যদি আপনি সিনেমাপ্রেমী না হোন, তবুও। আমি আপনাকে বারো’টা সিনেমা দেখতে বলবো, কেননা এই বারো’টা সিনেমা বারো’টা বিষয় সম্পর্কে আপনাকে খুব ভালো একটা ধারণা দেবে।

এটা দুই হাজার সাল পরবর্তী নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর রেখে একান্তই আমার পছন্দ অনুসারে বাছাই করা সিনেমার তালিকা।

একই বিষয়ের ওপর অসম্ভব ভালো অসংখ্য সিনেমা থেকে একটা বেছে নিতে গিয়ে অবস্থা কাহিল আমার। তাও নিলাম। দেখে ফেলুন। দেখা থাকলে দ্বিতীয়বার দেখুন।

🎁 ‘নারী’
🎬 Pink (2016)

একটা পুরো প্রজন্মের মগজ, টিপিক্যাল চিন্তাধারা ও একটা বিকৃত আস্ত সোসাইটি মাত্র একশো ছত্রিশ মিনিটে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেছিলেন অনিরুদ্ধ রয় চৌধুরী ও সুজিত সরকার। দুই হাজার ষোল সালে। একটি সিনেমা বানিয়েছিলেন ওরা। নাম, পিঙ্ক।

এই সিনেমার গল্প শুরু হয় তিনজন নারীর এক রাত্তিরের বিপর্যস্ত একটা মানসিক অবস্থা দিয়ে। ওরা একজনকে আহত করে পালিয়েছে।
কাকে?
এবং কেন?

আমি এই সিনেমাকে আমাদের সোসাইটির আয়না বলি। এত পরিষ্কার আয়নায় নিজেদের মুখ এতটা স্পষ্ট করে দেখানো হয়েছে কিনা এর আগে আমি জানি না।

আমি শুধু জানি, এই সিনেমা আপনাকে মাত্র একশো ছত্রিশে মিনিটে বদলে দিতে পারবে। আর এতটা এতটা এতটা রিলেটেবল প্রতিটা দৃশ্য, দৃষ্টি, সংলাপ, বিদ্রুপ এমনকি পিনপতন নির্জনতাটুকুনও এতটা প্রাসঙ্গিক।

গল্পটা একটুখানি বলি। তিনজন স্বাবলম্বী নারী চেনা একজন বন্ধু ও বন্ধুর বন্ধুর নিমন্ত্রণে একটা রিসোর্টে ডিনার করতে যায়। মদপান করে। এবং একটা পর্যায়ে বন্ধুর ঐ বন্ধুর কপালে বোতল ভেঙে পালিয়ে আসে।

এবং দাবী করে ঐ বন্ধু সেক্সুয়ালি হ্যারাজ করছিল তাকে। এইটুকুন আমি বললাম, কারণ এইটুকুন লাইনেই আমাদের সোসাইটি ইয়া বড়ো একটা আঙুল তুলে ফেলে ঐ নারীর দিকে।

‘তুমি কেন গিয়েছিলে রাত্তিরে? মদপান করেছিলে কেন? এডাল্ট জোকস বলে খিলখিল হেসেছিলে কেন? কেন রাতে বের হলে? যদি তোমার দোষ না-ই থাকতো, তবে পুলিশ কেইস কেন করলে না? এবং শেষ প্রশ্ন, তুমি কেন গিয়েছিলে?’

দীপক সেহগাল এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছিলেন। আমি কেন এই সিনেমা দেখতে বলি? এই উত্তরগুলো শুনুন। বুঝুন। আমাদের সোসাইটি বুঝতে হলে আপনাকে এই সিনেমা দেখতে হবে।

নারী, কনসেন্ট ও টিপিক্যাল মনুষ্যের ধ্যান ধারণা বুঝতে হলে এই সিনেমা আপনাকে দেখতে হবে। এই সিনেমায় আমার সবচেয়ে প্রিয় দৃশ্য কোনটা বলি।

মেয়েটির কেইস চলছে আদালতে। দীপক লড়ছেন মেয়েটির পক্ষে। দীপকের সঙ্গে এক সকালবেলা মর্নিং ওয়াকে বের হয়েছে মেয়েটি।

আশপাশের কয়েকজন ফিসফিস করল মেয়েটিকে দেখে। মেয়েটি ওদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে হুডি তুলে দিলো মাথায়। দীপক এক হাত বাড়িয়ে ঝট করে হুডি নামিয়ে দিলেন।

অর্থ হলো, ‘মানুষ ফিসফিস করছে বলে মুখ লুকোতে হয় না। যেভাবে হাঁটে সবাই, ওভাবেই হেঁটে যেতে হয়।’

এত সুন্দর একটা দৃশ্য। এই সিনেমা পুরোটাই সৌন্দর্য। এমন সৌন্দর্য শেষবার দেখেছি ‘Promising Young Woman’ সিনেমায়। ঐ সিনেমায়ও মেয়েটি হাঁটছিল, বার্গার খেতে খেতে। এবং রাস্তার ওপাশ থেকে কিছু কর্মচারী টিজ করল তাকে। মেয়েটি ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। ওদের দিকে তাকিয়ে।

মজার কথা হলো, এই তাকানোর মধ্যে কোনো রাগ ছিল না, ক্ষোভ ছিল না, ঘৃণাও ছিল না। যেভাবে আমরা জড়বস্তুর দিকে তাকাই, ঐভাবেই। তাকিয়েই রইল। এরপর কী হয়েছিল জানেন?

