শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঘুরে এলাম। প্ৰাক্তন অনেক সহকর্মীদের সাথে প্রায় ১৫ থেকে ২০ বছর পর দেখা। নিজেদের ব্যস্ত জীবন থেকে খানিকটা সময় বের করে কষ্ট করে গেস্ট হাউসে এসে দেখা করতে আসা সত্যিই একটা বিরাট পাওয়া। যাহোক লালাখাল যখন বেড়াতে যাই তখন আমাদের সাথে কিছু ছাত্রছাত্রী ছিল। তাদের সাথে আলাপের এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলাম ওদের প্রথম বর্ষে কতজন ছাত্র ভর্তি হয়েছিল আর তাদের মধ্যে কতজন তাদের সাথে পাশ করল। শুনে আশ্চর্য হয়েছি। প্রায় ৪০-৫০% ছাত্রই তাদের সাথে পাশ করেনি। আমি ভেবেছিলাম এটা কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র। বুঝতে পারছেন আমাদের দেশের মেধার কি অপচয় হচ্ছে? কি কঠিন ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেদের যোগ্য প্রমান করে ভর্তি হয়। তারপর কেন এই অবস্থা? আজ পর্যন্ত এটা নিয়ে কোথাও কোন সিরিয়াস আলোচনা শুনিনি। আমরা শিক্ষকরা এর দায় কি এড়াতে পারি?
বিশ্বের অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এইরকমটি ঘটার সুযোগই নেই। ৫০ জন ছাত্রের মাঝে ৪-৫ জন পাশ না করতে পারলেই তুলকালাম কান্ড ঘটে যাবে। নানা ফোরামে এটা আলোচিত হতো এবং এর একটি বিহিত অবশ্যই হতো। এর পেছনের একটি বড় কারণ ছাত্ররা তাদের পছন্দের বিষয় পায় না। দ্বিতীয় কারণ শিক্ষকরা। আমি অনেক ছাত্রের সাথে আলোচনা করে বুঝেছি পদার্থবিজ্ঞান পড়ার প্রতি যতটুকু ভালোবাসা তৈরী হয়েছিল সেটার মূল কারিগর স্কুল কলেজের শিক্ষকরা। অধিকাংশকেই যদি জিজ্ঞেস করা হয় তাদের প্রিয় শিক্ষক কে? উত্তর হবে স্কুল কলেজের কোন শিক্ষক। বরং বিষয়ের প্রতি যতটা ভালোবাসা নিয়ে ভর্তি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সেটাকে হত্যা করে। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকই নিজেদের সরকারি শিক্ষক ভাবে যেন তারা সরকারি কর্মকর্তা। একবার চাকুরী হয়ে গেলে ঠেকায় কে? কোন কিছুই ঠেকে থাকে না। ফলে সরকারি ব্যাংক আর পোস্ট অফিসের কর্মকর্তাদের মতোই আমাদের শিক্ষকদের মানসিকতা।
ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের একটি প্রজেক্টের নাম IQAC! এই প্রজেক্টের আওতায় অনেক কমিটি হয়েছে, ওয়ার্কশপ হয়েছে, মিটিং হয়েছে। এইসবের মাধ্যমে লক্ষ কোটি টাকা পকেটস্থ হয়েছে। সেখানে শুনেছিলাম ছাত্র কর্তৃক শিক্ষকদের মূল্যায়ন করা হবে। ভেবে ছিলাম এই প্রজেক্টের কোন কিছু আমার ভালো না লাগলেও এই একটি এজেন্ডা আমার ভালো লেগেছিল। ভেবেছিলাম যাক। এইবার অন্তত শিক্ষকরা একটু জবাবদিহিতার আওতায় আসবে। কিন্তু কোথায় যেন এটা আটকে গেল। অনেক শিক্ষকের সাথে আলোচনা করে জানলাম অধিকাংশ শিক্ষকই এটা চায় না। আরে বাবা অধিকাংশ শিক্ষকতো অবশ্যই এটা চাইবে না। সব কিছু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে মাথা গুনে নেওয়া ঠিক না। সারা পৃথিবীতে এটা চালু আছে। ওরা কি সব বলদ? আমাদের অধিকাংশ শিক্ষকের ধারণা, ছাত্ররা এটা করার যোগ্যতা রাখে না। তাঁরা মনে করেন, ছাত্ররা রাজনীতি করে এবং এই মূল্যায়নে রাজনীতির প্রভাব পরবে। আবার ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার বিষয়ে ওই শিক্ষকদের মতামত চাইলে ওই একই শিক্ষক বলবে না ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা যাবে না। অনেক শিক্ষকের ধারণা শিক্ষকরা কঠিন করে পড়ালে শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে বাজে মূল্যায়ন করবে। অনেকের ধারণা শিক্ষকরা ভালো মূল্যায়নের জন্য প্রশ্ন সহজ করবে, বেশি নম্বর দিবে। কারা বলছে? যারা দুর্বল শিক্ষক! কারা বলছে? যাদের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল! কারা বলছে? যারা মনে করে তারা ভালো মূল্যায়ন পাবে না।
আমি মনে করি কিছু ছাত্র নানা কারণে সঠিক মূল্যায়ন করবে না কিন্তু এ ধরনের ছাত্রছাত্রী সংখ্যায় কম। এছাড়া আপনি যতই ভালো শিক্ষক হোন না কেন, কিছু শিক্ষার্থী আপনাকে কখনোই পছন্দ করবে না। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের শত শত বই আছে। ১০০ জন ছাত্রকে যদি তাদের প্রিয় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বইয়ের নাম বলতে বলা হয় সবাই কি একই বইয়ের নাম বলবে? প্রিয় শিক্ষক নিবাচনের প্যারামেটেরও একেক ছাত্রের একেক রকম হবে। কিন্তু আমাদের মূল্যায়ন করার সময় সকলের গড় বিবেচনাটা তুলে আনার সঠিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আছে। সেটা ব্যবহার করে বের করা সম্ভব। সারা পৃথিবীটা ছাত্রদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে সেরা শিক্ষক নির্বাচন করা হয়। এর মাধ্যমে শিক্ষকদের মাঝে ভালো শিক্ষক হওয়ার একটি সুষ্ঠ প্রতিযোগিতা হয়। এটা তখন একটু সুষ্ঠূ পরিবেশ। সারা পৃথিবীতে যদি এইসব চলতে পারে আমাদের এখানে কেন নয়। অনেকেই কারণ দেখায় আমরাতো ওদের মত না। এটা ভাবলেতো আমরা জীবনেও ওদের মত হবো না। আমরা ওদের মত না বলেইতো পরিবর্তনের মাধ্যমে ওদের মত হতে চেষ্টা করা উচিত। মনে রাখতে হবে যে যদি ৭০ ভাগ শিক্ষার্থী কোন শিক্ষককে বাজে রিভিউ দেয় তাহলে তার শিক্ষকতার কোনো সমস্যা আছে।
– কামরুল হাসান মামুন
অধ্যাপক
পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়