বাংলাদেশের ঘরে এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাটতি হলো ছেলেমেয়েদের to the point উত্তর দেওয়া শেখানো হয় না। দ্বিতীয় হলো বড়দেরকে প্রশ্ন করা উৎসাহিত করা হয় না বরং বেয়াদবী হিসাবে দেখা হয়। তৃতীয় হলো, বড়দের আসরে ছোটদের থাকতে দেওয়া হয় না।

এইসব মিলিয়ে আমরা একটা বনসাই প্রজন্ম গড়ে তুলি। একজনের সত্যিকারের যেই পটেনশিয়াল সেটা অর্জনে সবচেয়ে বড় বাঁধা আমাদের সামাজিক কাঠামো।

কথা বলার সময়ও দেখেছি যদি জিজ্ঞেস করি একটা উত্তর দেয় আরেকটা বা উত্তর দিতে গিয়ে সাথে এত অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে যে মূল উত্তরটাই তখন হারিয়ে যায়।

আমি অনেক সময় আমার বিষয় পড়াই তার ইন কোর্স পরীক্ষায় সাধারণত ১/২ লাইনের উত্তর হয় এমন প্রশ্ন করি। অনেক সময় এক শব্দে উত্তরও হয়। তবে আমার প্রশ্ন অনেক বড় হয়। প্রশ্নটাকে গল্পের আকারে নিজেই বলি আর খানিক বাদে বাদে এর থেকে ছোট ছোট প্রশ্ন করি।

প্রশ্ন যাই করি না কেন প্রায় সকলেই টু দা পয়েন্ট উত্তর দিতে পারেনা। অধিকাংশই পুরো তত্বটা মুখস্ত লিখে দেয়। ভাব খানা এমন যেন পরীক্ষা আমার তাই আমি যেন কষ্ট করে প্রয়োজনীয় উত্তর বের করে নিন।

সহজ করে টু দা পয়েন্ট উত্তর দেওয়া আমাদের শেখানো হয় না। এইটা আমাদের রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, শিক্ষক, আমলা সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

টু দা পয়েন্ট উত্তর দেওয়া তারা শিখবে কিভাবে? সেই ১৯২১ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানে বার্ষিক বা ফাইনাল পরীক্ষায় মোট ৮টি প্রশ্ন থেকে ৫টি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পদ্ধতি চলছে।

দুনিয়া এর মধ্যে কত উত্থানপতন ঘটে গেছে। এমনকি বাংলাদেশও এর মধ্যে দুইবার স্বাধীন হয়ে গেছে। প্রথমবার ৪৭-এ ব্রিটিশদের কাছ থেকে আর ৭১-এ পাকিস্তানিদের হাত থেকে। অথচ সিস্টেমের পরিবর্তন ঘটেনি। প্রথম ভিসি পি যে হার্টগ সেই ১৯২১ সালে ইন্টারনাল এবং এক্সটার্নাল পরীক্ষক সিস্টেম চালু করেছিলেন আজও তা বলবৎ আছে।

সেই ১৯২১ সাল থেকে একটা অঘোষিত নিয়ম চালু আছে যে যিনি কোর্স পড়াবেন তার প্রশ্ন থেকে ৫-৬ টি প্রশ্ন রাখা হবে আর এক্সটার্নাল থেকে ২-৩ টি প্রশ্ন থাকবে। এত ধরাবাঁধা নিয়ম থাকায় ইন্টারনালের পক্ষে প্রশ্নের ধারা পরিবর্তনের সুযোগ নেই।

ধরুন আমি কোর্স শিক্ষক (ইন্টারনাল এক্সামিনার) হিসাবে আমার ইন কোর্স পরীক্ষার প্রশ্নের ধারা বজায় রেখে ফাইনাল পরীক্ষার প্রশ্ন করলাম। এখন পরীক্ষা কমিটি যখন ইন্টারনাল এবং এক্সটার্নাল পরীক্ষকের প্রশ্ন নিয়ে মডারেশন বোর্ডে বসেন দেখেন এই দুইজনের প্রশ্নগুলো কমপ্যাটিবল না।

ফলে অঘোষিত একটা নিয়ম হলো প্রশ্ন হবে দুইয়েক লাইনের আর উত্তর হবে ৪-৫ পাতার। অনেকে শুনি পাতা বা লাইন মেপেও নম্বর দেয়।

যুগ যুগ ধরে যেই ধারা চলে আসছে সেই ধারাতেই চলছি আমরা। অথচ আমরা জানি উন্নতির প্রধান নিয়ামক হলো বিবর্তন। যেই সিস্টেমের বিবর্তন নাই সেই সিস্টেম পচে যেতে বাধ্য।

এই সহজ সত্যিটিই আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ পর্যন্ত অনুধাবন করতে পারেনি। আমাদের শিক্ষার্থীরাও জেনে গেছে প্রশ্নের প্যাটার্ন কি। তাই তাদের চিন্তাধারাও বাক্সে বন্দি। এরা জেনে গেছে এই বছর এই চ্যাপ্টার থেকে প্রশ্ন আসলে পরের বছর এই প্রশ্নটি আসবে না।

তাই এদের চ্যাপ্টার বাদ দেওয়ার টেন্ডেসি আছে। তাছাড়া গত ৫ বছরের প্রশ্ন ব্যাংক স্টাডি করলে এরা ধরে ফেলতে পারে ঠিক কি কি প্রশ্ন আসতে পারে। ফলে প্রশ্ন, প্রশ্নের মান এবং প্যাটার্ন আসলে শিক্ষার্থীদের মান নির্ধারণীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আউট অফ দা বক্স চিন্তা যে করা যায় এটা আমরা শেখাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।

আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটাই মুখস্ত বিদ্যা আর গদবাধা প্যাটার্নে বন্দি। কোন শিক্ষক ইচ্ছে করলেও এই শৃঙ্খল থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার এই ত্রুটি মুক্তির কোন চেষ্টা কখনো তেমন হয়নি।

শেকল ভাঙতে হলে শিক্ষক এবং প্রশাসনের মধ্যে যতটুকু ড্রাইভ থাকতে হয় তা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একদম অনুপস্থিত। থাকবে কিভাবে। সবাইতো ব্যস্ত পদ পদবি আর রাজনীতি নিয়ে। শিক্ষার্থী নিয়েতো কেউ ভাবে না।