কমর্চারীরা অস্বস্তিবোধ করছিল। তারা টিজ করা থামিয়ে অস্বস্তির এক পর্যায়ে মেয়েটিকে গাল দিতে দিতে ঐ জায়গা ত্যাগ করেছিল। নারীর সামান্য চোখ তুলে তাকানোয়ও পুরুষের একগাদা অস্বস্তি জমা। প্রশ্নে জমে আছে ভয়। পিঙ্ক দেখুন।

সিনেমার শেষদিকে যখন নারী পুলিশটি হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে দীপকের সঙ্গে, আপনি অনুভব করতে পারবেন। আপনি জেনে যাবেন, পৃথিবী মানুষের হয়ে উঠলে কোনো নারীই কখনও ঘৃণা নিয়ে ছুঁবে না পুরুষের হাত।

Watch Link

🎁 ‘প্রেম’
🎬 Premam (2015)

মালায়লাম এই সিনেমা আপনাকে প্রেমে পড়তে শেখাবে। কতটা যত্ন করে মানুষ প্রেমে পড়ে, কতটা আবেগ মিশিয়ে মানুষ ভালোবাসে এবং কতটা বিষাদ বুকে পুষে চুমু খায় জীবন। প্রতিটি মানুষের জীবনের তিনটি স্টেজ থাকে। প্রেমাম হচ্ছে এই তিনটি স্টেজের গল্প।

ফার্স্ট স্টেজ। স্কুল লাইফ। খুব খুব খুব কম সংখ্যক মানুষ পাওয়া যাবে, যারা এই স্তরে প্রেমে পড়েনি। প্রথম প্রেম। আহা! নিদারুণ আবেগ, লজিকহীন চিন্তাভাবনা, সহজ সরল অথচ তীব্র ভালোবাসা।

প্রথম প্রেম ভুলতে ভুলতেই কেটে যায় এক জনম। এই স্টেজে মানুষ প্রথম প্রেমে পড়ে এবং প্রথম বিচ্ছেদের সম্মুখীন হয়। এই স্টেজের ভিলেইন বয়স।

সেকেন্ড স্টেজ। কলেজ লাইফ। নতুন নতুন ডানা গজানো প্রজাপতির দল। প্রথম স্টেজের বিষাদ কাটাতে মানুষের এক জনম তো লাগে, এই স্তরে মানুষ তাই প্রেমে পড়ে ভেবেচিন্তে।

অতটাও নয়। তবে প্রথম স্টেজের ধাক্কাটা মাথায় থাকে। তারপরও এই স্টেজের প্রেমটা সুন্দর পরিণতি পায় না। এই স্টেজের ভিলেইন ক্যারিয়ার।

লাস্ট স্টেজ। চাকুরি বাকুরি করা আধা পরিণত ব্যক্তি। এই স্টেজে মানুষ প্রেমে পড়ে সময় নিয়ে। অধিকাংশই আপন করে নেয় আগে, তারপর পড়ে প্রেমে তার। এই স্টেজে কোনো ভিলেইন নেই। যদি থাকে, ওটা খোদ ব্যক্তি স্বয়ং।

এই সিনেমা প্রেম বুঝতে শেখায়। আমরা প্রতিটা স্টেজে একজন করে হারিয়ে আসি। খুব কম সৌভাগ্যবান ব্যক্তি থাকেন, যারা তিনটি স্টেজই এক মানুষের হাতের আঙুলের ফাঁক বুজে কাটিয়ে দেন। বাকিরা বিষাদ পুষেন। সকাল বিকাল। তারপরও প্রেম আসে। বারবার। বহুবার।

প্রেমাম আমায় নাড়িয়ে দিয়েছিল। জোরধার ধাক্কা দিয়েছিল। আপনাকেও দেবে। এই সিনেমার প্রতিটি গান সুন্দর। দৃশ্যগুলো মনোরম। অকৃত্রিম। প্রেমগুলোও। এবং বিষাদ।
আমি ঐ দৃশ্য কল্পনা করেও বিষন্ন হয়ে যাই এখনও।

জর্জ যখন মালারের বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। রিভার্স কিছু দৃশ্য বয়ে চলে অবিরাম। শরীর কাঁপুনি দেয়। হয়তো আমার গল্পের সঙ্গে ভীষণ রিলেটেবল বলেই এই সিনেমা আমার বুকের খুব কাছাকাছি জায়গা করে নিয়েছে। নাও হতে পারে। কখনও বিচ্ছেদের সম্মুখীন না হওয়া আপনারও ভালো লাগবে।

প্রেম শব্দটির সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হোন। আগামী প্রজন্ম হয়তো এই বিষাদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবে না। নিতে চাইবেও না। কে যেন বড্ড দুঃখ নিয়ে বলেছিল, আমরাই হচ্ছি শেষ প্রজন্ম।

যাদের সমাজ, ধর্ম, ক্যারিয়ার কিংবা পরিবারের দিকে তাকিয়ে ভালোবাসার মানুষটিকে ছেড়ে আসতে হয়েছে। বিচ্ছেদের পরও ভালোবাসা গুরুত্বপূর্ণ। এই সিনেমা আপনাকে শেখাবে, চূর্ণ হওয়া একখানা বুক নিয়েও কী করে ভালোবাসতে হয় পুনরায়।

Watch Link

🎁 ‘ডিপ্রেশন’
🎬 Dear Zindagi (2016)

আমি আজ অবধি চিন্তাধারা বদলানো, বুঝতে পারা, ডিপ্রেশন, সন্তান কিংবা প্যারেন্টস সম্বন্ধীয় যত লেখা লিখেছি, একবার হলেও এই সিনেমার নাম উল্লেখ করেছি লেখায়।

এই সিনেমা আমায় একটা চরম চরম চরম ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উঠে আসতে দারুণ রকম সাহায্য করেছে। আমার ধারণা, এই সিনেমা আপনাকেও উঠে আসতে সাহায্য করবে।

গল্পটা হচ্ছে, কায়রার। যে ক্যামেরার পেছনে কাজ করে এবং একটা নিজের ফিল্ম ডিরেকশন দেওয়ার ইচ্ছা আছে তার। কায়রার লক্ষ্য দারুণ। সমস্যাটা অন্য কোথাও। কায়রা একটা সম্পর্কে ছিল। এবং সম্পর্কটা ভেঙে যায়। কায়রা হারিয়ে যায় অতলে।

আমার মনে হয় না, এই পরিস্থিতিতে পৃথিবীর কেউ আদৌ কখনও পড়েনি। সবাই বেরিয়ে আসতে পারে? উহু। কেউ কেউ আটকা পড়ে। কায়রাও আটকা পড়ে অমন।

ইনসোমনিয়া খেয়ে ফেলে তাকে। এবং কাজের দরুণ তার সঙ্গে পরিচয় হয় জাহাঙ্গীর খানের সঙ্গে।

সাইকোলজিস্ট। এই ব্যক্তির মুখ নিসৃত প্রতিটি সংলাপ আপনি আপনার ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লিখে রাখবেন। কথা দিচ্ছি, এই সিনেমা আপনাকে একই রাস্তার দু’টো, চারটে কিংবা দশটা পথ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে।

