আমার গ্রামের এক সাবেক দরিদ্র মহিলা আমাকে বলেছিলেন, ‘জীবনে কোন দিন ৫শ টাকার নোট চোখে দেখি নাই, সেই সময় সেই আমাকেই গ্রামীণ ব্যাংক প্রথমেই ৫ হাজার টাকা লোন দিয়েছিল। ধান ভেনে চাল বিক্রি করে আমার পরিবারের অবস্থা ফিরিয়েছি। ছেলেদের বিদেশে পাঠাতে পেরেছি’। এরকম অনেকের জীবন বদলে দিয়েছে গ্রামীণ ব্যাংক মানে ড. ইউনুস।

আমার বন্ধুদের অনেকেই ইউনুসকে ঘৃণার চোখে দেখেন রাজনৈতিক কারণেই। এটা অধিক মাত্রায় শুরু হয় তিনি যখন একটি রাজনৈতিক দল করার উদ্যোগ নেন। নিজেদের সাজানো সাম্রাজ্য তছনছ হওয়ার ভয় পান অনেকে। তাঁকে সুদখোরও বলেন। তাঁকে আমার প্রিয় মানুষ মনে করি নোবেল পাওয়ার আগে থেকেই। তাঁর আত্মজীবনী প্রকাশ হয়েছিল ফ্রাঙ্কফুট বইমেলায়, যার মুখবন্ধ করেছিলেন প্রিন্স চার্লস! বইটি পড়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বেড়েছিল।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ফিরে না আসলেও সুখেই আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক হিসাবে ভালই থাকতেন। অনিশ্চিত বাংলাদেশে এসে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখনও তাঁর পরিবার চট্টগ্রামের অন্যতম ধনাঢ্য পরিবার। পাবিবারিক গাড়ি নিয়েই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেন। তাঁর অন্য দুই ভাইও কৃতী মানুষ- ড. মুহম্মদ ইব্রাহিম ও মুহাম্মদ জাহাঙ্গির।

অনেকের নিকট প্রশ্ন করি, এখনো কি এমন কেউ আছেন?

১। যে একটি গ্রামের দরিদ্র নারীদের বিনা সুদে এবং অর্থ ফিরে না আসার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও টাকা ধার দিবেন? বাহাত্তরে যোবরা গ্রামের নারীদের তিনি নিজের টাকা দিয়েছেন সাবলম্বী হওয়ার জন্য।

২। তাঁর কাছে বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষ আসতে থাকলে তিনি একটি সরকারী ব্যাংককে অনুরোধ করেন নারীদের ঋণ দিতে। ব্যাংকটি প্রস্তাব দেয়, যদি ইউনুস সাহেব জামিনদাতা হন তবেই ১০ লক্ষ টাকা ঋণ দেয়া হবে। ইউনুস সাহেব জামিনদাতা হয়েছিলেন। এদেশে আর কেউ কি হয়েছেন?

তাঁকে নিয়ে আজ অনেকেই লজ্জা পান, দালাল-সুদখোর বলে গালি দেন। যেন নোবেল বিজয় করে ড. মুহাম্মদ ইউনুস বাংলাদেশিদের নিদারুণ লজ্জায় ফেলে দিয়েছেন। বাঙালির জীবনে এর চেয়ে কষ্টের দিন বুঝি আর আসেনি। এখনো চোখে ভাসে তিনি নোবেল পাওয়ার পরে দুহাত প্রসারিত করা একটি ছবি যা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। তিনি দুহাত প্রসারিত করে বাঙালিকে বুঝাতে চেয়েছিলেন, আমাদের আশা-গর্ব বিশাল হয়ে উঠেছে। কিন’ আমাদের চোখে তা ছিল পীড়াদায়ক।

গত ব্রাজিল অলিম্পিক কমিটি ইউনুসকে দিয়ে অলিম্পিক মশাল হাতে হাঁটিয়ে আবরো বাঙালিকে কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন। দেশে হায় হায় রব উঠেছিল। অবশ্য রবীন্দ্রনাথও দীর্ঘদিন এ ভূখন্ডে নিষিদ্ধ ছিলেন। ক্ষুদ্রঋণকে বাস্তবায়ন করে ইউনুস যে সফলতার পথ দেখিয়েছিলেন সেই পথে হাঁটার জন্য ব্রাককে বাঙালি অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসায় অথচ ইউনুসের নাম উচ্চারণও আজ মহাপাপ বলে মনে হচ্ছে। অথচ গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার ব্রাকের চেয়ে কম।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা চালানো ইউনুসের কিছু অপরাধ তুলে দিচ্ছি-

