গত কয়েক দিন ধরে কিছু ফেইসবুক বন্ধু একজন ভারতীয় নাগরিক, অজয় শর্মার ‘নিউটনের তৃতীয় সূত্র’ ভুল, এমন দাবীর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। অজয় শর্মা নিজেকে বিজ্ঞানী বলে দাবী করেন এবং কিছুদিন আগে তার দাবীর সপক্ষে একটি প্রবন্ধ পাবলিশ করেছেন।

মনে পড়ছে, বছর খানেক আগে বাংলাদেশী একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক একই ধরণের দাবী করেছিলেন।

তিনি অবশ্য প্রবন্ধ ট্রবন্ধ পাবলিশের দিকে হাঁটেন নি। এসব নিয়ে বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্রকে দেখছি বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তে – এই মহা আবিষ্কারের কৃতিত্ব কে পাবে, বাংলাদেশ না ভারত? কেউ কেউ বেশ হতাশ, ভারত শক্তি ও গায়ে গতরে বড় হওয়ায় কৃতিত্ব ছিনিয়ে নেবে বলে তাদের বিশ্বাস। আরো একবারের মত বাংলাদেশ তার প্রাপ্য গৌরব থেকে বঞ্চিত হবে!

অজয় শর্মার পেপারটি আজ পড়েছি। Interpretation of the Principia’s Third Law of Motion শীর্ষক এই প্রবন্ধটি International Journal of Engineering Research and Application নামে একটি অন-লাইন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে predatory journal। এই সব জার্নালে কি প্রকাশিত হয় তার একটু খোঁজ খবর রাখি।

তবে অজয় শর্মার এই প্রবন্ধটি ইউনিক। এত মানহীন প্রকাশনা দেশি বটতলার জার্নালেও পাওয়া দুষ্কর। প্রবন্ধটির সমস্যা কোথায় তা নিয়ে লিখতে চাচ্ছি না। বরং কতগুলো সাধারণ বিষয়ের অবতারণা করতে চাই। শিক্ষা যেখানে মানহীন, সেখানে সাধারণ বিষয়গুলো অসাধারণ হয়ে ওঠে।

নিউটনের তৃতীয় সূত্র হচ্ছে ভরবেগের নিত্যতার সূত্রের একটি alternative statement। এই সূত্রের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে ভরবেগের নিত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। যদি অ্যাকশন (ল্যাগ্রাঞ্জিয়ানকে সময়ের সাপেক্ষে ইন্টেগ্রেট করলে পাওয়া যায়) নিরবিচ্ছিন্ন সরণের ফলে অপরিবর্তিত থাকে তাহলে ভরবেগ সংরক্ষিত হবে। ইংরেজিতে বলা যায় –

If the action remains invariant with respect to continuous displacement in space, the momentum will be conserved

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, এখানে ভরবেগের নিত্যতা অথবা সংরক্ষণশীলতার সাথে প্রতিসাম্যের (translational symmetry in space) একটি নিবিড় সম্পর্ক। কাজেই নিউটনের তৃতীয় সূত্র মামুলি কোন ধারণা নয়। এর সাথে সম্পর্কিত একেবারে ফান্ডামেন্টাল লেভেলে প্রাকৃতিক ঘটনাবলী, যা প্রতিসাম্যর মত মৌলিক ধারণার সাথে সংযুক্ত। তৃতীয় সূত্রে ভুল ধরতে হলে এই মৌলিক ধারণায় হাত দিতে হবে। বিষয়টি অত সহজ নয়।

প্রায়ই শোনা যায় – জ্বালানীবিহীন গাড়ি। এখানেও প্রশ্নটা না জ্বালানী নিয়ে, না নিয়ে গাড়ি। ঘটনা হচ্ছে, জ্বালানীবিহীন গাড়ি, তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্রের বরখেলাফ। প্রথম সূত্রটি হচ্ছে শক্তির সংরক্ষণশীলতার বয়ান। এই সংরক্ষণশীলতার সাথে জড়িয়ে আছে, সময়ের সাথে অ্যাকশনের অপরিবর্তিত থাকার ঘটনা। আবারো প্রতিসাম্য। এক্ষেত্রে

The action remains invariant with respect to continuous displacement in time

একেবারে পদার্থবিজ্ঞানের যে কাঠামো, তার গোড়ার কথা।

আইন্সটাইনের স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি ভুল। প্রায়ই পত্রিকার পাতায় দেখা যায়। রিলেটিভিটি দাঁড়িয়ে আছে তিনটি মৌলিক স্বীকার্যের উপর।

ইনার্শিয়াল ফ্রেইম অফ রেফারেন্সের ক্ষেত্রে স্পেইস-টাইম হচ্ছে homogeneous এবং isotropic, এবং এই ধরণের ভৌত কাঠামোতে, শূন্য মাধ্যমে, আলোর বেগ অপরিবর্তনীয় ও সর্বোচ্চ। কাজেই ভুল ধরতে গেলে প্রথমে হাত দিতে হবে এই মৌলিক স্বীকার্যগুলোতে। অত সহজ নয়।

আরেকটি চটকদার কথা হচ্ছে – কোয়ান্টাম মেকানিক্স ভুল। অসম্পূর্ণ বলার কিছু কারন আছে। কিন্তু ভুল বলা কঠিন। এই যে ল্যাপটপে বসে টাইপ করছি, এটা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রয়োগ। ইলেক্ট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রি পুরোপুরি দাঁড়িয়ে আছে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উপর। এমন অজস্র উদাহরণ। আক্ষরিক অর্থেই দিয়ে শেষ করা যাবে না। ভুল ধরতে গেলে এসব তো মনে রাখতে হবে।

মাম্বো জাম্বো বিজ্ঞানের কতগুলো সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কথা বলি। Rules of thumb। এই নিয়ম অনুসরণ করে অন্তত আমি কখনো ঠকি নি।

  • (১) এই সব ‘বিজ্ঞানীরা’ তাদের ‘মৌলিক গবেষণার ফলাফল’ সাধারণত একদল সাংবাদিকদের সামনে প্রেস কনফারেন্স করে প্রকাশ করেন যেখানে কোন প্রকৃত এক্সপার্টকে দেখা যায় না এবং
  • (২) সাংবাদিক সম্মেলন শেষে এরা প্রায় সব সময় সরকারের সহযোগিতা চেয়ে থাকেন। যেমন আজয় শর্মা ভারতের জন্য গর্ব বয়ে আনতে মাত্র ১৫ লাখ রুপি চেয়েছেন বলে খবরে প্রকাশ।

এসব নিয়ে এই দেশে যে উত্তেজনা, এমন কি বিজ্ঞানের ছাত্র এবং শিক্ষকদের মধ্যেও, তা প্রমান করে শিক্ষার মান এখানে কত নিচু।

– সালেহ হাসান নাকিব
অধ্যাপক
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ
রাবি

 


আমাদের সব পোস্ট সবার আগে পেতে নতুন পেজ সী ফার্স্ট করে রাখুন। পেজ লিংক এখানে ক্লিক করুন