যে ক’টা পথ আমরা ব্যবহার করি না। করতে শেখায়নি কেউ। এই সিনেমা আপনাকে ঐ ক’টা পথ থেকে একটা পথ বেছে নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বেঁচে থাকতে শেখাবে।

এই সিনেমায় কায়রার প্রধান সমস্যাটির সঙ্গে অনেকেই নিজেকে রিলেট করতে পারবেন। কায়রার অনেকগুলো সমস্যার একটি ছিল, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে না পারা। এই কাজটি সে করতো ভয় থেকে। ‘আপনাকে কেউ ছেড়ে যাবে এই ভয়ে আগে তাকেই ছেড়ে দেওয়া।’

আমরা প্রায় মানুষ ভুগি। প্রতিটা বাবা মায়ের এই সিনেমা দেখা উচিত। সন্তানের মানসিকতা বুঝতে। প্রতিটা টিনএজের এই সিনেমা দেখা উচিত। নিজেকে বুঝতে।

সিনেমার প্রিয় একটি সংলাপ বলি।
‘কখনও কখনও আমরা কঠিন অপশন এজন্যই বেছে নিই, কেননা আমাদের তখন মনে হয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু পাওয়ার জন্য কঠিন অপশনটি বেছে নেওয়াই বেস্ট অপশন।

নিজেকে নিজে শাস্তি দেওয়া অনেক জরুরি মনে করি। কেন? সহজ অপশনটা কেন বেছে নিই না? ক্ষতি কী ওখানে? বিশেষ করে ঐ পরিস্থিতিতে, যখন ঐ কঠিন রাস্তার ধকল সামলানোর পর্যাপ্ত প্রস্তুতিই নেই আমাদের!’

Watch Link

🎁 ‘যুদ্ধ’
🎬 Tangerines (2013)

যুদ্ধ নিয়ে অসংখ্য সিনেমা হয়েছে। দুনিয়ার আর সব সিনেমা ফেলে আমি এই সিনেমা বেছে নিয়েছি যেখানে একটা কি দুইটা ছাড়া গোলাগুলিরও কোনো দৃশ্য নেই। তবুও এই সিনেমা আপনাকে কুঁকড়ে দেবে অসীম বেদনায়।
গল্পটা।

যুদ্ধ চলছে। ঐ অঞ্চলের সবাই পালিয়ে গেলেও কয়েকজন থেকে গিয়েছেন মাটি কামড়ে। বৃদ্ধ তার মধ্যে একজন। একদিন বৃদ্ধের বাড়ির খুব কাছে একটা সংঘর্ষ হয় দুই প্রতিপক্ষের। এবং এই সংঘর্ষে দু’জন মানুষকে আহত অবস্থায় বৃদ্ধ ঘরে তুলে আনেন।

চিকিৎসা দেন। যারা একে অপরের প্রতিপক্ষ। সিনেমার গল্পটা এই তিনজনকে ঘিরে। একজন, যিনি একপক্ষের হয়ে লড়ছেন। অন্যজন, যিনি বিপরীত পক্ষের হয়ে লড়ছেন।

এবং তৃতীয়জন, যিনি দু’জনকেই চিকিৎসা, খাদ্য সহ আশ্রয় দিয়েছেন। যখন দু’জন ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল, ওরা প্রতিটি কথায় একে অপরের প্রতি মারমুখো হয়ে উঠতে লাগল।

এবং বৃদ্ধ দু’জনের থেকেই কথা নিলেন, যতক্ষণ তারা এই ঘরে থাকবে, কেউ-ই কাউকে আক্রমণ করবে না।

গল্প আর বলছি না। এই সিনেমা আপনি দেখুন বাকিটুকুন জানার জন্য। কারণ বাকিটুকুন একটা কবিতা। যুদ্ধক্ষেত্রে এমন দুর্দান্ত কবিতা লেখা হয়নি বহুদিন। এত সুন্দর। এত মায়াকাড়া। আর এতই অশ্রুসজল।

বর্ডারে গোলাগুলি হলেই আমরা লাফিয়ে উঠি, চায়না ভারতের যুদ্ধ কখন লাগবে অপেক্ষা করি, আমাদের এই সিনেমা দেখা অবশ্যই উচিত। আমাদের রক্তে নাচন ওঠে। যুদ্ধ বড্ড খারাপ জিনিস। যুদ্ধ ভীষণ বিচ্ছিরি একটা জিনিস।

এই সিনেমার শেষটুকুন আপনার চোখে অশ্রু নামাবেই। ঢের যুদ্ধ দেখেছে পৃথিবী। ভালোবাসা দেখা হয়নি। এই সিনেমা বরং আপনাকে ভালোবাসতে শেখাক। এই ক্যাটাগরীতে আরও একটা সিনেমা সাজেস্ট করছি। মাস্ট ওয়াচ।
‘Quo Vadis, Aida?’

Watch Link

🎁 ‘ধর্ম’
🎬 Mother! (2017)

গল্প উপন্যাস থেকে ঢের সিনেমা বানানো হয়। ড্যারেন এক কদম এগিয়ে সিনেমার জন্য বেছে নিয়েছেন একটা ধর্মীয় পুস্তক। প্রচণ্ড সেনসিটিভ একটা গল্পের উপর ভিত্তি করে অসাধারণ এই নির্মাণ আমায় মুগ্ধতার চরম সীমায় পৌঁছে দিয়েছিল।
গল্পটা বলি।

হিম। একজন পুরুষ। যিনি বাস করছেন তার স্ত্রী হারের সঙ্গে। হিম লেখক। এবং রাইটার্স ব্লকে আছেন। একদিন তাদের ঘরে আসে একজন পুরুষ অতিথি। পরদিন অতিথির স্ত্রী।

এবং তার ক্ষণিক মুহূর্ত পর আসে তাদের দুই ছেলে। এবং দুই ভাই মারামারি করে এক ভাই অন্য ভাইকে মেরে ফেলে। হার অবাক হোন।

কেননা তাদের আচার আচরণ উদ্ভট। অতিথির সন্তানের মৃত্যুর শোকসভায় আসে একগাদা মানুষ। তারা এসে চমৎকার বাড়ির জিনিসপত্র ব্যবহার করতে শুরু করে, ভাঙ্গতে শুরু করে। এমন আচরণ করে যেন এটা তাদের বাড়ি।
হার নিষেধ করেন।

