সময়টা ছিল ২০১৪ সালের আগাস্ট মাস, আমি লেকচারার থাকার কলঙ্ক মুছে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করলাম, তার কিছুদিন পরেই সেইবারের ভর্তি পরীক্ষার সভাপতির পক্ষ থেকে একটা চিঠি পেলাম তাতে লেখা রয়েছে যে আমাকে আসন্ন বুয়েট ভর্তি পরীক্ষার খাতা scrutiny, সমষ্টিকরণ, সর্টিং, ইকো চেকিং এবং পরবর্তীতে সাবজেক্ট চয়েজ এর ফর্ম গ্রহন ও ছাত্রছাত্রীদের কাগজপত্র ভেরিফিকেশন এর দায়িত্বে নিয়োগ করা হয়েছে।

আর আমার কোন নিকট আত্মীয় পরীক্ষার্থী থাকলে আমাকে লিখিত ভাবে জানাতে বলা হয়েছে, এরপর আত্মীয়র যে সংজ্ঞা দিয়েছে তা আমার জানা ছিল না যে আত্মীয় আবার এত প্রকার হয়! এক কথায় যত প্রকার আত্মীয় মানুষের থাকতে পারে সব উল্লেখ করেছে।

আমি তো চিঠি পেয়ে অনেক গর্ববোধ করলাম এই ভেবে যে এতদিন আকাশে বাতাসে এই ভর্তি পরীক্ষার খাতা কিভাবে দেখা হয় তা নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি, তো এইবার আমি নিজের চোখে দেখবো যে আসলে কি হয় সেখানে! তো আমার কোন আত্মীয় পরীক্ষার্থী ছিলনা বিধায় আমি ভর্তি পরীক্ষার পরদিন সরাসরি চলে গেলাম যেখানে খাতা দেখা হবে সেখানে।

গিয়ে দেখি অনেক দূর থেকেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং দরজা জানালা সব সিল গালা করা, আমি সময়ের একটু আগেই হাজির হয়েছিলাম তো তাই তখনও সব বন্ধ ছিল, কারন তখনও সভাপতি স্যার আসেন নি।

সভাপতি আসার পর উনার উপস্থিতিতে গার্ডকে দিয়ে সব দরজা জানালার তালা খুললেন তারপর আমরা প্রবেশ করলাম।

২০১১ সালে লেকচারার হিসাবে নিয়োগের পরপরই ভর্তি পরীক্ষার দিন কক্ষে দায়িত্ব পড়েছিল, সেইবার থেকেই একটা জল্পনাকল্পনা ছিল যে খাতা মূল্যায়নে থাকতে পারলে আরও ভালো লাগত, যেহেতু খাতা মূল্যায়নে কেবল সহকারী অধ্যাপক থেকে উপরের স্তরের শিক্ষকরা নিয়োজিত থাকে তাই আমাকে আরও অপেক্ষা করতে হবে।

সেই অপেক্ষার পালা শেষ করে সেদিন আমি সেখানে উপস্থিত হয়ে তাই বেশ আনন্দিন ছিলাম, কিন্তু সেই আনন্দ বেশিক্ষণ থাকলো না কারণ শুরু হল আসল কাজ যেটা অনেক পরিশ্রমের, দায়িত্বের, নিষ্ঠার এবং গর্ব ও ঐতিহ্যের, আর এই পদ্ধতির সাথেই জড়িয়ে থাকবে অনেক শিক্ষার্থীর আশা আকাংখা, সপ্ন আর ভবিষ্যৎ।

এই জন্যই এমন নিছিদ্র ব্যবস্থা, প্রতিদিন সকালে সিল গালা খোলা হয় আবার দুপুরে সব দরজা জানালা সিল গালা করা হয়, আবার তা বিকাল বেলা খোলা হয় এবং রাতে আবার সিল গালা করা হয় যাতে কোন প্রকার কোন ঝুকি না থাকে, এটা হল নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

এবার আসি খাতা মূল্যায়ন ব্যবস্থায়, যারা সিনিওর শিক্ষক তারাই কেবল খাতায় নম্বর দিতেন, একটি প্রশ্ন দুই জন শিক্ষক দেখার পর আমাদের কাছে আসত পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে পরীক্ষা করবার জন্য।

আমরা ২০ জনের মত শিক্ষক প্রতিটা খাতা অতি গুরুত্বের সাথে পরীক্ষা করতাম যে, কোন প্রশ্নে নম্বর দিতে বাদ পড়েছে কিনা অথবা কোন প্রশ্নে কোন অসঙ্গতি আছে কিনা, সব ঠিক থাকলে আমরা ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি আর ম্যাথেম্যাটিক্স এর নম্বর আলাদা আলাদা ভাবে যোগ করতাম।

