বিসিএস এমন একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা, যার প্রস্তুতি নিলে বাকি সব চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি হয়ে যায়। দৈনন্দিন জীবনযাপন, পড়াশোনা, সময় ব্যবস্থাপনা—সব কিছু প্রস্তুতির শুরু থেকেই করতে পারলে পরে পরীক্ষার আগ মুহূর্তে আর ঝামেলা পোহাতে হবে না। পরামর্শ দিয়েছেন ৩৮তম বিসিএস অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত প্রণয় কুমার পাল। শ্রুতি লিখন করেছেন-এম এম মুজাহিদ উদ্দীন

বিসিএসের প্রস্তুতির শুরুর দিকে অনেকের মধ্যেই সিরিয়াসনেস দেখা যায় না। তাই মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—নিজেকে ‘পরীক্ষার্থী’ মনে করা। এই পরীক্ষাকে একাডেমিক পরীক্ষার মতো আবশ্যিক মনে করে সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে। বিসিএস সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা। তাই প্রার্থীকে অবশ্যই সিরিয়াস হতে হবে। এর জন্য শুরুতেই বইয়ের পড়াশোনার পাশাপাশি সময় ব্যবস্থাপনা, দৈনন্দিন জীবনযাপন—সব কিছুই প্রস্তুতির অনুকূলে আনতে হবে। অতিপ্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া অন্যান্য কাজ থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করতে হবে।

বন্ধু হোক প্রস্তুতির সঙ্গী

বিসিএসের জন্য বন্ধু নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমন কয়েকজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করুন, যাঁরা আপনার মতোই বিসিএস বা ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষার প্রার্থী; আর প্রস্তুতির দিক থেকেও তাঁরা অগ্রগামী। এসব বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিলেও ঘুরেফিরে প্রস্তুতিসংক্রান্ত বিষয়গুলোই উঠে আসবে। জটিল কোনো বিষয়বস্তু নিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। ভার্চুয়াল ক্ষেত্রে অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ ধরনের বন্ধু বেশ উপকারী। তাঁদের সঙ্গে প্রস্তুতির বিষয়বস্তু নিয়ে শেয়ার করুন, অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন। এতে পড়ার আগ্রহ বাড়বে, কঠিন বিষয়গুলোও খোলাসা হবে।

লক্ষ্য কী?

ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি স্যার এ পি জে আব্দুল কালাম বলেছেন, ‘স্বপ্ন তা নয়, যা তুমি ঘুমিয়ে দেখো, স্বপ্ন তা-ই যা তোমাকে ঘুমাতে দেয় না।’ কখনো ভাববেন না, বিসিএসে এত পরীক্ষার্থী, আমার কী হবে! মনে রাখবেন, যাঁরা বিসিএসে সফল হয়েছেন, তাঁরাও আপনারই মতো। তবে তাঁরা তাঁদের অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের ফলে সফল হতে পেরেছেন। আরেকটি কথা, যদি বিসিএসই আপনার প্রধান লক্ষ্য হয়, তাহলে অন্য কোথাও চাকরিতে ঢোকার আগে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিন। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বর্তমান চাকরির কারণে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতে বা প্রস্তুতি নিতে পারছেন না।

সফলদের গল্প অনুপ্রেরণা দেবে

একটি বড় স্বপ্ন দেখার জন্য কিছু স্বপ্নচারী সফল মানুষের গল্প শুনুন। কালের কণ্ঠ’র চাকরি আছে পাতায় বিসিএস ক্যাডারদের গল্প প্রকাশ হয়। এগুলো পড়তে পারেন। ফেসবুকে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। তাঁদের অনেকেই নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে প্রস্তুতিমূলক বিভিন্ন লেখা নিয়মিত পোস্ট করেন। আরেকটি কথা মনে রাখবেন—Successful and unsuccessful people do not vary greatly in their abilities. They vary in their desires to reach their potential. অর্থাৎ সফল বা ব্যর্থ ব্যক্তিরা সামর্থ্যের দিক থেকে খুব বেশি ভিন্ন হয় না। তাঁরা শুধু ভিন্ন হয় তাঁদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর আকাঙ্ক্ষায়। কথাটি বলেছেন মার্কিন লেখক, বক্তা ও যাজক জন ম্যাক্সওয়েল।

অবসর কাজে লাগান

একটানা পড়তে কারোরই ভালো লাগে না। তাই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কিছুটা অবসর বা বিনোদনও জরুরি।

