বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় ৬৪ জন। বছরে ক্ষতি অন্তত ৩৪ হাজার কোটি টাকা। এ অবস্থায় দীর্ঘ ১৪ মাসের গড়িমসি ও কালক্ষেপণের পরে নজিরবিহীন ছাত্র বিক্ষোভের মুখে গতবছর সড়ক পরিবহনের যে নতুন আইনের প্রস্তাব মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে, তাতে বড় ধরনের ভুল ও ভারসাম্যহীনতা লক্ষ করা গেছে। কিছু সংশোধনের পরে আরো প্রায় ১৩ মাস পরে আইনটি ২০ নভেম্বর ২০১৯ এ বাস্তবায়ন করা হল।
————————————-
বয়স ও শিক্ষা শ্রেণীর সংঘাত, শিশুশ্রমে আইনগত অনুউৎসাহঃ
————————————-
স্বাভাবিকভাবেই বলা হয়েছে গাড়ি চালানোর জন্য বয়স অন্তত ১৮ বছর হতে হবে। আগের নিয়মেও তা-ই ছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে অষ্টম শ্রেণী পাস করতে হবে। এতে দেশের মানবসম্পদ ব্যবস্থার কৌশলগত সমস্যা সৃষ্টি করা হয়েছে। একজন নাগরিক যেখানে ১২ থেকে সর্বোচ্চ ১৪ বছর বয়সেই অষ্টম শ্রেণী পাস করে, সেখানে পেশায় চালক হতে চাইলে তাকে ১৮ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তার জীবনের এ চার থেকে ছয় বছরের কর্মহীনতা ও আইনগত ভাবে বয়স বেহিসাবের দায় কে নেবে?

নতুন আইনে বলা হয়েছে, চালকের সহকারীকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে। টেকসই মানবসম্পদ উন্নয়নের কৌশলগত লক্ষ্য হিসেবে আমরা দাবি করে আসছি বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বর্ধিত করার (যদিও দ্বাদশ পর্যন্ত ১৮ বছর বা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার মৌলিক সুবিধা নিশ্চিত করার দায় আছে রাষ্ট্রের)। অথচ একটা নতুন আইনে মাত্র পঞ্চম শ্রেণীর পরেই শিক্ষার্থীকে স্থায়ীভাবে কাজে উন্মুক্ত করার (শিশুশ্রম) আয়োজন করা হয়েছে। স্কুলকালীন বয়সে হেলপার হওয়া এ শিশু শ্রমিক কীভাবে চালক হতে শিক্ষাকে এগিয়ে নেবে? আসলে আইনটা একেবারেই একটা অদক্ষ মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্ম দেবে। এতে শিশুশ্রম ও দুর্নীতিকে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। বর্তমানের লাখ লাখ চালক, যাদের অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তাদেরও ভুয়া ও জাল শিক্ষা সনদ নেয়ার বাধ্যবাধকতা তৈরি করেছে। তৈরি করেছে নতুন আরেকটা ঘুষের শাখা। নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের এ ধরনের সস্তা ও উদ্দেশ্যহীন আইন তৈরির দৃষ্টান্তে খুবই লজ্জা বোধ করছি।
————————————-
সাজার অসামঞ্জস্যঃ
————————————-
ক. নতুন আইনে সাজার মেয়াদ বাড়িয়ে নির্ধারণ করে দেয়া হলেও অর্থদণ্ড নির্ধারণ করা হয়নি জানিয়ে বিগত মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘সিচুয়েশেনের ওপর নির্ভর করে অর্থদণ্ডের পরিমাণ নির্ধারণ করতে পারবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।’ একদিকে বাংলাদেশে জেল বছর ছোট, আসামিকে সুবোধ দেখিয়ে সাজা কমানোর ব্যবস্থা আছে, আবার আছে যেকোনো সাজা মওকুফের নির্বাহী ক্ষমতা। অন্যদিকে অনির্ধারিত অর্থদণ্ড রেখে ঘুষ-দুর্নীতি সহযোগে চালক ও মালিকপক্ষের একচেটিয়া সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। জেলে সাজার পরিমাণ বাড়ায়, অনির্ধাতির অর্থদন্ডের কারণে ঘুষ খোর প্রশাসনিক কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং পুলিশের ঘুষের বারগেইন পাওয়ার বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

