টেকনোলজি বাই দ্যা পিপল ফর দ্যা পিপল।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফেইসবুকে একটা খবর শেয়ার করলেন। একটা প্রতিযোগিতার খবর। উনি বিচারকের দায়িত্বে ছিলেন। প্রথম পুরস্কার যে পেল তার আবিষ্কার টি ছিল একটা বিশেষ পাম্প। এই পাম্প আপনার পানির ট্যাপে লাগিয়ে নিলে নলের মধ্যে আটকে থাকা পানি টুকু বের করতে পারবেন।
তো, এতে আবিষ্কারের ব্যাপারটি কোথায়?
এরকম একটা সিনারিও কল্পনা করুন। ভূমিকম্প জাতীয় কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে আপনার বাড়িটি ধ্বসে গেছে। আপনি ভেতরে জীবিত আটকা পড়েছেন। বাইরের সাহায্য ছাড়া বের হতে পারছেন না। একটু হলে ও বেশি সময় বেঁচে থাকা চাই।
বেঁচে থাকার জন্য অনেক কিছুই জরুরি, তবে সবচেয়ে জরুরি হল মনোবল আর খাবার। বিশেষ করে পানি। এখন প্রশ্ন হল বাইরে থেকে মনোবল, পানি এগুলো সাপ্লাই কে দেবে কিভাবে দেবে?
পানির পাইপলাইন নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে গিয়ে আপনার ঘরের পানি সরবরাহ বন্ধ। আপনার একমাত্র সম্বল হলো ট্যাপের নলে আটকে থাকা পানিটুকু। এখন এই পানিটুকু বের করা চাই।
ছেলেটির আবিষ্কারটি এখানেই। আপনার ট্যাপের সাথে লাগানো থাকবে এই ক্ষুদ্র পাম্পটি। এই পাম্পটি থাকার কারণে আপনি হয়তো কয়েক মিনিট, কয়েকঘন্টা, কয়েকদিন বেশি বেঁচে থাকতে পারবেন। ছুটির ঘণ্টা ছবিটির ছেলেটির কথা মনে আছে?
জাপানে একটি করে দুর্যোগ হয়, আর সেখান থেকে শিখে পরবর্তিটাকে মোকাবেলা করে। ১৯২৩ সালে টোকিওতে ভূমিকম্প হলো। মাত্রা ৭.৯ । মানুষ মরলো ১লাখ ৫,৩৮৫ জন । এর মধ্যে কতজন আগুনে পুড়ে মরেছে জানেন? ৯১ হাজার ৭৮১ জন। বুঝলেন দাদা, ৯০% এর কাছাকাছি।
তখন জাপানে কাঠের ঘর বাড়ি বেশি ছিল। গবেষকরা নেমে পড়লেন। আগুনের উৎপত্তিস্থল গুলো খুঁজে বের করে তা বন্ধ করার ব্যবস্থা করলেন। যেমন প্ল্যান তেমন কাজ। বিরোধী দল বাধা দিল না। পরবর্তিতে ক্ষমতায় এসে এই প্রজেক্ট বন্ধ ও করলো না।
প্রত্যেকটি গ্যাস মিটারের সাথে লাগানো হল একটা সিস্মো-সেন্সর। ভূমিকম্প টের পেলেই একটি ভাল্ব গ্যাস পাইপের মুখ আটকে দেয়। গ্যাসের চুলার মধ্যে ও লাগানো হল নূতন প্রযুক্তি।
১৯৯৫ সালের ভূমিকম্প হলো কোবে শহরে। মাত্রা ছিল ৬.৯। সর্বমোট মানুষ মারা গেল ৬ হাজার ৪৩৪ জন। এর মধ্যে পুড়ে মরেছে কত জানেন? এর সংখ্যা এতই নগণ্য যে কোথাও তার উল্লেখ নেই। অপ্রয়োজনীয় মৃত্যু গুলো টেকনোলোজি দিয়ে আটকে দিল।
টেকনোলজি ফর দ্যা পিপল বাই দ্যা পিপল।
কিন্তু ১৯৯৫ সালের ভূমিকম্প গবেষকদের চোখ কেড়েছে অন্য দিকে। ৪ লাখ বিল্ডিং ক্ষতিগ্রস্ত হল। ফ্লাই ওভার গুলো ধ্বসে পড়ে রাস্তা ব্লক হয়ে গেল। এম্বুল্যান্স, ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে সময়মত পৌঁছতে পারলো না। জীবিত আটকে পড়া মানুষ গুলো মরল ভয়ে, ঠাণ্ডায়, খাবারের অভাবে, পানির অভাবে।
আর্কিটেক্ট, সিভিল ইঞ্জিনিয়াররা নেমে পড়লেন। নূতন করে বিল্ডিং কোড তৈরি করলেন। লক্ষ্য করলেন, যে বিল্ডিং গুলো ধ্বসে পড়েছে তার অধিকাংশই ৬০ সালের আগের কোডে তৈরি করা। ভূমিকম্প-প্রুফ বিল্ডিং কোড ১৯৮১ সালে রিভাইস করা হয়েছিল কিন্তু সর্বত্র প্রয়োগ করা হয়নি। পুরনো বিল্ডিং গুলো ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্পের ধাক্কা সইতে পারলো না।
২০১১ সালের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৯.১। টোকিও শহরে আফটার শক গুলো ও ছিল ৭.৯ এর উপরে। উল্লেখ করার মত বিল্ডিং ধ্বসে পড়ার কোন খবর শুনিনি। টোকিও শহরে মৃত্যুর সংখ্যা শূন্য।