চিৎকার করেন। হিম কানে নেয় না স্ত্রীর কথা। কারণ ঐ লোকগুলো হিমকে ভালোবাসে। ওরা হিমের ভক্ত। হিমের লেখা উপন্যাসের ভক্ত। ভক্তরা বাড়ির সামনে ঘেরাও করে। সুন্দর শান্ত মনোরম বাড়িটির যা তা অবস্থা করে ফেলে। হার যতবার বলে হিমকে, যে ওদের তাড়িয়ে দাও। ততবার হিম শান্ত মায়াভরা স্বরে বলে, ‘ওদের ক্ষমা করে দাও।’

চেনা চেনা লাগছে?
এই সিনেমা মেটাফোরিক্যাল। আমি জানি না এই সিনেমাকে আমি কোন বিশেষণ ব্যবহার করে প্রশংসা করবো। শুধু এতটুকুন জানি, ধর্ম নিয়ে কয়টা সিনেমা হয়েছে আমার জানা নেই, এখন অবধি এটা আমার দেখা বেস্ট সিনেমা।

এতটা স্পষ্ট করে, এতটা মায়া মাখিয়ে এবং এতটা ভয়াবহ পদ্ধতিতে একটা ধর্মীয় পুস্তক উপস্থাপন করতে সচরাচর দেখা যায় না। সিনেমাটায় আপনি কয়েকটা বিষয় গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন।

ঈশ্বর, পৃথিবী, প্রথম মানব মানবী, তাদের সন্তান এবং একদল বংশধর।

ডিস্টার্বিং এই সিনেমার প্রতিটি দৃশ্য আমার পছন্দ। প্রতিটা দৃশ্য। সবচেয়ে পছন্দের দৃশ্যটা হচ্ছে, স্ত্রী আগুনে জ্বলে কয়লা হয়ে গিয়েছেন। অল্প একটুকুন প্রাণ আছে এখনও শরীরে। হিম স্ত্রীকে কোলে নিয়ে একটা জায়গায় শুইয়ে দেন। এবং বলেন, ‘একটা শেষ চাওয়া আছে তোমার কাছে।’

স্ত্রী ভাঙ্গা স্বরে বলেন, ‘তোমায় দেওয়ার মতোন কিছুই অবশিষ্ট নেই আর আমার।’
হিম হাত রাখেন স্ত্রীর বুকে, বলেন, ‘আছে। তোমার ভালোবাসা।’

স্ত্রী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, ‘নিয়ে নাও।’
হিম মায়াভরা চোখে তাকিয়ে স্ত্রীর পোড়া বুকের মাঝখান দিয়ে দুই হাত ঢুকিয়ে ছিঁড়ে ভেতর থেকে একটা ক্রিস্টাল বের করেন।

এই সিনেমার ডির্স্টাবিং এই দৃশ্যটাই আমার কেন এত পছন্দ, জানার জন্য হলেও এই সিনেমা দেখুন। ঈশ্বরের সৃষ্টির সৌন্দর্যের দিক সম্পর্কে ঢের জানা হয়েছে। কুৎসিত দিকটাও জানুন।

Watch Link

🎁 ‘সমাজ’
🎬 The Lobster (2015)

আপনাকে সোসাইটি কিভাবে দেখে? আপনার জীবন। সংসার। আদৌ আপনার? নিয়ন্ত্রণ আপনার হাতে। আছে তো? আপনি একজন স্বাধীন মানুষ! সত্যি?

অসংখ্য প্রশ্নের সমন্বয়ে তৈরী এই বিদ্রুপাত্মক মেটাফোরিক্যাল সিনেমা দেখে আপনি অনুভব করতে শিখবেন, ঠিক কয়টা অদৃশ্য শৃংখলে বাঁধা আপনার জীবন।

এই শৃংখল পরায় সোসাইটি। ওরা কাউকে ‘নিজের’ মতোন চলতে দেয় না। কখনই না।
একজন লোক। যাকে তার স্ত্রী ছেড়ে গিয়েছেন। শহরে একা থাকার নিয়ম নেই, তাই লোকটিকে উঠতে হবে একটি হোটেলে।

হোটেলের নিয়মানুযায়ী লোকটিকে পঁয়তাল্লিশ দিনের মধ্যে একজন সঙ্গী বাছাই করে নিতে হবে, নয়তো লোকটির পছন্দ অনুযায়ী যেকোনো একটা পশুতে পরিণত হতে হবে খোদ তাকেই। গল্পটি শুরু হয়।

হোটেলের প্রতিটি নিয়ম আপনার কাছে উদ্ভট শুনালেও আপনি আড়চোখে তাকিয়ে দেখবেন, ঐ নিয়মগুলির শৃংখল আমাদের সোসাইটি ইতিমধ্যেই আমাদের হাতে পায়ে বেঁধে দিয়েছে। এই হোটেলটা আপনাকে নিয়ে ঘুরবে।

আপনি রোজ শিখবেন। আপনি অনুভব করবেন। আপনি হতাশ হবেন। আপনি অসহায় অনুভব করবেন। একটা পর্যায়ে আপনি আর হাঁটতে পারবেন না। আপনাকে ঘাড় টিপে ধরে হাঁটাবে।

এই সিনেমা দূর্ধর্ষ! আমি শুধুমাত্র গল্পের শুরুর দিকটা বলেছি। মাঝখানে গিয়ে কামড়ে ধরবে অস্তিত্ব আপনার। আর শেষটুকুন এমন দুর্দান্ত হবে কল্পনা করিনি। এটা কোনো রোমান্টিক সিনেমা নয়। আপনি শেষদৃশ্য দেখুন। এই সিনেমা আগাগোড়া দুর্ধর্ষ!