খ. দুর্নীতি ও লুটের মডেলে বাস্তবায়িত অতি নিম্নমান রাস্তা, লাইসেন্সহীন অযোগ্য চালক, রাস্তার মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন বেপারোয়া গতি, ফিটনেসহীন ও দুর্ঘটনাপ্রবণ ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি, একই গাড়ির বিরামহীন চালনা, বেপরোয়া লাভে অধিক যাত্রী ও পণ্য বহনে মালিকপক্ষের চাপ, মাফিয়া রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঠিক রাস্তার উপরেই গড়ে ওঠা বৈধ-অবৈধ ব্যবসা, রাস্তা ব্যবহারের নাগরিক নৈরাজ্যসহ বহু কারণে সড়ক পরিবহন হয়েছে মরণফাঁদ। অথচ আইনে এসব পক্ষকে অব্যাহতি দিয়ে শুধু চালকের শাস্তির কথা বলা হয়েছে, যা অন্যায্য ও অগ্রহণযোগ্য। আবার দেখা যাচ্ছে, চালক ও হেলপারের দৈনিক সর্বোচ্চ শ্রমঘণ্টার বিধান, এমনকি পরিবহনের দৈনিক সর্বোচ্চ কর্মঘণ্টার বিধানও রাখা হয়নি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিষয়বস্তুর দিক থেকে আইনটি কাঠামোগতভাবেই ত্রুটিপূর্ণ।

————————————-
লাইসেন্স ব্যবস্থাপনা— ড্রাইভিং শিক্ষা ও লাইসেন্স প্রাপ্তিকে সহজ, সাশ্রয়ী ও প্রতিষ্ঠানগত ভিত্তি না দেয়াঃ
————————————-
দরকার ছিল অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাধ্যতামূলক শিক্ষার সঙ্গে সংঘাতে না গিয়ে আইনি কাঠামো তৈরি করা আর ড্রাইভিং শিক্ষা ও লাইসেন্স প্রাপ্তিকে সহজ, সাশ্রয়ী ও প্রতিষ্ঠানগত ভিত্তি দেয়া। দেশীয় রাস্তার সাইন ও কারিগরি ব্যবস্থার আলোকে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের মানসম্পন্ন অনলাইন-অফলাইন কারিকুলাম, শিক্ষণ পদ্ধতি নেই। বাস্তবতা হচ্ছে, রাস্তায় সাইনই নেই খুব একটা, নেই মোড়গুলোর প্রায়োরিটি নির্দেশনা, নেই গতি ব্যবস্থাপনা, নেই সার্ভিস লেন, মহাসড়কে ঢোকার বা বের হওয়ার লেন নেই, এমনকি নেই লেন পার্থক্যকারী লেনও; নেই ওভারটেক রেখাও। আইনে এ কারিগরি ব্যবস্থাপনাগুলো নিশ্চিত করার কথা বলা হয়নি। আইনে নেই তাত্ত্বিক (থিউরি) অনলাইন পরীক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তনের কথা। বেসরকারি এজেন্ট ও তৃতীয় পক্ষের যাচাইসাপেক্ষে ব্যবহারিক পরীক্ষা কাঠামো করা নিয়ে কোনো নির্দেশনা নেই আইনে।

অথচ বয়স ও শিক্ষা শ্রেণী বেঁধে দেয়ার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষা নেয়ার প্রযুক্তিগত স্বয়ংসম্পূর্ণ কাঠামো তৈরি করা (এবং সেই অনুযায়ী শিক্ষা কোর্স সাজানো)। আধুনিক ড্রাইভিং কোর্সে অন্তত চারটি বিষয়ে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষাদান ও মূল্যায়নের বিধান রাখা হয়। ক. সড়ক নিরাপত্তার ধারণা (রোড সেফটি) খ. ট্রাফিক সাইন ও সংকেত গ. প্রায়োরিটি (যেমন— ১. সবার আগে পথচারী, তারপর ইঞ্জিনবিহীন যান, তারপর গণপরিবহন এবং সব শেষে যাত্রী ও পণ্যবাহী। ২. তিন, চার বা পাঁচ রাস্তার মোড়ের প্রায়োরিটি) ঘ. গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ ও সমস্যা সমাধান (হ্যাজার্ড প্রটেকশন— ব্রেক ও এক্সিলারেশনের ব্যবহার)।