এইভাবে দুএকদিনের মধ্যেই কিছু খাতা জমা হলে আমরা আবার সেই খাতাগুলো পরীক্ষা করতাম, এরপর দুইজন টেকনিশিয়ান যারা কম্পিউটার এ দক্ষ তারা আলাদা আলাদা দুটি কম্পিউটারে আলাদা দুটি প্রোগ্রামিং সফটওয়্যার এ খাতার নম্বরগুলো এন্ট্রি করত, কারণ পরে আমরা যখন আবার পরীক্ষা করব তখন তারা যদি একই নম্বর এন্ট্রি করে থাকে তাহলে ঠিক আছে বলে ধরে নেয়া যাবে।

এইভাবে সিনিওর স্যাররা দুইবার করে মানে ১২০ জন ৬০ টা প্রশ্ন ভালভাবে নম্বর দেবার পর এবং আমাদের দুইবার পরীক্ষার পর কম্পিউটারে ডাটা এন্ট্রি হবার পর শুরু হয় সবচেয়ে পরিশ্রমের কাজ তা হল এই দশ বারো হাজার খাতা সিরিয়াল করা, এইটাও করা হইত একটা এলগরিথম মেনে।

আমরা অনেক গুলো বড় বড় বাক্সে হাজারের খাতাগুলো একত্রে রাখতাম, যেমনঃ যেসব খাতার কোড ১০০০ দিয়ে শুরু সেগুলো এক বাক্সে এইভাবে।

তারপর হাজার থেকে শ’তে তারপর সব সিরিয়াল করতাম, এইটা করতে যেয়ে সবার কোমরের অবস্থা খারাপ হয়ে যেত, কিন্তু কি আর করা, অনেকে সভাপতির কাছে আবেদনও করতেন যে সে মুক্তি চায়, সভাপতি অবস্থা খারাপ বুঝলে মুক্তি দিয়ে অন্যকে খুঁজতেন।

এইভাবে সব একই সিরিয়ালে আসার পর শুরু হইত সবচেয়ে মজার অংশ, ইকো (Echo) চেকিং, এইটাতে আমি অনেক মজা পেয়েছিলাম। এই পদ্ধতিতে আমরা যা করতাম তা হলো, দুইজন টেকনিশিয়ান যে নম্বর গুলো এন্ট্রি করেছিল সেগুলো ঠিক আছে কিনা তা পরীক্ষা করা, কারণ আমরা যত শত বারই খাতা দেখি না কেন এবং যতবারই Scrutiny করি না কেন, কম্পিউটারে নম্বর ভুলভাবে এন্ট্রি করলে সবই ভুল হয়ে যাবে।

তাই আমরা দুইটা প্রগ্রাম থেকেই প্রিন্ট করা নম্বর নিয়ে সিরিয়াল করা খাতা গুলো নিয়ে তিন জনের ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে যেতাম, তারপর একজন মূল খাতা থেকে তিনটি বিষয়েরই নম্বর বলতাম আর বাকি দুইজন তাদের কাছে থাকা কম্পিউটার থেকে নেওয়া প্রিন্ট আউট মিলাইত, যদি তারা একই নম্বর শুনতে পায় এবং তাদের প্রিন্ট আউট এ একই নম্বর দেখতে পায় তাহলে সব ঠিক আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। তাই এই পদ্ধতির নাম ইকো চেকিং।

নম্বর বলতে বলতে মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়ে যেত আর অনেকক্ষণ বলার পর ফ্যাটিগ চলে আসত তখন দেখত একটা আর বলত আরেকটা, ঐ সময় খুব মজা লাগত।

এই কাজ করার পর মাথার ঝিম ঝিম করত কয়েকদিন। এইভাবে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে, সবাইকে সমানভাবে বিচার করে, কোথাও কোন অসঙ্গতি না রেখে আমরা আমাদের দায়িত্ব শেষ করেছিলাম।

এরপর প্রতি বছরই চিঠি পেয়েছি এবং অতি নিষ্ঠার সাথে কাজ করেছি, শেষ বার মানে ২০১৭ সালে দায়িত্ব ছিল খাতায় নম্বর দেয়া, আমি ফিজিক্‌স এর দুটো প্রশ্ন দেখেছিলাম কিন্তু উত্তর সঠিক হলে ফুল নম্বর তাতে কোন চিন্তা ছিল না তবে পুরো সঠিক না হলে বিচার বিবেচনা করে নম্বর দিতে হত যা পরে আরও স্যাররা দেখে দিতেন যে আমি ঠিক করছি কিনা।