১। দশম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন বিশ্বজাম্বুরিতে অংশ নিয়ে বিশ্ব ঘুরেছেন।
২। আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরি ছেড়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ফিরে এসেছেন দেশ গড়ার জন্য।
৩। নিজের পকেটের টাকা দিয়ে দরিদ্র মানুষদের মহাজনের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন এবং ওই সময়ে দরিদ্র মানুষদের ঋণের জামিনদার হয়েছেন।
৪। চাকুরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন।
৫। সামাজিক ব্যবসার ধারণা দেন বিশ্বকে এবং এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালাচ্ছেন।

বাঙালি হলো কাঁকড়ার মতো। একজন উপরে উঠলে অন্যরা পা ধরে টানাটানি করে নিচে নামায়। নামাতে না পারলে অন্তত গালাগালি করে।

ইউনুস একবার আমাদের আকাশলীন এডুকেশনে এসেছিলেন। আমরা বাচ্চাদের স্বল্প-বিনামূল্যে কম্পিউটার শেখাচ্ছিলাম। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড/উৎসব করতাম। রাষ্ট্রপতি বি. চৌধুরী এসেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ভিসি এসেছিলেন আমাদের অন্যান্য অনুষ্ঠানে। ড. হুমায়ুন আজাদ নিয়মিত আসতেন। তাঁকে যারা গালি দেন, তারা একটি যৌক্তিক কথাও বলতে পারেন না- কেন তাকে গালি দেন? ভিন্নমত রাখুন, অপছন্দ করুন সমস্যা নেই কিন’ অনেকে তাঁর জীবনই বিপন্ন করে দিয়েছেন, নিজের দেশে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা কষ্টকর করে দিয়েছেন।

গত শতাব্দির আশির দশকে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতেন, ইউনুস যদি দারিদ্র-বিমোচনে এতোই কাজ করেন তবে দেশে এতো দারিদ্রতা কেন? ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকার পতনের পরে যখন দেশের উন্নয়ন স্পষ্ট হতে থাকে তারপর কিন্তু কেউ এ প্রশ্ন আর করেন না। এখন দেশের কমিউনিস্টরাও গালি দেন, পুঁজিবাদীরাও গালি দেন।

আমাদের দেশে কেউ উপরে উঠলে অন্যরা বিভিন্নভাবেই গালি দিতে থাকেন। এই গালি দিয়ে তারা হয়তো অন্য কাউকে খুশি করতে চান বা আত্মতৃপ্তি লাভ করতে চান! এমন আত্মপ্রবঞ্চনা বাঙালি করতে পছন্দই করে। নিরোদ সি চৌধুরী বলেছিলেন, ‘আত্মঘাতি বাঙালি’।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ঠিকই বুঝেছিলেন। তিনি বলেছিলেন আরেক কাঠি সরসভাবে, ‘সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি’। ভূসুকুপাদ বাঙালি হওয়ার কথা নয় (হলেও সমস্যা নেই)। তিনি লিখেছেন, ‘তার বউকে নিয়েছে চণ্ডাল, তাই তিনি হয়েছেন বাঙ্গাল!’ ‘আজি ভুসুকু বঙ্গালি ভইলি (হইলি)’ পদটি শুনে আমরা প্রশ্ন করতেই পারি ‘ভুসুকু আজই কেন বাঙ্গালি হইল? এর উত্তরও তিনি দিয়েছেন পরের লাইনে।

কারণ তার বউকে চণ্ডালে ভাগিয়ে নিয়ে গেছে। অর্থাৎ যার স্ত্রীকে চণ্ডালে ভাগিয়ে নিয়ে যায় তার বাঙ্গালি হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। এখানে ‘বঙ্গালি’ বাতিল বা ব্রাত্য অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে। তাহলে কেউ যদি মানুষ হয়ে উঠে তাহলে তাকে বাঙালি কেন সহ্য করবে?

ক্ষুদ্র ঋণের প্রবক্তা হিসাবে তিনি অর্থনীতিতেও নোবেল পেতে পারতেন এবং পারেন, পারেন সামাজিক ব্যবসার ধারণার কারণেও। কিন’ নোবেল কমিটির একটি ভিন্ন মূল্যায়ন ছিল তাঁকে নিয়ে। তারা দেখেছে বিশ্বব্যাপী শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার অন্যতম কারণ দারিদ্রতা। সেই দারিদ্রতা দূর করতে পারলেই শান্তি আসবে। ড. ইউনুস এখন শান্তির দূতই হয়ে উঠেছেন বিশ্বব্যাপী।

– মজিব রহমান

ইউনুসকে নিয়ে আরো জানতে ভিজিট করুন https://engineersdiarybd.com/tag/dr-yunus/