Watch Link

🎁 ‘বিজ্ঞান’
🎬 Interstellar (2014)

সময়টা তখনকার, যখন একজন ইঞ্জিনিয়ার থেকেও পৃথিবীর প্রয়োজন বেশী একজন কৃষকের। খাদ্যের অভাব। ব্লাইট রোগ। ফসল বেড়ে উঠছে না।

ক্ষণিক পর পর ভয়াবহ ধুলিঝড়ে বিঃধস্ত পৃথিবী। একটা গোপন মিশনে নেমেছে নাসা। ঐ মিশনটা কী আমরা পরে জানবো! এই মিশনে তাদের প্রয়োজন একজন দক্ষ পাইলট।

আমরা সাক্ষাৎ পাবো কুপারের। এই গল্পের হিরো। তার দু’টো বাচ্চা। এখনও বড়ো হয়ে ওঠেনি। ছোট বাচ্চাটা এখনও ভুতের অস্তিত্ব টের পায় বুকশেলপের পেছন হতে। কারোর সুক্ষ্ণ অস্তিত্ব! কেউ আছে এই বাড়িতে। কিছু একটা বলতে চায়। বাচ্চা ধরতে পারে না।

একদিন প্রচণ্ড ধুলিঝড় হয়।
খোলা জানালা দিয়ে ধুলো ঢুকে মেঝেতে পড়ে আস্তরণ। ঐ আস্তরণে পড়ে বাইনারি কোডে লেখা একটা ঠিকানা। নাসার গোপন অফিস। যেখানে কাজ করা হচ্ছে গোপন মিশন নিয়ে। কুপার জড়িয়ে পড়ে মিশনে।

তবে পৃথিবী বাঁচানোর রোমাঞ্চকর এই মিশনে নামতে হলে তাকে ছাড়তে হবে তার বাচ্চা দু’টোকে। রেখে যেতে হবে পৃথিবীতে। যখন কুপার ব্ল্যাকহোলের কাছাকাছি কোথাও কোনো গ্রহের পাশ দিয়ে উড়ে যাবে, আইনস্টাইনের সময় আপেক্ষিকতার কবলে পড়ে কুপারের ঘড়ির চলার গতি কমে আসবে খুব। পৃথিবীর সঙ্গে পার্থক্য হয়ে উঠবে ঢের। বাচ্চার কী হবে?
পৃথিবীর কী হবে?

কুপার কেন কান্না করবে একটা ছোট্ট স্ক্রীনের সামনে বসে। কুপার কেন মিথ্যে বলে ঢুকে যাবে কোনো অতল গহ্বরে। যেখানে আলো পৌঁছায়নি আজ অবধি। ওখানে কী আছে? আর বাচ্চার বুকশেলপের পেছনেই বা কী?

এই সিনেমাটা দুর্দান্ত।
যদিও মনে হতে পারে আমি পুরো সিনেমার গল্প আকারে ইঙ্গিতে বলে দিয়েছি। একদম না। আমি কিছুই বলিনি। বিজ্ঞান নিয়ে এত চমৎকার কাজ দুই হাজার পরবর্তী সালে কোনো সিনেমায় করা হয়েছে কিনা আমি জানি না।

এমন নিখুঁত কাজ। ক্রিস্টোফার নোলান জানিয়েছিলেন, এই সিনেমার পেছনে অনুপ্রেরণা রয়েছে বেশ ক’টি সিনেমার। তারমধ্যে একটি ‘২০০১: অ্যা স্পেইস অডিসি।’

এমনকি ইন্টারস্টেলারের টার্স নামক রোবোট’টি হুবহু অডিসির মনোলিথের মতোন। কুবরিকের ঐ দুর্ধর্ষ নির্মাণটাই এই সাবজেক্টে আমার লিস্টে এক নাম্বারে থাকে সবসময়।

এই সিনেমা আপনি কেন দেখবেন?
কারণ বিজ্ঞানের স্টুডেন্ট না হওয়া সত্ত্বেও ইন্টারস্টেলার আপনাকে বিজ্ঞানের কয়েকটা বিষয় নিয়ে রীতিমতো তুমুল আগ্রহ নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য ঘাড় ধরে বসিয়ে দেবে।

সঙ্গে পড়িয়ে নেবে থিওরি অব রিলেটিভিটি, ওয়ার্মহোল, ব্ল্যাকহোল, স্পেইস, গ্রাভিটি, ডাইমেনশন, টেসারেক্ট, কোয়ান্টাম ডাটা ইত্যাদি।

এই সিনেমার আরেকটা বিষয় না উল্লেখ করলেই নয়। মিউজিক। হান্সের মিউজিক এই দুর্দান্ত সিনেমার সীমানা মহাকাশ ছাড়িয়ে যেতে সাহায্য করেছে দারুণ।
দেখে ফেলুন।

Watch Link

🎁 ‘একাকিত্ব’
🎬 Her (2013)

এই সিনেমাকে পরিচালক স্পাইকের সেমি অটোবায়োগ্রাফি বলা হয়। স্পাইক বিয়ে করেছিলেন সোফিয়াকে ১৯৯৯ সালে। সোফিয়া হচ্ছেন মাস্টারপিস গডফাদারের নির্মাতার কন্যা। রক্তে আছে সিনেমা তার।

স্পাইক ও সোফিয়ার বিচ্ছেদ হয় ২০০৩ সালে। বিচ্ছেদের পর ঐ বৎসরই একটা সিনেমা নির্মাণ করেন সোফিয়া। নাম, লস্ট ইন ট্রান্সলেশন। তার দশ বৎসর পর স্পাইক নির্মাণ করেন হার।

এই সিনেমা ছিল সোফিয়ার লস্ট ইন ট্রান্সলেশনের উত্তর। ক্রিয়েটিভ মানুষগুলোর ভালোবাসা, অনুভূতি, সম্পর্কের গল্প কিংবা তার প্রকাশগুলোও অমন দুর্দান্ত হয়।

হার মুভিটি একজন একা, ইন্ট্রোভার্ট ও ডিপ্রেসড লোকের। যার বিচ্ছেদ হয়েছে। প্রচণ্ড একাকিত্বের ধকল সামলাতে সে জড়িয়ে পড়ে একটা অপারেটিং সিস্টেমের সঙ্গে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। একটা কন্ঠস্বর। যার কোনো শারীরিক আকার নেই।

লোকটি নিয়মিত কথা বলতে আরম্ভ করে। এবং নাম দেয় এই সিস্টেমটির। সামান্থা।
সামান্থা সঙ্গ দেয় তাকে। প্রচণ্ড একাকিত্বও হয়ে উঠে উপভোগ্য। সম্পর্কটা কন্ঠস্বর ছাড়িয়ে অন্যকোথাও চলে যায় ধীরে।

এই সিনেমা এতটাই দুর্দান্ত যে, ঐ কন্ঠস্বর কার পুরো সিনেমায় একবারও দেখানো না হলেও সামান্থাকে আপনি অনুভব করতে শুরু করবেন। সাবজেক্ট’টা একাকিত্ব হলেও এই সিনেমা সম্পর্কের গল্প বলে।

ভেঙেচুরে যাওয়া সম্পর্কের গল্প। নতুন করে জানালার বাইরে তাকানোর গল্প। প্রিয় একটা মানুষের পাশে একসঙ্গে বসে সুর্যোদয় দেখার গল্প।

মজার তথ্য হলো, লস্ট ইন ট্রান্সলেশনে যে মেয়েটি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছে, ‘হার’ মুভিতেও ঐ মেয়েটি সামান্থার কন্ঠস্বর দিয়েছে। স্কারলেট!

