গেজেট প্রকাশের পর হতে যোগদানের পূর্ব পর্যন্ত সময়কে নাকি বলা হয় চাকুরি জীবনের হানিমুন পিরিয়ড।

৩৮ তম বিসিএসের গেজেটভুক্ত হওয়া ২১২৯ জন ভাগ্যবান নিশ্চয়ই তাঁদের কাঙ্ক্ষিত সেই ‘হানিমুনের’ সূচনালগ্নে প্রিয়জনদের ক্রমাগত শুভেচ্ছা-অভিনন্দন – প্রশংসার বৃষ্টিতে সিক্ত হয়ে চলেছেন। তাই ধরে নিতে পারি, আমার মতো একজনের অভিনন্দন না পেলেও তাদের তেমন কিছুই আসবে-যাবে না।

পক্ষান্তরে সৌভাগ্যবানদের এই আনন্দ উল্লাসধ্বনির মাঝে যে কতিপয় দুর্ভাগার বুকফাটা হাহাকার চাপা পরে আছে, সোনার পেয়ালা হাতে পেয়েও সেটি হারিয়ে ফেলার মতো দুর্ভাগ্যের শিকার হয়ে যারা অনিশ্চিত ভবিষতের অশুভ ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন, ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ায় নানা কারণে অযোগ্যঘোষিত হয়ে গেজেট বঞ্চিত সেই ভাগ্যবিড়ম্বিতদের উদ্দেশে দুয়েকটি কথা বলার তাড়না থেকেই আমার আজকের এই লেখা।

আশা করি, এর মধ্য দিয়ে হয়ত ক্ষীণ সলতের নিভুনিভু জ্বলতে থাকা প্রদীপ নিয়ে বিস্তৃত অকূল পাথার পাড়ি দেওয়ার সময়ে একটা গন্তব্যের দিশা অন্তত তারা খুজে পাবেন।

মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে প্রথমে জানা প্রয়োজন, বিসিএসসহ যে কোন সরকারি চাকুরির ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ায় কি কি বিষয় একজন প্রার্থীর জন্য বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে-

১.ফৌজদারি মামলা বা গুরুতর অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হলে

২.তদন্তকারী কর্মকর্তার অনুসন্ধানে প্রার্থীর নেতিবাচক স্বভাবচরিত্রের অধিকারী হওয়া বা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেলে

৩. স্থায়ী ঠিকানার বিষয়ে ভুল তথ্য প্রদান করে চাকুরিতে সুপারিশকৃত হয়ে থাকলে

৪.অমুক্তিযোদ্ধার সন্তান মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আবেদন করে থাকলে

৫. কোন সরকারি চাকুরিতে নিয়োজিত থাকলে, সেখানকার ইউনিট প্রধান কর্তৃক যাচাইকারি কর্মকর্তার সম্মুখে প্রার্থী সম্পর্কে গুরুতর শৃঙ্খলা অভিযোগ উত্থাপিত হলে

৬. দেশবিরোধী সন্দেহভাজন গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে থাকলে ( যেমন আপনি বা আপনার বাবামা ভাইবোন বা কোন নিকটাত্মীয় যদি বিপজ্জনক কোন সংগঠনের সক্রিয় সদস্য হয়ে থাকেন)

৭. বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রমাণ না করতে পারলে- উদাহরণস্বরূপ, কোন রোহিঙ্গা হয়তো ভুয়া পরিচয়ে বাংলাদেশে সরকারি চাকুরী নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে।

৮.এছাড়াও পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় তদন্তকারী কর্মকর্তার সাথে অশোভন আচরন বা অসহযোগিতাপুর্ণ মনোভাব প্রদর্শনও কখনো কখনো হয়ে উঠতে পারে বিপদের কারণ।

গেজেটে নাম না আসলে করনীয় :

এত এত পরিশ্রম – সাধনা- অধ্যাবসায়ের সিঁড়ি বেয়ে চাকুরির চুড়ান্ত সুপারিশ পাবার পর গেজেটে বাদ পড়ে যাওয়া- আপনার জীবনের কঠিনতম এই সময়টা নিঃসন্দেহে চরম হতাশার। কিন্তু হতাশায় ডুবে থাকাটা যেহেতু এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার ক্ষেত্রে আপনাকে কোনরকম সাহায্য করছে না, তাই এ সময়ে আপনার একমাত্র করনীয় হলো, মুহুর্তকাল সময়ও অপচয় না করে এই সুকঠিন বিপদকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে কাজে নেমে পড়া।