অন্যদিকে যানবাহনের ফিটনেস যাচাইয়ে কী কী পয়েন্ট বাধ্যবাধক থাকবে এবং দেশে কী কী পয়েন্টে অপরাধ ঘটে (যেমন স্পিড গভর্ন্যান্স মিটার টেম্পারিং, যানবাহনের উচ্চগতিসীমার সক্ষমতা, বয়স লুকানো) তা নিয়েও কোনো নির্দেশনা নেই। অর্থাৎ কাজের কাজ না করে করা হয়েছে ফাঁকফোকরে ভরা জোড়াতালির আইন। অর্থাৎ লাইসেন্স প্রদানের মাফিয়া চক্রকে উপড়ে ফেলে একটি সুন্দর স্বচ্ছ ও আধুনিক ব্যবস্থাপনা কাঠামো তৈরিতে আইনটির কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

————————————-
আইনের নিয়ন্ত্রণ ও প্রয়োগ কাঠামো আস্থাহীনঃ
————————————-
মোটরযান চালনাজনিত কোনো দুর্ঘটনায় গুরুতরভাবে কোনো ব্যক্তি আহত বা প্রাণহানি ঘটলে তা ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩০২ ও ৩০৪ ধারা অনুযায়ী অপরাধ বলে গণ্য হবে বলা হয়েছে। কিন্তু দণ্ডবিধির কোন ধারায় মামলা হবে তদন্ত কর্মকর্তা তা সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে নির্ধারণ করবেন। দুর্নীতি-ঘুষ ও তদবিরভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো এবং দুর্বৃত্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতির দেশে সড়কে অবিচার ও নৈরাজ্য জারি রাখার এটাই মূল আইনি পয়েন্ট। অতীত ও বর্তমান দেখে কোনোভাবেই এ আশা রাখা যায় না যে, তদন্ত কর্মকর্তা যথেষ্ট সৎ হয়ে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। ধর্ষণ মামলায় সর্বদাই যেমন মেয়েটির সম্মতি দেখানোর চেষ্টা হয়, তেমনি সড়কে সব অপমৃত্যুই শুধু ‘দুর্ঘটনা’ হয়ে উঠবে এ আইনে।

আইনের প্রায়োগিক দিককে স্বচ্ছ রাখতে, পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন আর মালিক সমিতির কাউকে সরকার ও সংসদীয় কমিটিতে রাখা যাবে না। এতে ক্ষমতার সংঘাত ও অবৈধ প্রভাববলয় তৈরি হবে। শ্রমিক ও মালিকের প্রতিনিধি যিনি, তাদের স্বার্থ দেখবেন তিনিই, যদি সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন তাহলে কোনো আইনই আর কাজ করবে না। তাই এ দিকগুলো সড়ক আইনে বিবেচনায় নিয়ে আসতে হবে।

প্রায় দুই যুগ ধরে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত দেশের প্রায় সব সম্মানিত নাগরিক পরামর্শ দিয়েছেন দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ির ফিটনেস যাচাই, দুর্ঘটনার তদন্ত ও মামলা দায়েরে শুধু ‘তদন্ত কর্মকর্তা’র ইচ্ছানির্ভর দুর্নীতি সহায়ক অবিচারের ব্যবস্থা বহাল না রেখে সেখানে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞ ও পেশাজীবীদের (সাবজেক্ট ম্যাটার এক্সপার্টদের) ভেটো ক্ষমতাসহ সংযুক্তি করার যৌক্তিক বিষয়ে। সাজা নির্ধারণেও মানা হয়নি নাগরিক দাবি। মাত্র কয়েক মাস আগে পাস হওয়া বিতর্কিত আইনে শুধু সামাজিক মাধ্যমে কটূক্তিকে অপরাধ বিবেচনা করে সর্বোচ্চ ১৪ বছর ও সর্বনিম্ন সাত বছর কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেয়ার বিধান আনা হয়েছে। আর একই সরকারেরই একটি নতুন আইনে সড়কে প্রাণহানিতে প্রতারণাপূর্ণ আইনি কৌশলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের শাস্তি এবং অনির্ধারিত অর্থদণ্ড রাখা হয়েছে। শাসকদের রাজনীতি সুরক্ষার বিপরীতে নাগরিকের প্রাণ সুরক্ষার দাম এতই নিতান্ত এ দেশে। সব মিলিয়ে আমরা দেখছি, নাগরিক মতামতকে চূড়ান্তভাবে তাচ্ছিল্য দেখিয়ে একটি ইচ্ছাকৃত ভুলে ভরা দুর্নীতিপ্রবণ দায়সারা ও লোক দেখানো আইন প্রস্তাবনা করা হয়েছে। হলফ করে বলা যায়, এ আইন নৈরাজ্য থামিয়ে সড়ক নিরাপদ করতে কোনোই ভূমিকা রাখবে না।

