কাউকে ডিমোরালাইজ করতে একদম চাচ্ছি না। চাই না কেউ নিরুৎসাহিত হোক। কিন্তু কিছু সত্য ও বাস্তবতা দিনের আলোয় আসা উচিৎ।

সত্য লুকিয়ে রেখে শেষ পর্যন্ত কারো কোন লাভ হয় না।

যেহেতু দেশজুড়ে এই সময়টাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রছাত্রী ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে, তাই পুরাতন কথাগুলো আর একবার একটু বলছি।

আমি চাই, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে, সুযোগ থাকলে, ছাত্রছাত্রীরা একটু ভেবে দেখুক।

যখন কেম্ব্রিজে ছিলাম তখন আমাদের গ্র্যাজুয়েট এবং আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট সুপারভিশন করতে হত। ল্যাবে এবং থিওরিতে। যে সব ছাত্রছাত্রী সুপারভিশন করেছি, তারা সবাই ফিজিক্স বলতে পাগল ছিল।

প্রবল আগ্রহ ছাড়া একজন ছাত্রছাত্রীও ক্যাভেনডিস ল্যাবে ফিজিক্সে পড়াশোনা করতে আসে নি। এরা নিঃসন্দেহে শুধু বিলেত বা ইউরোপ নয়, বরং সারা দুনিয়ার বিচারেই ফিজিক্সে সেরা আন্ডারগ্র্যাজুয়েট এবং গ্র্যাজুয়েট ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পড়ে।

তারপরেও এদের একজনের কাছেও ফিজিক্স খুব সহজ ছিল না। একদম কাছ থেকে এদের ফিজিক্স সত্যিকার অর্থে বুঝতে হিমশিম খেতে দেখেছি।

এটা স্বাভাবিক। অন্তর্গতভাবেই (intrinsically) পদার্থবিজ্ঞান কঠিন। যার কাছে সহজ মনে হয়, সে আসলে শেখাটা শুরু করতে পারে নি। পদার্থবিজ্ঞানের এসেন্সটাই ধরতে পারে নি।

পদার্থবিজ্ঞান একটু বুঝতে হলে গণিতে ভালো হতে হয়, যুক্তিবোধ প্রখর হওয়া প্রয়োজন, অ্যানালিটিক্যাল হতেই হবে, এক সমস্যা একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার দক্ষতা থাকা প্রয়োজন।

প্রকৃতিতে যে সব ঘটনা ঘটে তার ব্যাপারে সত্যিকারের কৌতূহল থাকতে হবে। এই সব গুণ ধারণ করা সহজ কথা না। বিশেষ করে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এই গুণগুলো নষ্ট করে দেওয়া হয় বিশেষ দক্ষতার সাথে।

বোঝানোর মত শিক্ষক নেই; স্কুল কলেজে ছাত্রছাত্রীদের না বুঝলেও চলছে। তারা উপযুক্ত না হয়েই অনেক নম্বরও পেয়ে গেছে। কাজেই অধিকাংশই ফিজিক্সে ঢোকার মত সামর্থ্য রাখেনা।

এই ঘাটতি কিছুটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পূরণ করতে পারত। কিন্তু সেখানেও বড় সমস্যা। নিয়োগ প্রক্রিয়া নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় এসেছে উপযুক্ত যোগ্যতা ছাড়া।

তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, ছাত্রছাত্রীদের একটি বড় অংশ নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিজিক্স পড়ছে।

অল্পকিছু ছাত্রছাত্রী ফিজিক্সে আগ্রহ নিয়ে ভর্তি হয়। এদের মধ্যে অনেকে আবার কয়েক বছরের মধ্যে পদার্থবিজ্ঞানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বিষয়টি অনেকের কাছেই খুব কঠিন মনে হয়।

স্কুল কলেজে যে ভাবে নম্বর পেয়ে অভ্যস্ত, তেমন নম্বর আর পাওয়া যায় না। শিক্ষকরা ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের পদার্থবিজ্ঞানে উৎসাহী বা উদ্দীপ্ত করতে পারেন না।

সব মিলিয়ে শতকরা সত্তর ভাগের মত সম্পূর্ণ ডিমোরালাইজড ছাত্রছাত্রী পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ধুকেধুকে তাদের শিক্ষা জীবন শেষ করে।

কেউ কেউ মাঝপথে ঝরে পড়ে। এর থেকে কষ্টের আর কিছু হয় না।

একজন শিক্ষক যিনি সত্যি সত্যিই পড়াতে চান, তাঁর জন্য এটা দুঃখজনক। তিনি জানেন, একটি বড় অংশের আগ্রহ নেই। ক্লাসে অনর্থক উপস্থিতি। কিন্তু এদেরকেই তাঁর পড়াতে হবে।