এইভাবে চলে আমাদের খাতা দেখা আর এই দায়িত্ব পালন কালে সবারই একটাই চিন্তা থাকে যে তার কোন গাফিলতির জন্য যেন কোন পরীক্ষার্থীর জীবন নষ্ট না হয়, এই দায় আমরা কেউই নেই না তাই আমরা এত পরিশ্রম করে, এত কষ্টের পরেও আমরা প্রশান্তি অনুভব করতাম। কাজেই এইটা অতি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলা যায় যে এমন খাতা মূল্যায়ন পৃথিবীর কোথাও নাই।

যাইহোক আমাদের ইকো চেকিং শেষ হবার পর ডিন স্যাররা ডিকোডিং শুরু করেন সকাল থেকে, এর মানে হল ভর্তি পরীক্ষার পরপরই কেবল মাত্র কয়েকজন ডিন পরীক্ষার্থীর রোল নম্বর এর স্থলে একটা কোড বসিয়ে দেয় খাতার উপর, আর রোল নম্বর টা কেটে নিজের কাছে রেখে দেয়।

এটা হল কোডিং, আর সব ধাপ সঠিক ভাবে সম্পন্ন হবার পর রোল নম্বরের বিপরীতে যে কোড বসিয়েছে তা আবার রোল নম্বরে পরিণত করা।

কাজেই খাতা পরীক্ষা করার সময় কেউই জানে না যে কোনটি কার খাতা, ছেলে না মেয়ে তা বোঝা যেত না, তবে আমরা যারা একটু দুষ্ট বুদ্ধির চর্চা করি তারা হাতের লেখা দেখে আন্দাজ করতাম যে কোনটি কার হতে পারে, সোজা লেখা হলে ছেলে আর বাঁকা অক্ষর হলে সাধারণ মেয়েদের হয় !

তো সকাল থেকে ডিকোডিং শুরু হয়ে অনেক রাত পর্যন্ত তা সেনিওর স্যাররা করতেন বাইরের সাথে সব প্রকার যোগাযোগ বিছিন্ন করে। তাই বুয়েটের ফলাফল ঘোষণা করতে অনেক রাত লেগে যায়।

 

এইভাবে আসলে আমরা বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম পরিচালনা করি অনেক ধৈর্য আর প্রত্যয় নিয়ে, তাই যারা উত্তীর্ণ হয় তারা ১০০ ভাগ খাটি , নিখাদ তাতে কোন বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই।

কাজেই উত্তীর্ণরা গর্বের সাথে বলতে পারবে যে তারা কেবলমাত্র নিজের যোগ্যতায় বুয়েটিয়ান হয়েছে, কারও করুনা বা প্রতারণায় নয়।

দেশের অন্য জায়গায় যখন দেখি পরীক্ষা হবার পর তা স্থগিত করা তখন ভাবি আমরাই কেবল মাত্র নিছিদ্র পদ্ধতির চর্চা করি তাতে কোন দ্বিধা নেই। কিন্তু এই পদ্ধতিতে বাছাই করার পর যখন সে খুনি হয় তখন মনে হয় আমাদের সব পরিশ্রম বৃথা গেল নাকি!।

পরিশেষে এইটুকুই বলব যে যারা বুয়েটে এইবার ভর্তি হতে চলেছে তারা একটা সুস্থ সুন্দর ও সবচেয়ে নিরাপদ বুয়েট ক্যাম্পাসে ভর্তি হউক এবং তাদের বিচরণে হয়ে উঠুক বুয়েট ক্যাম্পাস প্রানবন্ত ও আলোকিত এবং সবার পদধ্বনিতে বুয়েট হয়ে উঠুক আবার মুখরিত এইটাই একজন বুয়েটিয়ান এর প্রত্যাশা।

লেখকঃ

Assistant Professor, BUET.

যোগ দাও হতে চাইলে BUET’ian গ্রুপে

বুয়েটের সব বিষয়ের Review 

বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক রিভিউ পড়তে ভিজিট করো এই লিংক

সাব্জেক্ট ভিত্তিক রিভিউ পড়তে ভিজিট করো এই লিংক 

এডমিশন নিয়ে যেকোনো জিজ্ঞাসায় যোগ দাও আমাদের ফেসবুক গ্রুপে