————————————-
দুর্নীতির কাছে আইন পরাজিতঃ
————————————-
বিআরটিএ অত্যন্ত হাস্যকর মানের ড্রাইভিং পরীক্ষা নিয়ে লাইসেন্স দিয়ে থাকে, যা এখনো ঘুষের বিনিময়ে পাওয়া যায়। বিআরটিএর গাড়ির ফিটনেস যাচাই মান ভয়ংকর পর্যায়ের নিম্ন। এই ধরনের মানহীন ফিটনেস পরীক্ষার কোনো সুফল নেই। তবে এর বাইরেও কিছু পরোক্ষ ব্যাপার আছে, যা একেবারেই অনালোচিত। এ রকম তিনটি ব্যাপার হলো:

১. যাত্রী ও পণ্যবাহী প্রতিটি বাহনে ব্যাপক চাঁদাবাজি। এর কারণে কম ট্রিপে অনিরাপদ সড়কে বেশি মাল ও যাত্রী পরিবহনের ঝোঁক প্রাধান্য পায়। (উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৭ জুলাই একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বলছে, দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যেতে ৪৩৯ কিলোমিটার চলতে একটি ১০ টনের পণ্যবাহী ট্রাকে ২২ হাজার টাকা শুধু চাঁদাবাজি হয়। পাঁচ বছর পর অঙ্কটা আরও বাড়ার কথা।) এটাই নৌপরিবহনমন্ত্রীর ক্ষমতার উৎস। আর পরিবহন খাতটা তাঁর নিয়ন্ত্রণে থাকায় বিশাল শ্রমিক বাহিনীকে জিম্মি করে তিনি সরকারের কাছেও অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন।

২. দুর্নীতি ও অধিক চুরি নিশ্চিত করতে সড়কের লেন চুরি হয়েছে সর্বকালেই। বড় বড় আধুনিক যাত্রী ও পণ্যবাহী বাস-ট্রাকের উপযোগী লেনের স্পেস এবং ভার বহন সক্ষমতা কম। প্রয়োজনের সঙ্গে সমন্বয় করে রাস্তায় প্রশস্ত লেন, সহনীয় বাঁক, সমতল পিঠ নির্মাণ করা হয় না। রাস্তার বাঁক বৈজ্ঞানিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি, নেই সঠিক ও পর্যাপ্ত সড়ক সংকেত। নির্মাণসামগ্রী নিম্নমানের, পিচে নিম্নমানের বিটুমিন দেওয়া হয়, যাও আনুপাতিক হারে দেওয়া হয় না। অতি নিম্নমানের ইট ব্যবহৃত হয়। অতি চুরির কারণে রাস্তায় গর্ত হয় প্রচুর, রাস্তার উপরিতল বেশ উঁচু-নিচু। মহাসড়কে ঢোকা ও বের হওয়ার জন্য আলাদা লেন নেই, রাস্তায় সার্ভিস লেন নেই, নেই বাস বা ট্রাকের স্ট্যান্ড, একেবারে সাইডের লেন ওঠানামার জন্য প্রশস্ত নয়। নেই নিম্নগতির বাহনের জন্য আলাদা রাস্তা, চুরি করতে গিয়ে রাস্তা প্রশস্ত না করে হাঁটার জায়গাও পিচঢালা পথে দখল হয়ে পড়ে।

