একটি মাত্র প্রজেক্ট নির্ভর, যেখানে পিএইচডি থিসিসে একাধিক রিসার্চ পেপারের কাজ নিয়ে বেশ বড় আকারের কাজ করতে হয়।
এক সেমিস্টার খেটেই এক্সপেরিমেন্ট সহ মাস্টার্স থিসিস অনেকে লিখে ফেলে, যেখানে পিএইচডির গবেষণা শেষ হবার পরে থিসিস লিখতেই অনেকের এর চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগে। আবার অধিকাংশ মাস্টার্স প্রোগ্রামেই নন থিসিস অপশন থাকে। আমার ইউনিভার্সিটিতে (UAB) সেটাই প্রায় সবাই করে।
কাজেই কয়েক বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করার মতো উদ্যম বজায় রাখতে পারবেন কি না, সেটা আগেই ভেবে দেখুন। সেশন জটের কল্যাণে বাংলাদেশ থেকে আসা গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টরা অনেকেই ২৫+ বয়সের, পিএইচডি করতে করতে ৩০-৩৩+ হয়ে যায়, সেই বয়সে পড়া/পরীক্ষা দেয়ার মতো তেজ আছে/থাকবে কি আপনার? হয়তো আছে, তবে অনেকেরই আর উদ্যমটা থাকে না।
৪) চাকুরি: আপনার লক্ষ্য যদি হয় কোনো মার্কিন কোম্পানিতে চাকুরি পাওয়া, তাহলে তার জন্য মাস্টার্স করাই যথেষ্ট। অধিকাংশ চাকুরির জন্য মাস্টার্স ডিগ্রি হলেই চলে। আর ২ বছর পড়েই চাকুরির বাজারে ঢুকতে পারছেন, যা বড় একটা সুবিধা।
অনেক চাকুরিতেই পিএইচডি থাকাটা কোনো অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসাবে ধরা হয় না। উদাহরণ দেই — গুগলে বিএসসি, মাস্টার্স, বা পিএইচডি সব রকমের লোকজনই নেয়া হয়। মাস্টার্সের চাইতে পিএইচডিতে ৩ থেকে ৪ বছর সময় বেশি লাগে।
কাজেই আজ যিনি মাস্টার্স নিয়েই ঢুকছেন সেখানে, ৩/৪ বছর পরে স্টক অপশন, বেতন, আর বোনাস সব মিলে কয়েক মিলিয়ন ডলার এগিয়ে থাকবেন। অধিকাংশ টেক কোম্পানিতেই পিএইচডি ডিগ্রি থাকলে শুরুতে অল্প একটু বেশি বেতন থাকে, কিন্তু ৩/৪ বছর আগে যোগ দেয়া মাস্টার্স ডিগ্রিধারীরা সেই সময়টাতে তার চেয়ে অনেক বেশিই সুবিধা পেয়ে গেছে।
গুগলে যখন ইন্টার্নশীপ করতাম, তখন অনেক গ্রুপের ম্যানেজারকে দেখেছি মাস্টার্স বা ব্যাচেলর্স করা, যেখানে তাদের অধীনে কাজ করা অনেকেই আবার পিএইচডি করা। কাজেই চাকুরির বাজারের অনেক জায়গাতেই পিএইচডি বা মাস্টার্সের কোনো পার্থক্য নেই।
হাতে নাতে দেখা কিছু উদাহরণ দেই, গুগলে দেড় বছরে মাস্টার্স পাশ করেও অনেকে ঢোকে (আমার ছাত্রই ঢুকেছে), আবার নামকরা টপ ইউনি থেকে ৭ বছরে পিএইচডি করেও ঢোকে, তাদের এন্ট্রি লেভেলের পজিশনে বেতনের পার্থক্য বছরে মাত্র ১০-১৫ হাজার ডলার মাত্র।
আর ঢোকার পর দেখা যাবে বস হয়তো কেবল ব্যাচেলর্স করা বা মাস্টার্স করা, পিএইচডি করার কারণে অতিরিক্ত সম্মান/সুবিধা অধিকাংশ কোম্পানিতেই নাই।
অবশ্য একাডেমিক ও রিসার্চ লাইনে আবার পিএইচডি অপরিহার্য। কাজেই আপনার লক্ষ্য যদি হয় একাডেমিক বা রিসার্চ লাইনে থাকা, সেক্ষেত্রে পিএইচডি করতেই হবে
তাহলে কী জিনিষ বিবেচনা করবেন?
১) আপনার মূল লক্ষ্য কী?: রিসার্চ/একাডেমিক লাইন, নাকি চাকুরি? (প্রফেসর হতে চাইলে পিএইচডি করেন, নাইলে সময় নষ্ট না করে মাস্টার্সে যান)
২) ফান্ড পাবেন কি পাবেন না?: ফান্ড না পেলে টিউশন ফি অন্তত ১ম সেমিস্টারে দিতে পারবেন কি?
৩) ধৈর্য্য: ৫/৬ বছর আরো পড়ার ধৈর্য্য আছে কি? বয়স আছে কি? (নাকি দেড়-দুই বছরে মাস্টার্স করে কাজে নামতে চান?)। আপনার পরিবার থাকলে বিশেষ করে বাচ্চা থাকলে তাদের নিয়ে আরো ৫/৬ বছর চলতে পারবেন কি?
সব বিচার করে বেছে নিন, পিএইচডি নাকি মাস্টার্স, কোনটিতে আবেদন করবেন। উল্লেখ্য, একবার একটা বেছে নিলে অন্যটাতে যেতে পারবেন না, তা কিন্তু না। দরকার হলে পরেও প্রোগ্রাম পাল্টানো যায়, যদিও সেটা সময়সাপেক্ষ।
© Ragib Hasan