টেকনোলজি দিয়ে লক্ষ লক্ষ মৃত্যু আটকে দিল। সাবাস আর্কিট্যাক্টস, সাবাস সিভিল ইঞ্জিনিয়ারস।
টেকনোলজি ফর দ্যা পিপল বাই দ্যা পিপল।
১৯৯৫ সালের কোবে ভূমিকম্প কে নিয়ে সব ডিসিপ্লিনের গবেষকরা নেমে পড়লেন। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে মনস্তত্ত্ববিদ। চোখ নড়বড়ে করে দেয়ার মত পর্যবেক্ষন আর নব নব আবিস্কার। পানির ট্যাপ নিয়ে শুরু করেছি, ট্যাপের কাহিনি টুকুই বলি।
এক সময় পানির ট্যাপ খোলা আর বন্ধ করা হতো একটা নব ঘুরিয়ে। গরম পানি ঠাণ্ডা পানির জন্য ছিল আলাদা আলাদা ট্যাপ। নব ঘুরে দুই দিকে। চারটা ফাংসান (খোলা, বন্ধ, গরম পানি, ঠাণ্ডা পানি) একটা টু-ডিরেকশনাল নব দিয়ে কনট্রোল করা সম্ভব নয়। আবিষ্কার হলো একধরনের লম্বা লিভার (দণ্ড) ।
এই লিভারে চারটা ফাংশান। লিভারটাকে নীচে নামালে পানি পড়ে, ওপরে ওঠালে বন্ধ। ডান দিকে ঠাণ্ডা পানি বাম দিকে গরম পানি। কিন্তু ভূমিকম্পের ব্যাপারটি আমলে আনা হয়নি।
কোবে ভূমিকম্প থেকে একটা পর্যবেক্ষন হলো- ভূমিকম্পে উপর থেকে জিনিসপত্র পড়ে লিভারে লাগলে পানি পড়তেই থাকে, ঝড়তেই থাকে। এটা বন্ধ করার জন্য কোন রকেট বিজ্ঞান লাগেনা। শুধু লিভারটার ফাংশন টা উল্টো করে দিলেই হলো। উপরের দিকে ওঠালে পানি আসবে, নীচে নামালে বন্ধ।
১৯৯৫ এর পর নূতন ট্যাপ-নীতিমালা তৈরি হল। জাপানের বাসা বাড়িগুলোর ট্যাপ গুলো উপর-নিচ-ডান-বাম করে দেখেন।
এবারের ছাত্রটির পাম্প আবিষ্কার জাপানের ট্যাপ টেকনোলজিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেল। ছোট একটা কাজ- কত বড় ইমপ্যাক্ট- কতগুলো প্রাণ বাঁচতে পারে উপলব্ধি করতে পারছেন?
টেকনোলজি বাই দ্যা পিপল ফর দ্যা পিপল।
পৃথিবীতে ম্যানহোল তৈরি হয়েছে মানুষ গর্তে ঢুকে মেইন্ট্যানেন্স এর কাজ করার জন্য। শিশু পড়ে মরার জন্য নয়। দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। তবে উদ্ধারের প্রযুক্তি আমাদেরই তৈরি করতে হবে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে জিয়াদ, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের নীরব এর অপ্রয়োজনীয় মৃত্যু আমাদের অনেককেই সরব করেছে।
সরকার ও হয়েছে। এখন দরকার সরকারকে প্রযুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে আরো সাহায্য করা। সংশ্লিষ্ট লোকজনদের এম্পাওয়ার করা।
(১) এরকম একটা প্রযুক্তি প্রতিযোগিতা করলে কেমন হয়? তরুণরা এগিয়ে আসুক।
জিয়াদ এর ঘটনাটি হোক একটা উপাখ্যান। একটা ছেলে ম্যানহোলে পড়ে গেছে বলে মানুষ বলছে।
নিম্নলিখিত সমস্যা গুলোর বিজ্ঞানসম্মত সমাধান দাও-
(ক) ম্যানহোলে কি আসলেই শিশু আছে, কিভাবে ডিটেক্ট করবে ?
(খ) কত দূরত্বে আছে কিভাবে পরিমাপ করবে?
(গ) অল্প সময়ে, কোন ধরনের শারীরিক আঘাত না করে কিভাবে তোলা যাবে?
(ঘ) গর্তে পড়া শিশুটির সাথে কিভাবে যোগাযোগ করবে?
(ঙ) কিভাবে খাবার পাঠাবে – ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই টেকনোলজি গুলো আবিষ্কার করা, দমকল বাহিনিকে ট্রেইন করা হতে পারে তার পরবর্তি কাজ।
পুরস্কার হোক জাপানে এসে এদের ইমার্জেন্সি সার্ভিস গুলো পরিদর্শন করার সুযোগ।
(২) আমাদের অন্যান্য সমস্যা গুলোর ও একটা লিস্ট করতে চাই। একেকটা সমস্যা একেকটা প্রতিযোগিতা। প্রতি বছর হোক না ৩ টা ৪ টা প্রতিযোগিতা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গবেষণার টপিক হিসাবে নিবে একটা করে সমস্যা। তৈরি হবে একটা ভিন্ন ধরনের আর্কাইভ। “আমাদের সমস্যা আমাদের সমাধান”।
একদিন জাপানিরা ও একই ধরনের প্রতিযোগিতার আয়োজন করবে। পুরস্কার হবে বাংলাদেশে গিয়ে “আমাদের সমস্যা আমাদের সমধান” পরিদর্শন।