৩. সড়ক ধারণ ক্ষমতার ধারণা বাস্তবায়িত নয় একেবারেই। যেনতেন মানের ইট ও বালু দিয়ে ১, ৩ ও সর্বোচ্চ ৫ টন ধারণ ক্ষমতার যানবাহনের জন্য সড়ক বানানো হয়, অথচ টাটার ট্রাকই ১৫ টন বহনে সক্ষম। রাস্তায় জ্যাম, সেতুতে টোলের কারণে ট্রাকচালক ও মালিক ৫ টনের কথা বলে ১২ থেকে ১৫ টন বহন করেন। এটা মালিক-চালকের একতরফা সমস্যা নয়, বরং অদূরদর্শী অবকাঠামো, বাস্তবায়নকারীদের চুরি ও ব্যক্তির ব্যবসায়িক লাভের চাহিদা ইত্যাদি বহুমাত্রিক হীনতার প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক আচরণের মিশ্রণ। যানবাহনের ভারের অনুপাতে ভিত্তি তৈরি না থাকার ফলে পিচের নিচের মাটি উঁচু-নিচু হয়ে ও বড় বড় গর্ত তৈরি করে মরণফাঁদ তৈরি করে রাস্তায় রাস্তায়।

————————————-
চালকেরাও ভালো নেইঃ
————————————-

ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদানের স্টান্ডার্ড অনলাইন-অফলাইন কোর্স কারিকুলাম, শিক্ষণপদ্ধতি, বেসরকারি এজেন্টভিত্তিক প্রক্রিয়া প্রণয়ন করা করা হয়নি, করা হয়নি মানসম্মত পরীক্ষাপদ্ধতি প্রবর্তন। শিক্ষাহীন, কর্মহীন কিশোর-যুবক দীর্ঘদিন হেলপারি করে পেটেভাতে ঠেলা-গুঁতা খেয়ে ড্রাইভিং শেখে, কিন্তু রাস্তার সংকেত বোঝার বাধ্যবাধকতা তার থাকে না। অর্থাৎ অতি নিম্নমানের রাস্তায় অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা নেওয়া চালক নিজেও বড্ড নিরাপত্তা ঝুঁকিতে গাড়ি চালান।

যানজটে ব্যয়িত শ্রমঘণ্টা এবং পণ্য নষ্ট। ফলে একই পরিবহন (বাস, ট্রাক) দিয়ে চাঁদাবাজি এবং যানজটে ব্যয়িত ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে নির্দিষ্ট সময়ে বেশি ট্রিপ দিতে বাধ্য হন চালক। এতে করে এমনিতেই অনিরাপদ সড়কে যেনতেনভাবে ফিটনেসহীন গাড়ি চালিয়ে, একটানা অতি সময় ঘুমহীন শ্রান্তভ্রান্ত চালককে গন্তব্যে পৌঁছার আর্থিক, মানসিক ও স্বাস্থ্যগত তাড়নাগুলো তাড়িয়ে বেড়ায়। পরিবহনশ্রমিকেরা ব্যাপক গরম, দীর্ঘ যানজট, অধিক ট্রিপের বাধ্যবাধকতা, অনিয়মিত কিংবা স্বল্প আহার, মালিকের গালিগালাজ, যাত্রীর ভিড় ও ভাড়াসংক্রান্ত টানাপোড়েন, অধিক ভাড়া আদায়ের চাপে ফলে হররোজ লম্বা সময়ের অবসরহীন একটানা পরিশ্রমের ক্লান্তি দূর করতে ব্যাপকভাবে মাদক ও ইয়াবার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। সব মিলে আমাদের সড়ক প্রাণহানির এক সাক্ষাৎ উপকরণ। নাগরিক যেন জান হাতে নিয়ে যানে ওঠেন।

————————————-
পরিবহণ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে মাফিয়া তন্ত্রঃ
————————————-