শিখতে চায় না, এমন কাউকে শেখাতে চাওয়াটার ভেতর অপমান আছে। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা এই বিষচক্রে আটকা পড়েছে। এভাবে আর যাই হোক উচ্চশিক্ষা হয় না।

সবচেয়ে বড় ভিক্টিম হচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। বহু লেস ডিমান্ডিং বিষয় আছে। এবং কোন বিষয়ই ছোট নয়। কাজ চালানোর মত বুঝতে সহজ, পড়তে সহজ, এমন কি চাকরীর বাজারও ফিজিক্সের চেয়ে অনেক ভালো সাবজেক্টের সংখ্যা কম নয়।

ফিজিক্সে দুর্বল ছাত্রছাত্রীটিও হয়ত ঐ সব বিষয়ে পড়লে সম্মানজনক ফলাফল করতে পারত। বাধ্য হয়ে ফিজিক্স পড়ছে। কী দুর্ভাগ্য!

শিক্ষক হিসেবে অসুখী, হতাশ আর বিষাদগ্রস্থ ছাত্রছাত্রী দেখা অত্যন্ত কষ্টকর। দেশের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগগুলোতে এই ধরণের ছাত্রছাত্রীদের এক মেলা বসেছে।

অথচ বয়স বিচারে এটাই তাদের জীবনের সেরা সময়। কী অপচয়!

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সময় এসে গেছে। ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীদের প্রতি একান্ত অনুরোধ – তোমরা যদি গণিতে ভালো না হও, ইংরেজিতে যদি দক্ষতা না থাকে, নিজে চিন্তা করতে যদি অভ্যস্ত না হও, যদি যৌক্তিক প্রশ্ন করার সামর্থ্য না রাখো, তাহলে প্লিজ বাধ্য হয়েও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পড়তে এসো না।

পরিশ্রম আর আগ্রহ ছাড়া শেখা হবে না।

শুধু সায়েন্স ফিকশন পড়ে যদি বিজ্ঞানের প্রতি ‘আগ্রহ’ জন্মায় তাহলেও চিন্তার কথা। আসল বিজ্ঞান একেবারেই অন্য জিনিস।

গাড়ির চাকার গতি, মেঝেতে গড়িয়ে যাওয়া পানি, নদীতে যে ঢেউ ওঠে, চিনি আর লবণের গঠন, গরম চায়ের ঠাণ্ডা হওয়া, ইত্যাদি সম্পর্কে আগ্রহ, ব্ল্যাক-হোল, হকিং রেডিয়েশন, হিগস্‌ বোস্‌ন, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে তোলা ছবি, অথবা আজগুবি টাইম ট্র্যাভেল নিয়ে দু’লাইনের উপলব্ধিহীন চটকদার ‘জ্ঞানের’ চেয়ে অনেক অনেক বেশি মূল্যবান।

প্রতিদিন আমাদের চারপাশে যে অতি সাধারণ ভৌত ঘটনাগুলো ঘটছে তা বোঝার তাড়না, প্রায় অর্থহীন কিছু সায়েন্স ফিকশন আর পপুলার সায়েন্স প্রসূত জার্গন (Jargon) নিয়ে মাতামাতির থেকে অনেক বেশি প্রয়োজন।

নিজেকে বোঝ। তারপর পদার্থবিজ্ঞান পড়তে আসো। সত্যিকারের আগ্রহ আর পরিশ্রমের মানসিকতা নিয়ে যদি আসতে পারো, তাহলে এর চেয়ে ভালো বিষয় আর কিছু হয় না।

কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার, জ্ঞানের প্রত্যেকটি শাখা মূল্যবান। প্রত্যেকটি বিষয়ের নিজস্ব সৌন্দর্য আছে।

কিছুটা অল্প পরিশ্রমে, মোটামুটি ভালো একটা ফলাফল করে যদি চাকরীর বাজারে ঢুকতে চাও, তাহলে পদার্থবিজ্ঞান থেকে দূরে থাকাই ভালো।

পদার্থবিজ্ঞান আমার জীবনে সবচেয়ে ভালবাসার একটি জায়গা। তারপরেও আমি বারবার বলব – আগ্রহ এবং সামর্থ্য ছাড়া এই বিষয়টি বেছে নিও না।

জীবন অনেক সুন্দর, অনেক মূল্যবান, অনিচ্ছা আর অপছন্দ নিয়ে পদার্থবিজ্ঞান পড়া কারোরই পোষাবে না। অনিচ্ছা আর অপছন্দ নিয়ে আর যাই হোক, পদার্থবিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষা হয় না।

– সালেহ হাসান নাকিব
অধ্যাপক
পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ভর্তি তথ্যের জন্য যোগ দাও Undergraduate Admission Help Group