পৃথিবীর প্রাচীনতম এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম হলো University of al-Qarawiyyin, প্রতিষ্ঠিত হয় ৮৫৯ সালে, মরোক্কোতে। সেটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ফাতিমা আল-ফিহরি। নিশ্চয় বুঝতেই পারছেন, সেটা কোন সময়কাল! ঐ সময়টা ছিলো মুসলিমদের জন‍্য দ‍্যা গোল্ডেন এইজ—স্বর্ণযুগ। ইউরোপিয়ানদের জন‍্য সে সময়টা ছিলো দ‍্যা ডার্ক এইজ—অন্ধকার যুগ।

সে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম এখনো চলে, প্রায় বারোশ বছর ধরে। তবে আধুনিক বিশ্ববিদ‍্যালয়ের ধাঁচে রূপ নিয়েছে সম্প্রতি। বারোশ বছর আগে একজন মুসলিম নারী, একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলো। আর, আজ থেকে মাত্র একশো বছর আগে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে নারীরা ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। তার আগে নারীদের ভর্তি করানো নিষিদ্ধ ছিলো।

ইউরোপের ইউনিভার্সিটিগুলোতে মেয়েরা যখন পড়াশুনার জন‍্য ভর্তি হতে পারতো না, তখন এই বাংলার নবাব ফয়জুন্নেছা ১৮৭৩ সালে কুমিল্লায়, মেয়েদের জন‍্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেছিলেন—আজ যেটি নবাব ফয়জুন্নেছা স্কুল। সে স্কুল, নারী শিক্ষার জন‍্য সমগ্র ভারত বর্ষের অন‍্যতম প্রাচীন প্রতিষ্ঠান।

মুঘলরা যখন ভারতবর্ষ শাসন করে, তখন তারা ইউরোপ থেকে রঙ আনতো। টাইলস আনতো। স্থাপত‍্যকর্ম করতো। তাদের সাথে ইউরোপিয়ানদের যোগাযোগ ছিলো। কিন্তু ইউরোপের রেঁনেসাকে কাজে লাগাতে পারেনি। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের যখন দ্রুততম প্রসার হচ্ছিলো, উদ্ভাবন-আবিষ্কারে যখন পুরো ইউরোপ তুঙ্গে, তখনো মুঘল রাজাদের হুঁশ হয়নি। তারা ছিলো অগনিত বিয়ে আর নারী সম্ভোগ নিয়ে ব‍্যাস্ত! খুনা-খুনি তো ছিলোই। শাসকদের অদূরদর্শীতার জন‍্য একটা জাতিকে, একটা ভৌগলিক অঞ্চলের মানুষদেরকে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভুগতে হয়।

বাদশা আলমগীর, বাদশা শাহজান তারা তাদের সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী বাদশা ছিলেন। তারা চাইলেই বড়ো বড়ো বিশ্ববিদ‍্যালয় করতে পারতেন। হার্ভাড ইউনিভার্সিটি হয়েছে ১৬৩৬ সালে। বলতে গেলে সেদিন। তখন আমেরিকানদের চেয়ে মুঘল রাজাদের অনেক বেশি টাকা ছিলো। কিন্তু লাইট হাউজের দিকে চোখ ছিলো না।

সুইডেনের সবচেয়ে প্রাচীন ইউনিভার্সিটি হলো উপসালা ইউনিভার্সিটি—১৪৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত। সে ইউনিভার্সিটি সমগ্র উত্তর ইউরোপে রেঁনেসায় ভূমিকা রেখেছিলো। সেই রেঁনেসার কালে বাংলায় ছিলো শের শাহ’র শাসন কাল। টাকায় নাকি আট মন চাল পাওয়া যেতো! এতদ অঞ্চল কতোটা সমৃদ্ধ ছিলো—এ থেকেই তো বুঝা যায়। কিন্তু সে মানের একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলো না।

ইসরাইল সম্ভবত আধুনিক পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্র, যেটা রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার আগে সেখানে ইউনিভার্সিটি গড়ে উঠেছিলো। রিসার্চ সেন্টার গড়ে উঠেছিলো। আর এ সকল পরিকল্পনার মূলে ছিলো কাইম ভাইজম‍্যান।

তার মতো দূরদর্শী নেতা বিংশ শতকে একটাও নাই। কাইম ভাইজম‍্যান ধরেই নিয়েছিলেন, ইসরাইল রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাক কিংবা না পাক—এ অঞ্চলের ক্ষুদ্র ইহুদি জনগোষ্ঠির জন‍্য শিক্ষা দরকার। গবেষণা দরকার।

ইসরাইল প্রতিষ্ঠার চৌদ্দ বছর আগে তিনি গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তুলে, ইউরোপের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীদের নিয়ে এসেছিলেন। যারা বলে, ইসরাইল শুধু আমেরিকার সাপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে, তারা জ্ঞান-গবেষণার কোন খোঁজ রাখে? —না ইতিহাস ঠিকমতো জানে?

দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি হলো KAIST, স্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়। সে প্রতিষ্ঠান আজ বিশ্বসেরা। আর ঢাকা বিশ্ববিদ‍্যালয়কে আমরা গতো পঞ্চাশ বছরে ধ্বংস করে দিয়েছি।

আমরা তো এখন সবকিছুতে ইহুদিদের ষড়যন্ত্র খুঁজে বেড়াই। কিন্তু একজন ইহুদি ভিসি, পি. জে. হার্টগ ঢাকা বিশ্ববিদ‍্যালয়কে যতোটা গড়ে তুলেছিলো, যতোটা মান দিয়েছিলো, যে পরিকল্পনার ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিলো সে মতো চলতে থাকলে আজ এটা বিশ্বের অন‍্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতো। সেই আলোকচ্ছটা সমাজে প্রকটভাবে ধরা পড়তো।

মুসলমানরা আধুনিক শিক্ষা থেকে সরে গিয়েছিলো। ষোল-সতের শতক থেকে আধুনিক বিজ্ঞান ও উদ্ভাবন-আবিষ্কারের যে যুগ তৈরি হয়েছিলো, সেটা থেকে সরে গেছে। সেটার সাথে তাল মেলানোর চেষ্টা করেনি। মুসলিম রাজা ও শাসকদের মধ‍্যে শিক্ষার গুরুত্ব কমে গিয়েছিলো।

জ্ঞান-বিজ্ঞানকে ধর্মের সাথে একাকার করে একটা কেইয়স তৈরি করেছিলো। জ্ঞানীদেরকে গালাগাল করে, তাদের কদর নষ্ট করে, মানুষকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত হওয়া থেকে নিরুৎসাহিত করেছিলো। নারীদেরকে আধুনিক শিক্ষা থেকে দূরে রেখেছিলো। জ্ঞানীদেরকে ধর্ম দিয়ে যাচাই করেছে।

শুধু ধর্মকে আকঁড়ে পৃথিবীতে টিকে থাকতে চেয়েছিলো! আধুনিক জ্ঞানের শক্তি দিবালোকের মতো স্পষ্ট থাকলেও, সেটাকে আলিঙ্গন করেনি। কিন্তু তাদের শুরুটা এমন ছিলো না। শুরুর আলোটুকু নিভিয়ে একসময় অন্ধকারকেই ভালোবাসতে শুরু করলো!
……………………
@Rauful Alam
নিউজার্জি, যুক্তরাষ্ট্র।