যোগাযোগের বেলায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে আছে পরিবহন খাতে মাফিয়াতন্ত্রের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হওয়া। এই মাফিয়াতন্ত্র কার্যকর আইন প্রণয়ন, তদারকি ও শাস্তিদানের ব্যবস্থার সামনে বড় বাধা হয়ে আছে। প্রথম আলোর সংবাদে বলা হয়েছে, পরিবাহন খাত সরকারের মন্ত্রী, সাংসদসহ, জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের নেতা এবং তাদের আত্মীয়দের কবজায়। ‘ক্ষমতার ছায়ায় থাকা চালকেরাও হয়ে ওঠেন বেপরোয়া’। সংবাদেই সত্যটা প্রকাশিত: ‘রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা, সদস্যরা বেনামে পরিবহন ব্যবসায় যুক্ত হওয়ায় রাস্তায় আর কোনো আইনি নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে।’

————————————-
————————————-

আমরা বারবার বলছি, আগে রাস্তা চলাচলের উপযোগি করতে হবে, রাস্তা কারিগরি ভাবে গড়ে তুলতে হবে। ট্রাফিক সিগন্যাল শৃঙ্খলা আনতে হবে। গণপরিবহন মাধ্যম ঠিক করতে হবে। গণ পরিবহণে ব্যবহৃত শ্রমিকের মজুরি ও কর্ম ঘন্টার অসামঞ্জস্যতা গুলো দুর করতে হবে। চাঁদাবাজি নির্মূল করতে হবে। যানজট দুর করতে হবে।

তার পর কঠিন শাস্তির আইন করে সেখানে অটোমেটিক নাম্বার প্লেট ভিত্তিক অর্থদন্ড নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ ওভারস্পীড, নিয়ম ভঙ্গ , সিগন্যাল অমান্য, ভুল যায়গায় লেন পরিবর্তন ইত্যাদিকে অটোমেটিক নাম্বার প্লেটে থাকা মালিকানার বিপরীতে সরাসরি ব্যাংক একাউন্ট থেকে কর্তন যোগ্য অর্থদন্ডের প্রসেস আন্ততে হবে। একই সাথে ঐ নাম্বার প্লেটের মূল চালকের পয়েন্ট কাঁটা যাবে, যা নেগেটিভ হলেই লাইসেন্স অটোমেটিক বাদ যাবে। শুধু দুর্ঘটনার বিপরীতে মামলার কাজ হবে।

নতুন ও পুরানো আইনের পার্থক্য হচ্ছে, নতুন আইনে জেল সাজার পরিমাণ কিছুটা বেশি, আবার অর্থ দন্ডের হিসেব অনির্ধারিত। যেখানে মামলাই হয় না, বা ঘুষ যোগে আপসরফা হয়, সেখানে মামলা কেন্দ্রিক আইনের সাজা বাড়লেই কি ,কমলেই বা কি? আইনের বাস্তবায়নের চর্চা যেখানে নেই, সেখানে ডিজিটাল সিস্টেম না প্রবর্তন করে, এনালগ মামলার প্রসেসে কি লাভ হবে?

ঘটনা যা হবে, দুতিন মাস পরিস্থিতির কিছু উন্নতি হবে। চালকেরা কিছুটা সাবধান থাকবেন। মন্ত্রী কাদের সাহেব বেশ বকাওয়াজ করবেন। এবং প্রাইম মিনিস্টার নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকারী সবাইকে ঝাঁঝ ও ঝাড়ি দিয়ে কিছু কথা শুনিয়ে দিবেন। এম্পিরা কিছু বাহবা নিবার সুযোগ নিবেন। তার পরে সব স্বাভাবিক হয়ে আগের অবস্থায় পৌঁছাবে, যে লাউ সেই কদু।

তবে একটা বিপ্লব হবে, তা হচ্ছে নতুন সড়ক আইন আরো বেশি টাকা খাওয়ার একটা কার্যকর টুল হয়ে উঠবে। টেকনিক্যালি রাস্তা ঠিক না করে, ফিটনেস সিস্টেম সেন্সিবল না করে, ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট প্রসেস ঠিক না করে, মাফিয়া গুন্ডাদের কাছ থেকে গণপরবহন অবমুক্ত না করে, শুধু চালক হেল্পারের শাস্তি বাড়ালে আসলে পুলিশের এবং সড়ক পরিবহণ কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের ঘুষের বারগেইন পাওয়ার বাড়াবে, অন্য কোন অর্জন আসবে না দীর্ঘ মেয়াদে।

– ফাইজ তাইয়েব আহমেদ