১. কথায় আছে না, ‘একতাই বল’! ঘোর অমানিশার নিকষ কালো এ রাতে একা পথচলার চিন্তা বাদ দিয়ে, অন্য সহযোদ্ধাদের হাতে হাত রেখে বিপদ থেকে উদ্ধার প্রচেষ্টায় ব্রতী হোন। প্রথমেই খুঁজে বের করুন আপনার সেই দুর্ভাগা সহযাত্রীদের যারা নানা কারনে আপনার মতো একই ভাগ্য বরণ করেছেন। জীবনের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির প্রশ্ন যেখানে জড়িয়ে, সেখানে লজ্জাসংকোচের বিলাসিতা না করে আপনার সংশ্লিষ্ট বিসিএস গ্রুপে দুর্ভাগাদের সাড়া চেয়ে ছোট্ট একটি পোস্ট দিন।

দেখবেন, অনেকেই যোগাযোগ করছে। সবার মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তৈরি করুন। প্রয়োজনে আলাদা একটা ফেসবুক গ্রুপও হতে পারে। মনে রাখবেন, আগামী কয়েক মাস/বছর একমাত্র এরাই আপনার সুখদুঃখের একমাত্র সারথি। (আপনারা চাইলে এই অধমকেও সেই গ্রুপে রাখতে পারবেন। সাথে থাকব, পাশে থাকব- প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, ইনশাআল্লাহ)।

২. কালবিলম্ব না করে যতদ্রুত সম্ভব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করুন।সেখান থেকে আপনি জানার চেষ্টা করবেন, ঠিক কি কারনে আপনি অযোগ্য ঘোষিত হয়েছেন। যদি কোন তথ্যগত কারনে বাদ পড়ে থাকেন, সেই তথ্য যথাযথ প্রক্রিয়ায় জমা দিন। আর বাদ পড়ার কারন যদি হয় কোন অপরাধ বা অযোগ্যতার দায়ে ভুলভাবে অভিযুক্ত হওয়া, তাহলে পুনভেরিফিকেশনের প্রক্রিয়া শুরুর জন্য আবেদন করুন।

৩. আপনার বিরুদ্ধে বিচারাধীন মামলা থাকার কারনে যদি বাদ পড়ে থাকেন, তাহলে পূন:ভেরিফিকেশনের প্রক্রিয়া শুরুর আগেই যতদ্রুত সম্ভব সেটি নিষ্পত্তি করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। সত্য বা মিথ্যা যেমন মামলাই হোক ( যদিও একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা হল, মামলা তদন্ত বা অন্য যে কোন অধিক্ষেত্রে আজ পর্যন্ত আমি কাউকে বলতে শুনিনি যে, তার বিরুদ্ধে রুজুকৃত মামলাটি সত্যি।

ষড়যন্ত্র তত্ত্বই এক্ষেত্রে আপাত জনপ্রিয় ধারনা হিসেবে প্রদর্শিত হতে দেখা যায়) মামলার বাদীপক্ষকে যেভাবে পারেন, ম্যানেজ করার চেষ্টা করুন । প্রয়োজনে মেম্বার-চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহায়তা নিন।

৪. >>যদি এলাকার /শত্রুভাবাপন্ন প্রতিবেশীরা ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আপনার গেজেটের পথ রুদ্ধ করে থাকেন, তাহলে পুন:তদন্তকারীকে সে বিষয়ে অবহিত করে সঠিক তথ্য প্রমাণাদি উপস্থাপন ও আপনার উপযুক্ততা প্রমাণে ব্রতী হবেন।
>>মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট বা কোটার প্রাপ্যতা সম্পর্কে কোন ঝামেলা যদি হয় আপনার গেজেট আটকে যাওয়ার কারন, তাহলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সহযোগিতা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সেটি নিষ্পত্তি করে নিন।