যেন মাঝখানে এক আসমান সমান দূরত্ব রাখা দু’টো মানুষ একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, কিছু প্রশ্ন করছে, প্রশ্নগুলোর উত্তর দিচ্ছে, একটা চমৎকার মাধ্যম ব্যবহার করে।

এই দু’টো সিনেমা যতটা সুন্দর, পেছনের গল্পগুলোও ততটাই সুন্দর। ততটাই বিষাদ। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এই সিনেমায় পৃথিবীর নিখুঁততম একাকিত্ব আঁকা হয়েছে। আপনিও কিছুটা ছুঁয়ে আসুন।

Watch Link

🎁 ‘প্রতিশোধ’
🎬 The Secret In Their Eyes (2009)

আর্জেন্টাইন এই সিনেমা আপনাকে প্রতিশোধের চূড়ান্ত ভয়াবহ রুপটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে। রিভেঞ্জ মুভি কম দেখিনি। কিন্তু এই সিনেমায় এসে আমি আটকে গিয়েছি। চূড়ান্ত মুগ্ধ যাকে বলে। সিনেমার গল্প একটা ধর্ষণ কেইস নিয়ে।

যেটা নিয়ে কাজ করছেন বেঞ্জামিন। এবং তার সিনিয়র ইরিন/আইরিন। কেইসটা শুরু হওয়ার পর চট করে ক্লোজ করে দেওয়া হয়। কেননা অপরাধী ধরা পড়েছে। বেঞ্জামিন অপরাধীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে টের পান, কনফেশন নেওয়া হয়েছে মেরে ধরে তাদের নিকট থেকে, জোর করে।

বেঞ্জামিন এও টের পান, এই কেইস আর অন্যকারোর নয়। ব্যক্তিগত হয়ে উঠছে ধীরে। আসক্ত হয়ে পড়ছেন তিনি। যে নারীকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়েছে, বেঞ্জামিন ঐ নারীর স্বামীর সঙ্গে দেখা করেন।

চোখের দিকে তাকান।
চোখ কথা বলে। মৃত স্ত্রীর প্রতি স্বামীর প্রচণ্ড ভালোবাসা দেখে আরও জড়িয়ে পড়েন কেইসের সঙ্গে। মূল অপরাধীকে খুঁজে বের করেন। তারও শাস্তি নিশ্চিত করতে পারেন না। অতদূর ক্ষমতা নেই বেঞ্জামিনের। তবে?

এই ভয়াবহ সিনেমায় একটা মুহূর্ত চোখের পলক ফেলা যায় না। দু’টো সময়ে ভাগ করা সিনেমাটির শেষদিকে যখন আপনি পৌঁছুবেন, অনুভব করবেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো শাস্তিটি কী হতে পারে! কেউ একজন কাঁপা কাঁপা হাতে আপনার গাল ছুঁয়ে দেবে।

খসখসে স্বরে জানিয়ে দেবে, মৃত্যুর পর নয় শুধু, কখনও কখনও বেঁচে থাকতেও দেখা মেলে পরিপূর্ণ নরকের।

প্রচণ্ড ভালোবাসা, মানবিকতা, সম্পর্ক ও চোখ। এই সিনেমা আপনাকে অনেককিছু শিখিয়ে দেবে। জরাজীর্ণ আইন কানুন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের আদ্যোপান্তের পরিচিতি সহ। সব মনুষ্য ঈশ্বরের শাস্তির জন্য বসে থাকে না।

বুকের খুব কাছে কেউ ছোরা ঢুকালে, তখন সে ঈশ্বর হয়ে ওঠে। আমি এই সিনেমার শেষদৃশ্য দুইবার দেখতে পারিনি। আপনিও পারবেন না।

Watch Link

🎁 ‘মনস্তত্ত্ব’
🎬 Nocturnal Animals (2016)

১৯৯৩ সালে প্রকাশিত অস্টিন রাইটের ‘টনি এন্ড সুসান’ উপন্যাস অবলম্বনে বানানো এই সিনেমা আমি দেখেছিলাম বেশ কয়েকবছর আগে। এবং আমি এর নাম দিয়েছিলাম, বিষন্নতার পারফেক্ট সমার্থক।
গল্পটা হচ্ছে।

সুসান ও এডওয়ার্ড। যারা একে অপরকে পছন্দ করে বিয়ে করেছিল। সুসান ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে, মা মেনে নেয়নি কোনো এভারেজ ছেলের সঙ্গে কন্যার বিয়ে। ফলে পরিবারের অমতে বিয়ে করতে হয়েছিল তাকে। এবং ছাড়তে হয়েছিল তার একটা গুরুত্বপূর্ণ স্বপ্ন।

যেটার ফ্রাস্ট্রেশনের ছাপ পড়ে সংসারে। ঝগড়া হয়। দূরত্ব বাড়ে। এবং সুসান প্রেমে পড়ে অন্যকারোর। এডওয়ার্ড থেকে লুকিয়ে করে ফেলে ভয়াবহ একটা অপরাধ।

এডওয়ার্ডের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়।
গল্পটা শুরু হয় তারপর। অনেক বৎসর পর। যখন সুসান স্বপ্ন পুরণ করে অতিবাহিত করছে নিজের হাতে তৈরী করা দারুণ (!) একটা জীবন। স্বামী, সন্তান। এবং ঠিক ঐ সময়ে তার নিকট আসে একটা বই। এডওয়ার্ডের লেখা। এই বইটা এডওয়ার্ড উৎসর্গ করেছে সুসানকে। সুসান পড়তে শুরু করে।
ব্যাস।

