বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো মেধা ধ্বংসের চারণভূমি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলো মেধা ধ্বংসের স্বর্গ রাজ্য। কত স্বপ্ন নিয়ে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। আর ভর্তি হওয়ার পর প্রথম বর্ষেই তাদের অনেককে খোঁড়া লুলা লেংড়া বানিয়ে দেওয়া হয়। লুলা লিঙ্গ খোঁড়া কেবল শারীরিকভাবেই না মেন্টাললিও হয়।

তারপর তারা আর দাঁড়াতে পারে না। প্রথমবর্ষের ছাত্ররা কি পরিমান টর্চারের মধ্যে দিয়ে যায় তা পৃথিবীর আর কোথাও কল্পনাও করা যায় না। একটি ঘুমানোর জায়গার জন্য রাজনীতির খাতায় নাম লেখাতে হয়, অতিথি রুমে টর্চারের শিকার হতে হয়, জোরপূর্বক মিছিল মিটিং এ যেতে বাধ্য করা হয়। এত কিছুর পরও শিফট করে ঘুমাতে হয়। অনেককে হলের বারান্দায় বা ছাদেও ঘুমাতে হয়।

প্রথমবর্ষে একটা পড়ার টেবিল পাওয়া স্বপ্নের মত। আর কাপড় রাখার একটা ওয়ার্ডরোব পাওয়াতো বহুত দূর কি বাত। খাওয়ার কথা, সাংস্কৃতিক চর্চা করা, ক্যাফেটেরিয়ায় আড্ডা দেওয়া বা খেলাধুলায় মত্ত থাকা ইত্যাদিতো অনেকরর জন্য একটা লাক্সারি।

শুধুই কি ছাত্র হিসাবে ঢুকে যারা তাদেরকেই এই দুর্গতিতে পরতে হয়? না। শিক্ষক হিসাবে ঢোকার পরও তাদের যেই বেতন এবং সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় তাতে একটা ভালো পরিবেশে থাকা খাওয়া প্রায় অসম্ভব। অনেকেই একটি থাকার জায়গার জন্য রাজনীতিতে নাম লেখায়। প্রভাষক হিসাবে নিয়োগের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বাসা পাওয়া যায় না। প্রভাষকদের বাসা পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো কোন হলের আবাসিক শিক্ষক হতে পারা। যা পেতে হলে তাকে শিক্ষক রাজনীতির সাথে যুক্ত হতে হয়। প্রভাষক হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার পর তাকে সর্বোচ্চ সংখ্যক ক্লাস লোড দেওয়া হয়। অথচ তার হওয়ার কথা একজন টিচিং এসিস্টেন্ট। যেই সময়ে সে প্রভাষক হিসাবে নিয়োগ পায় সেই সময়টাই পিএইচডি করতে যাওয়ার শ্রেষ্ট সময়। কিন্তু তখন তাকে পিএইচডির জন্য ছুটি দেওয়া হয় না। ছুটির জন্য তাকে ১ থেকে ২ বছর অপেক্ষা করতে হয়। ততদিনে রাজনীতি নির্বাচন করে অনেকে পিএইচডি করতে যাওয়ার যোগ্যতা এবং ইচ্ছে দুটোই হারিয়ে যায়। এরা হয়ে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বার্ডেন। এইভাবে শিক্ষক হিসাবে ঢোকার পরও মেধা ধ্বংসের ব্যবস্থা আমরা করে ফেলেছি।

সারা বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগের এন্ট্রি লেভেল হলো সহকারী অধ্যাপক এবং ন্যূনতম যোগ্যতা হলো পিএইচডি। আমরা যদি এই জিনিসটাও করতে পারতাম তাহলে মেধা ধ্বংস থেকে রক্ষা পেতাম। যাদের মেধা আছে তারা নিজ যোগ্যতায় স্কলারশিপ ফেলোশিপ জোগাড় করে পিএইচডি করে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হলে বিশ্ববিদ্যালয়ও অনেক উপকৃত হয়। কারণ শিক্ষককে পিএইচডি জন্য পূর্ণ বেতনে ছুটি দিতে হয় না, ছুটি নিয়ে বিদেশে গিয়ে ফিরে না আসার ঝুঁকি নিতে হয় না। আমি দেখেছি ক্লাসের সেরা ছাত্রটাও যদি প্রভাষক হিসাবে নিয়োগ পায় তাহলে অন্তত ২ বছরের জন্য সে আটকা পরে যায়। তারই ক্লাসের তার চেয়ে একটু কম ভালো রেজাল্ট করা সহপাঠী তার আগে পিএইচডি করতে চলে গিয়ে এক সময় তার চেয়ে অনেক ভালো করে ফেলে। আর বাংলাদেশে যেহেতু সরাসরি পিএইচডি করাদের নিয়োগ তেমন দেয় না তাই ওরা আর ফিরে আসে না। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পিএইচডি কে অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসাবে রেখেছে। অথচ এইটা হওয়ার কথা ন্যূনতম যোগ্যতা। আর পোস্ট-ডক অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ ও প্রমোশন নীতিমালার কোথাও পোস্ট-ডক শব্দটি পর্যন্ত উল্লেখ নেই। অথচ সম্প্রতি বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগের জন্য কেবল পিএইচডি না বরং দুয়েকটি পোস্ট-ডক অভিজ্ঞতা ন্যূনতম যোগ্যতা হিসাবে ধরা হয়। এমনকি ভারতেও।

আমরা যদি
১। প্রথমবর্ষের ছাত্রদের জন্য একটি নিরাপদ স্বাস্থ্যসম্মত আবাসিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারতাম
২। প্রভাষকদের ভালো আবাসিক ব্যবস্থাসহ তাদের আরো বেশি বেতন সুবিধা দিয়ে, তাদের কোর্স কম এবং পিএইচডি র স্কলারশিপ বা ফেলোশিপ পেলে যেকোন সময় বিনা বেতনে ছুটি এবং পিএইচডি শেষে ফিরে আসলে চাকরি ফিরে পাবার নিশ্চয়তা দিয়ে ছুটি দিতাম
৩। ওয়ার্ল্ড রেঙ্কিং-এ ১ থেকে ৫০০ তে আছে এমন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি থাকলে তাকে সরাসরি সহকারী অধ্যাপক এবং দুটি পোস্ট-ডক থাকলে সরাসরি সহযোগী অধ্যাপক করার নিয়ম করতে পারতাম

তাহলেও এক লাফে এক বিরাট পরিবর্তন আসতো।

– অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়