৫. তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং (আপনি সরকারি চাকুরিরত থাকলে) আপনার ইউনিট প্রধানের সাথে বিরাজমান বিরূপ সম্পর্ককে ( যদি থাকে) অবিলম্বে মধুময় সম্পর্ক দ্বারা প্রতিস্থাপন করে নিবেন। বিপদে আপনিই পড়েছেন, তাই সবক্ষেত্রে আপনার বিচারবুদ্ধির সর্বোচ্চ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে ভুল করবেন না।

৬. আর সত্যিকারেই যদি আপনি দেশবিরোধী, নাশকতাপন্থি শক্তির সক্রিয়-পদস্থ সদস্য হয়ে থাকেন,তাহলে স্যরি, আপনার জন্য এক বালতি সহানুভূতি ছাড়া আমার কাছে আর কোন আশার বাণী নেই। এমনকি আমি নিজেও (এবং আমি নিশ্চিত, আমার অন্যসব সহকর্মীবৃন্দও) চাই না যে, আপনার মতে কুলাঙ্গার আমাদের সহকর্মী হন।

৭. সবশেষে বলব, এই পূন:গেজেটের পুরো ব্যাপারটি ধৈর্যের চরম পরীক্ষা নেওয়া একটি কষ্টকর-দীর্ঘ ভ্রমণ মাত্র। আপনি নিজের সম্পর্কে যদি নিঃসংশয় থেকে থাকেন, তাহলে এখানে আপনার সফলতার সম্ভাবনা ১০০%। যোগ্যতাবলে অর্জন করে নেওয়া প্রজাতন্ত্রের চাকুরিতে নিয়োজিত হবার সুযোগ থেকে কেউ আপনাকে চিরকাল বঞ্চিত রাখতে পারবে না। আজ হোক, দুদিন পর হোক, আপনার প্রাপ্য গেজেট আপনি পাবেনই।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করি, ৩৪ তম বিসিএসের পুলিশ ক্যাডারে মোট সুপারিশকৃত ১৫০ জনের মধ্যে ৭ জন প্রথম গেজেটে বাদ পড়ার ফলে আমাদের সাথে মৌলিক প্রশিক্ষণে যোগ দিতে পারেন নি। কিন্তু পুন: ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দুয়েকজন বাদে তারা প্রত্যেকেই পরবর্তীতে গেজেটভুক্ত হয়েছেন। সুতরাং হাল ছেড়ে না দিয়ে নিজের তীব্র ইচ্ছাশক্তি জাগিয়ে তুলে দাঁতেদাঁত চেপে লড়াই অব্যাহত রাখুন আর দিন গুনতে থাকুন। জয় হবেই।

আর মনে রাখবেন, পূন:ভেরিফিকেশন করে গেজেটে আপনার নাম প্রকাশের প্রয়োজনটা যতটা না তদন্তকারী বা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাবৃন্দের, তারচেয়ে বেশি আপনার। তাই নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা ও নিয়মিত পারসু করে যাওয়ার বিকল্প নেই। পাশাপাশি অন্তত পুন:গেজেটে আপনার নাম প্রকাশিত হবার আগ পর্যন্ত সময়ে ইউএনও, সার্কেল এএসপি, ওসি এবং এনএসআই এর জেলা ও উপজেলার কর্মকর্তাবৃন্দের সাথে একটা সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করুন। কারনটা তো বোঝেনই, কী আর বলব!

আর যদি প্রয়োজন মনে করেন, যে কোন সময়, যে কোন পরামর্শের জন্য নিঃসঙ্কোচে আমাকে নক করতে পারবেন। কথা দিচ্ছি, ক্ষুদ্রজ্ঞানে আপনার এ সময়ের করনীয় বিষয়ক দিকনির্দেশনাগুলো দেওয়ার সাধ্যমত চেষ্টা করব। আসলে ‘যারা সফল হয়েছেন’ তাদের তুলনায় ‘যারা সফল হবেন’ তাদের সাথে থাকাটাই আমার বেশি পছন্দ। আপনারা সবাই আমার শুভকামনা জানবেন।।

Md. Anwar Hossan (Shamim Anwar)

সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি), রাঙ্গুনিয়া সার্কেল, চট্টগ্রাম। ৩৪তম বিসিএস (পুলিশ)।
[লেখাটি পূর্বের কোন এক বিসিএসের সময় প্রথম লিখেছিলাম, এখন প্রয়োজনীয় সংশোধনীসহ রি-রাইট]।