একসঙ্গে তিন সময়ের গল্প দেখানো হয়। সুসানের বর্তমান জীবন। সুসান ও এডওয়ার্ডের অতীত সম্পর্কের গল্প। ও উপন্যাসের গল্প। তিনটা মিলিয়ে মিশিয়ে বানানো এই দুর্দান্ত সিনেমা তোলপাড় করা বিষন্নতা বুকে গেঁথে দেবে আপনার।

একটা সম্পর্ক কীভাবে মরে যায়! আহা! আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এই সিনেমার পরিচালক ‘সম্পর্কের জটিলতায়’ ভুগা প্রচণ্ড একা কমসে কম হাজারখানেক মানুষের খুব কাছে সপ্তাহখানেক বসে থেকে এই স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। অদ্ভুত একটা উপন্যাস কীভাবে গেঁথে যায় মনে!

কীভাবে হাঁটাচলা করতে শুরু করে পশমের গোড়ায় গোড়ায়। কীভাবে রাত জাগায়। আপনি অনুভব করবেন।
একটা প্রশ্ন।

‘প্রিয় মানুষটির বিশ্বাসঘাতকতার সবচেয়ে সুন্দর শৈল্পিক উপায়ে প্রতিশোধ নিতে পারে কে জানেন?’

একজন লেখক। জি। রেস্টুরেন্টে এডওয়ার্ডের অপেক্ষায় বসে থাকা সুসানের তৃষ্ণার্ত চক্ষুজোড়া হচ্ছে আমার দেখা যেকোনো সিনেমার সবচেয়ে সুন্দর শৈল্পিক ও চমৎকার প্রতিশোধ। আমার ভীষণ পছন্দের একটি দৃশ্য।

বিশেষ সতর্কতা। লেখকের সঙ্গে বিচ্ছেদ দূরে থাক, প্রেমও করতে যাবেন না কখনও।

Watch Link

🎁 ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধ’
🎬 Shyamol Chhaya (2005)

আমাদের হুমায়ূন আহমেদ। এই ব্যক্তি কাগজে তো ছাপ রেখেছেন, কাগজের বাইরে যেখানে পা দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন।

এই ব্যক্তির হাত ধরে আমরা পেয়েছি কালজয়ী কিছু নাটক। পেয়েছি হারিয়ে যেতে বসা কিছু গান। পেয়েছি আরও কিছু হীরের টুকরো। এবং একটি ‘শ্যামল ছায়া।’

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশকিছু সিনেমা তৈরী হলেও আমি এই সিনেমা এইখানে রাখলাম। কেননা দুই আড়াই ঘন্টায় আপনি একটা নৌকায় পুরো বাংলাদেশ তুলে আনতে পারবেন না। একটি নৌকায় কেন, একটি আস্ত শহরেও পারবেন না।

অথচ হুমায়ূন পেরেছেন। এত সুন্দর। পুরো সিনেমায় যুদ্ধের কোনো দৃশ্য না দেখিয়েই যুদ্ধের ভয়াবহতা হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিয়েছেন। টের পাইয়ে দিয়েছেন কিছু নামহীন সম্পর্ক! টের পাইয়ে দিয়েছেন মুদ্রার এইপিঠ ওইপিঠ।
হুমায়ূন কেন অসাধারণ জানেন?

তিনি কখনই কোনো চরিত্র স্পষ্ট করেন না। কখনই না। আমরা যে চোখে দেখি মানুষকে, ঐ চোখে তিনি দেখেন না। আমরা দেখি শুধুই ভালো, শুধুই মন্দ। উনি উল্টো দেখেন তাও না। উনি ভিন্ন দেখেন।

ফলে উনার সিনেমার চরিত্রগুলো হয়ে ওঠে স্তরে স্তরে ভাগ ভাগ। কখনও সাদা। কখনও কালো। মিলিটারি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে বেড়ানো নিকৃষ্ট রাজাকারটাও জীবন বাঁচানোর বিনিময়ে কারোর ক্ষতি না করে নৌকা ছেড়ে দেয়।

‘বাংলাদেশ পাকিস্তান ভাই ভাই’ বলা মওলানা যুদ্ধবন্দী হয়ে ফেরত আসার পর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে খোদার হাতে সোপর্দ করে কাঁপতে কাঁপতে চরম ক্রোধে বন্দুক তুলে নেয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে।

সমস্তদিন কানে রেডিও নিয়ে বসে থাকা অকর্মার ঢেঁকিটাও একটা সময় পর মুক্তিযোদ্ধার হাত ধরে অনুরোধ করে, আমাকেও নেন সঙ্গে। কথায় কথায় ‘নৌকা ছেড়ে যাওয়ার’ হুমকি দেয়া রগচটা মাঝিটা নৌকা সত্যি সত্যি ছেড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ পর কাঁধে কাঁঠাল নিয়ে ফেরত আসে আর বলে, ‘আমি ভালো লোক না। আমি মন্দ লোক। আমি শিশি খাওয়া লোক।’

এই সিনেমার গল্প বলার প্রয়োজন নেই। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ছোট্ট একটা অংশ এত সুন্দর করে উপস্থাপন করেছেন হুমায়ূন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেরা সিনেমার কাতারে অনায়াসে এই সিনেমা ঢুকে যাবে। বাজেট ছিল না। কোথাও পড়েছিলাম, হুমায়ূন বাজেট নিয়ে আফসোস করেছিলেন।

বাজেট যদি থাকতো, এই সিনেমাকে তিনি অনন্য পর্যায়ে পৌঁছে দিতেন নিঃসন্দেহে। তারপরও এইটুকুনেই যা করেছেন, তা ইতিহাস। আমি এই সিনেমা কতবার দেখেছি হিসেব নেই। এত সুন্দর!
একটা দৃশ্যে প্রতিবার চোখে জল জমে যায়। যখন মওলানা ফেরত আসে।

আর পুরো সিনেমায় শক্ত পাথর হয়ে থাকা নারীটি পাশে বসে থাকা শশুরকে কান্নাভেজা স্বরে বলে, ‘সবাই ফিরে আসে, আপনার ছেলে কেন ফেরে না বাবা? সবাই ফিরে আসে, আমার বাবু কেন ফিরে না বাবা?’

