নতুন যেকোনো বিষয়ে অনেকের মাঝে ভীতি কাজ করে, কাজ করে দ্বিধাদ্বন্দ্ব। যদি তা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার বিষয় নির্বাচন, তাহলে তো কথাই নেই। তাও আবার একজন মেয়ে হয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া?

মেয়েদের একটা আনকোরা বিষয়ে ভর্তির চ্যালেঞ্জটা ঠিক কি রকম ছিলো? সর্বপ্রথম ব্যাচ হিসেবে অভিজ্ঞতাই বা কেমন ছিল? কিভাবে ঠিক করেছি নিজের জীবনের গন্তব্য?

সেই গল্পই বলছি আজ।

আমার শিক্ষাজীবনের শুরুটা হয় মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইন্সটিটিউটে। এরপরে বিসিআইসি কলেজ থেকে উচ্‌চ মাধ্যমিক পড়াশুনা শেষ করে ইচ্ছা ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার‌। বুয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেই‌। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হওয়ায় সিদ্ধান্ত নেই সেখানেই স্নাতক সম্পন্ন করবো। আইআইটি ইন্সটিটিউট হিসেবে বেশ পুরোনো হলেও আমাদের সময়েই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়টি প্রথম চালু হয়, তাও আবার আমাদের ভর্তি চূড়ান্ত হওয়ার ঠিক আগে। এর আগে সারা বাংলাদেশে ক‌োথাও এই বিষয়ে পড়ার সুযোগ ছিলো বলে আমার জানা নেই। নতুন বিষয়, তাই হালকা দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও নিজের আগ্রহ আর পারিবারিক সিদ্ধান্তের মেল বন্ধনে সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে ভর্তি চূড়ান্ত করে ফেলি আইআইটির সর্বপ্রথম ব্যাচের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে।

যেহেতু আমরাই প্রথম ব্যাচ তাই কিছুটা সমস্যায় পড়ার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমাদের শিক্ষকদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিল একই সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সন্তানতূল্য়, যাদের কাছে নির্দ্বিধায় যাওয়া যেতো যেকোনো সমস্যায়। আর মাথার উপর ছিল আগে থেকে চলা এমআইটি প্রোগ্রামের সিনিয়র ভাইয়া-আপুদের ছায়া। তাই পথচলার শুরুটা হয় মসৃণ ভাবেই।

তখন একটাই ল্যাব আমাদের পিজিডিআইটি প্রোগ্রামের ভাইয়া-আপুদের সাথে ভাগাভাগি করে কাজ করতে হতো, তখনকার পুরনো ধাঁচের কম্পিউটারগুলোতে কাজ করতেও প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। এরই মাঝে ধীরে ধীরে প্রোগ্রামিং এর প্রতি ভালোবাসা গড়ে উঠে, প্রবেশ করি প্রোগ্রামিং জগতের আরো গভীরে। প্রোগ্রামিং নিয়ে আগে থেকে কোনো ধারণা ছিলো না, তাই শুরুতে কিছু সমস্যা হলেও দ্রুতই তা কাটিয়ে উঠি। সেকেন্ড ইয়ারের শেষের দিকে প্রথম হাতেখড়ি হয় প্রোগ্রামিং কন্টেস্টে। অর্জন হিসেবে ঝুলিতে আসে ২০১১ সালে আয়োজিত মেয়েদের প্রোগ্রামিং কন্টেস্টে ৬ষ্ঠ স্থান। পরবর্তীতে বিভিন্ন সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কন্টেস্টেও অংশগ্রহণ করি।

আমাদের সময়ে থার্ড ইয়ারে ইন্টার্ন করতে হতো। আমি তখন M & H Informatics এ ইন্টার্ন করার সুযোগ পাই, সেখানেই প্রথম কর্পোরেট দুনিয়ার সাথে পরিচয়। ফোরথ ইয়ার থেকে গবেষণার ব্যপারে জানতে পারি নানা তথ্য এবং তখন থেকে গবেষণা ক্ষেত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ি।

স্নাতক শেষ করার পর পরই স্নাতকোত্তরে ভর্তি হয়ে যাই। সেসময়ে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গবেষনার কিছু সুযোগ হয়। স্নাতকোত্তর শেষ করার পর কিছুদিন চাকরি করি এবং এরপর ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি (IUT) তে যোগ দেই। আমার মতে, যারা ভবিষ্যতে অ্যাকাডেমিতে যোগ দিতে চায় তাদের জন্য চাকরির অভিজ্ঞতা খুব জরুরি, কারণ একজন সুপারভাইজারকে নিজের যোগ্যতা বুঝাতে এই অভিজ্ঞতা থাকাটা বেশ কাজে দেয়। পাশাপাশি চাকরিতে একটা ডেডলাইনের মধ্যে প্রজেক্ট সাবমিটের চাপ থাকে, থাকে একটা দলে কাজ করতে পারার যোগ্যতা। এ বিষয়গুলো আরও ভালো অ্যাকাডেমিসিয়ান হয়ে উঠতে সাহায্য করে।

যদি আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়, “কেন কর্মক্ষেত্র হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছেন?” তাহলে আমি বলবো, শিক্ষকতা এবং চাকরির চ্যালেঞ্জ পুরোপুরি আলাদা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে শিক্ষকতা করা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিলো, কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ আমি উপভোগ করেছি। এছাড়াও আমার মনে হয় শিক্ষক হিসেবে নিজের ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্স বজায় রাখা তুলনামুলক সহজ, এটাও একটা কারণ শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়ার পিছনে।

শিক্ষাজীবন হোক অথবা কর্মজীবন, আমাদের সমাজে মেয়েদের কিছুটা কাঠখড় পোড়াতেই হয়। তাই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, যেকোনো পরিস্থিতিতে এই বিশ্বাস ধরে রাখতে হবে যে সব সমস্যারই সমাধান আছে, আর ধরে রাখতে হবে আত্মবিশ্বাস।

আমার বিশ্বাস, অন্যকে কিছু শিখাতে চাইলে আগে নিজের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে হয়। সে প্রচেষ্টাতেই বর্তমানে আমি পিএইচডি করছি ইউনিভার্সিটি অফ আলবার্টাতে। আমার আশা দেশে ফিরে নিজের অভিজ্ঞতালদ্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে আরও অনেক অবদান রাখতে সক্ষম হবো।

Tajkia Rahman Toma
BIT 1st Batch, IIT DU
Assistant Professor, IUT
Doctoral Student, University of Alberta