আপনি এই বিনোদনগুলোকেও বিসিএসের সঙ্গে যুক্ত করতে পারেন। সে সময় আপনি ইউটিউবে বিসিএস সম্পর্কিত ভিডিও দেখতে পারেন, অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য শুনতে পারেন অথবা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বা বাংলা সাহিত্যকেন্দ্রিক মুভি দেখতে পারেন। আমার বিসিএস ভাইভায় কাঙ্গাল হরিনাথকে নিয়ে একটি প্রশ্ন করা হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে ‘মনের মানুষ’ চলচ্চিত্রের কথা আমার মাথায় আসে। সেখানে হরিনাথের একটি দৃশ্য আছে। প্রশ্নের উত্তরটি আমি ঠিকভাবে দিই।

তাই এ বিষয়গুলো প্রিলি, রিটেন, ভাইভা যেকোনো পরীক্ষায়ই আপনাকে সাহায্য করতে পারে। তাই এ ধরনের সুস্থ বিনোদন চর্চা করুন, যা আপনার বিসিএস প্রস্তুতির জন্য সহায়ক হবে।

পত্রিকা পড়ুন, আপডেট থাকুন

নিয়মিত পত্রিকা পড়ে আপডেট থাকুন। বাংলা ও ইংরেজি দুই ধরনের পত্রিকাই পড়ার চেষ্টা করবেন। পত্রিকা পড়ার অভ্যাস আপনার লেখার দক্ষতা, ভোকাবুলারি, অনুবাদ করার ক্ষমতা, ইংরেজি পড়ে দ্রুত বোঝার ক্ষমতা বাড়াবে। দরকারি তথ্য টুকে রাখার জন্য একটা নোট খাতা রাখুন, যেখানে আপনি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও শব্দ সুবিন্যস্তভাবে লিখে রাখতে পারবেন।

পড়ার টেবিলে মন বসান

বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে আমরা বিভিন্ন কিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ি। তাই আমাদের সময়ের একটা বড় অংশ সেগুলোর পেছনে চলে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষ করেও বিভিন্ন কিছুর সঙ্গে যুক্ত থাকায় একমনে পড়তে পারি না। আবার কেউ কেউ অতিরিক্ত টিউশনি করে পড়ার সময়ই পান না।

বিসিএস প্রার্থী হিসেবে আপনাকে সেগুলোর পেছনে অতিরিক্ত সময় দেওয়া থেকে বিরত থেকে পড়ার টেবিলে সময় দিতে হবে। বিসিএস শুধু মেধাবীদের জন্য নয়, বিসিএস ধৈর্যশীল ও পরিশ্রমী মেধাবীদের জন্যও। তাই পড়ার টেবিলে মন দিন আর পড়ার সময় যেন মনোযোগ বিঘ্ন না হয়, সে জন্য গেম কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অংশগ্রহণ কমিয়ে দিন।

প্রস্তুতিতে ইন্টারনেট কাজে লাগান

তবে হ্যাঁ, বর্তমান সময়ে ইন্টারনেট পড়ালেখার এক অনন্য সহায়ক, যদি এর সদ্ব্যবহার করি। যেকোনো বিষয়ে তত্ত্ব বা তথ্যের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করুন। বিসিএস প্রস্তুতিতে ইউটিউব ও গুগল আপনাকে দারুণভাবে সাহায্য করতে পারে।

গণিত, বিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি থেকে শুরু করে সব বিষয়েই আপনি এগুলো থেকে সাহায্য নিতে পারেন।

গুগল প্লেস্টোরে বিভিন্ন অ্যাপ পাওয়া যায়। গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো আলাদা নোট খাতায় বা বইয়ের পাশেই ছোট করে লিখে রাখতে পারেন; তাহলে পরবর্তীকালে রিভিশন দিতে সুবিধা হবে।

মোট কথা, বিসিএসে সাফল্য পেতে হলে আপনাকে বিসিএসকেন্দ্রিক একটা জীবনধারা তৈরি করতে হবে। যে চাকরিটা আপনি আগামী ৩০ বছর ধরে করবেন, যা আপনার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে, তার জন্য তো আপনাকে দু-তিনটা বছর পরিশ্রম করতেই হবে।

বিসিএসে না টিকলে?

বিসিএস নিয়ে গুরুত্ব দিতে পারেন, তবে একমাত্র লক্ষ্য মনে করাটাও ভুল হবে। বাংলাদেশে যত পরীক্ষার্থী বিসিএস পরীক্ষা দেন তার মাত্র ২ শতাংশ বিসিএস ক্যাডার হতে পারেন। তাই আপনার লক্ষ্য বিসিএস হলেও একই প্রস্তুতি নিয়ে অনান্য সরকারি চাকরির পরীক্ষাগুলো দিতে পারেন। ব্যাংকিং সেক্টরেও ক্যারিয়ার গড়ার দারুণ সুযোগ রয়েছে। বিসিএস পরীক্ষা পদ্ধতি দীর্ঘমেয়াদি, সে তুলনায় ব্যাংকের নিয়োগ কার্যক্রম কম সময়ে সম্পন্ন হয়।