সালেহ হাসান নাকিবঃ

আমাদের এখানে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কোন কারণে একত্রিত হলে কোন না কোন প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের প্রসঙ্গ চলে আসে। এটা খুব একটা স্বাভাবিক ঘটনা। যদিও পঠনপাঠন এবং গবেষণা প্রসঙ্গে কোন ধরণের আলাপ আলোচনা হয় না বললেই চলে।

এটাও খুব স্বাভাবিক ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে, ক্লাবে অনেক শিক্ষক একত্রিত হন। রাজনীতি, বাজারদর, ফ্ল্যাটের স্কয়ারফিট, ইত্যাদি নিয়ে বহুত কথাবার্তা হতে দেখবেন। লেখাপড়ার বিষয়টি বাদ থাকবে। স্বাভাবিক ঘটনা।

১৯৯৮ থেকে ২০১০ পর্যন্ত কেম্ব্রিজের সাথে নিবিড় সম্পর্ক ছিল। হয় থেকেছি অথবা ইনভাইটেড স্কলার হিসেবে কিছু সময় কাটিয়েছি। এই দীর্ঘ ১২ বছরে কারো মুখে, একটি বারের জন্যও ভাইস-চ্যান্সেলর শব্দটি শুনিনি। আমি বাজি ধরে বলতে পারি কেম্ব্রিজের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, গবেষকদের মধ্যে বড় অংশটি জানেই না কে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য। জানার প্রয়োজন নেই। সকলে যেটা খুব ভালো করে জানে, তা হচ্ছে যিনিই উপাচার্য হন না কেন, তিনি হবেন সেরাদের মধ্যে সেরা। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন এবং গবেষণায় উৎকর্ষতার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে চেষ্টা করবেন। এই ব্যাপারে সকলে আস্থাবান। কাজেই ব্যক্তিটি কে তা জানার কোন প্রয়োজন পড়ে না।

১৯৯৮ থেকে ২০১০ পর্যন্ত কেম্ব্রিজে তিনজন ভাইস-চ্যান্সেলর ছিলেন। কেম্ব্রিজে থাকাকালীন তাদের একজনের নামও জানা ছিল না। দেশে ফিরে যখন দেখলাম এখানে উপাচার্য বিষয়টি মুখরোচক আলোচনার বিষয় তখনই কেবল একটু আগ্রহ জন্মে ছিল। ১৯৯৬ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত ভাইস-চ্যান্সেলর ছিলেন ব্যারন আলেক ব্রোয়ের্স। পৃথিবী বিখ্যাত ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ইলেকট্রন-মাইক্রোস্কোপ বিষয়ে শ্রেষ্ঠদের একজন। এরপর ছিলেন ডেইম অ্যালিসন রিচার্ড (২০০৩ – ২০১০)। তিনি একজন বিশ্ববিখ্যাত অ্যানথ্রোপোলোজিস্ট। ২০১০ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ছিলেন স্যার লেসেক ব্রয়সেভিচ। তিনি একজন বিশ্বখ্যাত ইম্যুনোলোজিস্ট। এরা কেউ উপাচার্যপদটি ‘পাওয়ার জন্য’, ‘শিক্ষক রাজনীতি’তে নাম লেখান নি। পত্রিকায়, টকশোতে সরকারের পক্ষে গলাবাজি করেন নি। কেম্ব্রিজ তাদের খুঁজে বের করে উপযুক্ত স্থানে অধিষ্ঠিত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং পদ দুটোই সম্মানিত হয়েছে। তারা কাজ করে গেছেন, নিভৃতে। কারো তাদের নাম জানার প্রয়োজনটুকু হয় নি। এই মুহূর্তে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্টিফেন টুপ। ভদ্রলোক আন্তর্জাতিক আইনের একজন সেরা অথরিটি। কিছু দিন পর পর ইমেইলে বিশ্ববিদ্যালয় কেমন চলছে সেটা জানান। একজন অ্যালামনাস হিসেবে এই ইমেইল কিছুদিন পর পর পাচ্ছি। সব সময় খুলে দেখার সময় হয় না।

ইতালির ট্রিয়েস্তে শহরে অবস্থিত আব্দুস সালাম ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স একটি ইউনিক ইন্সটিট্যুশন। ২০০৯ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছর সেখানে গিয়েছি। এই প্রতিষ্ঠানটির ডিরেক্টর পদটি অত্যন্ত সম্মানজনক। বর্তমানে ডিরেক্টর হচ্ছেন ড. ফার্নান্দ কুয়েভেদো, একজন স্ট্রিং থিয়োরিস্ট। ভদ্রলোক সেন্টারের ছাত্র, বিজ্ঞানী, কর্মচারী, ক্লিনারদের সাথে বাসে করে সেন্টারে আসেন। কখনো সিট পান, কখনো পান না। ক্যান্টিনে ডিপ্লোমা স্টুডেন্টদের পেছনে দাঁড়িয়ে খাবারের জন্য অপেক্ষা করেন। আর নিজের কাজটা করেন। কুয়েভেদো কেম্ব্রিজে ছিলেন। ছাত্র অবস্থায় তাকে দেখেছি, সাইকেল র‍্যাম্পে জায়গা না পেয়ে ঘুরে ঘুরে ফাঁকা জায়গা তালাশ করতে।

এইবার একটা অন্য গল্প বলি। বহু বছর আগে, আমার ছোট ভাইয়ের বিয়ের দাওয়াতপত্র নিয়ে একবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি উপাচার্য বেশ কিছু শিক্ষকসহ গভীর আলোচনায় মগ্ন। আলোচনার বিষয় হচ্ছে কোন একটি ভোজসভায় মেন্যু কি হবে। খাসির টিকিয়া না মাছের কাবাব।

এই দেশে উপাচার্যরা প্রায় কখনোই সাঙ্গপাঙ্গ ছাড়া থাকেন না। এই সাঙ্গপাঙ্গরা প্রশাসনের বিভিন্ন লোভনীয় পদগুলো দখল করে থাকেন। সব আমলে এটা একটা কমন প্র্যাকটিস। স্বাভাবিক ঘটনা। কিছু দিন আগে দেখলাম দেশের প্রধান একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর দশ টাকায় ক্যান্টিনে কি কি পাওয়া যায় তা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ বয়ান দিচ্ছেন। তার কণ্ঠ আর দেহভঙ্গিমা থেকে গর্ব উপচিয়ে পড়ছে। স্বাভাবিক ঘটনা। একেবারে উপযুক্ত স্থানে উপযুক্ত ব্যক্তি।

এই যে চারিদিকে ঘটে যাওয়া স্বাভাবিক ঘটনাগুলো, এ থেকেই বোঝা যায় আমরা কতটুকু অস্বাভাবিক, নষ্ট আর নোংরা পরিবেশে বাস করি। সব ধরণের অসুস্থতা আর অস্বাভাবিকতা এখন আমাদের কাছে খুব স্বাভাবিক বলে মনে হয়।

লেখকঃ অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়