Watch Link

🎁 ‘সৌন্দর্য’
🎬 In The Mood For Love (2000)

সিনেমার সৌন্দর্য সম্পর্কে আমায় তুমুল ভাবিয়েছিল এই সিনেমা। ভালোবাসা, সম্পর্ক, মনস্তত্ত্ব, বিচ্ছেদ, জীবন, সংসার… সর্বদিক দিয়ে একটা সিনেমা কতটা সুন্দর হতে পারে, এরচেয়ে দারুণ উদাহারণ আমি আর কোথাও খুঁজে পাই না।

ইন দ্য মুড ফর লাভ শুধুই একটি সিনেমা নয়, এটি তার বাইরের কিছু।

দুই জোড়া বিবাহিত দম্পতি। তারা পাশাপাশি বাস করেন। এবং সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছে না কোনো জোড়ারই। কেননা, দুজনের সঙ্গীই সঙ্গী থেকে লুকোচ্ছেন কিছু। পরকীয়া!

বিশ্বাসঘাতকতা করছেন। বিষয়টা খতিয়ে দেখতে দেখতে বাকি জোড়াও প্রাসঙ্গিক কারণবশত জড়িয়ে যান একটা সম্পর্কে। তবে তারা কথা দিয়েছেন একে অপরকে। কখনই বিশ্বাসঘাতক সঙ্গীর মতোন হবেন না।

এইভাবে বুঝি ভালোবাসা হয়?
আমি এই সিনেমার গল্পটি আরও সহজ উপায়ে বলতে পারতাম। এইভাবেই বললাম। সম্পর্কের জটিলতা ও মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্ধ এই সিনেমার প্রধান উপকরণ।

সম্পর্ক নিয়ে জানতে চাইলে আপনাকে এই সিনেমা ধরিয়ে দেওয়া হবে। মিউজিক বুঝতে চাইলে আপনাকে এই সিনেমা ধরিয়ে দেওয়া হবে। ঘনঘোর বিচ্ছেদ কত প্রকার ও কী কী দেখতে চাইলে আপনাকে এই সিনেমা ধরিয়ে দেওয়া হবে।

সিনেমা নিয়ে পড়াশুনা করতে চাইলেও আপনাকে এই সিনেমা ধরিয়ে দেওয়া হবে। আমি ক্যামেরা অত বুঝি না। যারা সিনেমাটোগ্রাফি ভালো বুঝেন, তারাই স্বীকার করেন এই সিনেমা একটা হীরে।

এই সিনেমার ফ্রেম, লাইটিং আর মিউজিক নিয়ে এতগুলো ইউটিউব ভিডিও রয়েছে, দেখার জন্য খরচ করতে হবে পুরো এক সপ্তাহ।

২০১৫ সালে বুসান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল কর্তৃক তৈয়ার করা হান্ড্রেড এশিয়ান সিনেমার লিস্টে এটিকে রাখা হয়েছে তিন নাম্বারে।

২০১৬ সালে বিবিসির তৈয়ার করা হান্ড্রেড গ্রেটেস্ট ফিল্মস অব দ্য টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি লিস্টে এটিকে রাখা হয়েছে দুই নাম্বারে। এবং ২০১৯ সালে দ্য গার্ডিয়ানের তৈয়ার করা বেস্ট ফিল্মস অব দ্য টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি লিস্টে এটি রয়েছে পাঁচ নাম্বারে।

প্রায় পঞ্চাশটা নমিনেশন ও ছেচল্লিশটা এওয়ার্ড জেতা এই সিনেমা এখনও আমি সময় পেলে দেখে ফেলি। মন খারাপ থাকলে দেখে ফেলি। মন ভালো থাকলেও দেখে ফেলি।

যতদূর আমি জানি পরিচালক এই সিনেমার স্ক্রিপ্ট আগ থেকে লিখে রাখেননি। স্ক্রিপ্টই ছিল না।

চরিত্রগুলোর ভেতর ঢুকে তাদের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্ধ নিখুঁতভাবে অবলোকন করে পরের দৃশ্য লেখা কিংবা শ্যুটিং হতো। দূর্ধর্ষ! ইন দ্য মুড ফর লাভ মূলত একটা ট্রিলজির মাঝখানের অংশ। এর আগে হয়েছে ডেইজ অব বিং ওয়াইল্ড। এবং এর পরে ২০৪৬।

সিনেমা যে একটা সৌন্দর্য, আপাদমস্তক অবলোকন করার জন্য হলেও আপনি এই সিনেমা দেখুন। মিউজিক আপনার কানে লেগে থাকবে। স্লো মোশনে চরিত্রগুলোর সিড়ি বেয়ে ওঠা, হাঁটা এবং থমকে দাঁড়িয়ে থাকা। সিগারেট খাওয়ার একটি দৃশ্য আছে।

পেছনদিক থেকে। মাথার উপর লাইট। হাতটা সামান্য উঁচু। ধোঁয়া উড়ছে উপরে। অস্পষ্টতা এই সিনেমার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। একটা পর্যায়ে গিয়ে ধরে নেওয়া মুশকিল, ওরা একে অপরের সঙ্গে হাঁটছে? নাকি ছায়া হাঁটছে শুধু?

আমার সবচেয়ে পছন্দের দৃশ্যটি দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে সিনেমার একদম শেষে। লোকটি দাঁড়িয়ে আছে একটা পুরাতন বিল্ডিং-এর কাছে। ওখানকার দেয়ালে একটা গর্ত। লোকটি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ঐ গর্তের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে। গোপন। তারপর ঐ গর্ত ঘাস দিয়ে ভরাট করে দেয়। কেন?

এবং এই দৃশ্য আমার এত পছন্দের কেন?
জানার জন্য হলেও সিনেমাটা দেখে ফেলুন। আপনিও পছন্দ করে ফেলবেন। আপনারও অনেক গোপন আছে। আমরা বড্ড গোপন পুষি।

Watch Link

এই হলো বারো’টা সিনেমা। প্রতিটি সিনেমা নির্দিষ্ট কিছু দিক দিয়ে সেরা। যেহেতু আমার পছন্দের তালিকা, আপনার সঙ্গে নাও মিলতে পারে। ইটস ওকে।

লিখেছেন: সাখাওয়াত হোসেন