Abdullah Al Mamun, Meta:
স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার, বুয়েটে পড়ার।
কিন্তু বছরের অর্ধেক সময়ই অসুস্থ থাকতাম একুইট অ্যাজমা আর বাতজ্বরে, ফলে SSC তে ডাব্বা।
কিন্তু তাতে কি, ভাঙ্গা শরীর আর বাজে রেজাল্ট নিয়েই ভর্তি পরীক্ষা দিলাম নটরডেম, বিজ্ঞান, রেসিডেনশিয়াল সহ অনেক কলেজে।
ফলাফল, সবকটি থেকে রিজেক্ট। বুঝতে বাকি রইল না যে, আমি শুধু শারীরিক ভাবেই না, মেধায়ও দুর্বল। অবশেষে ভর্তি হলাম পলিটেকনিকে, তাও যদি ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নটা বেঁচে থাকে!
কিন্তু তাতেই চারদিকে উপহাস শুরু হয়ে গেলঃ তোমার বাবা একজন ফার্স্টক্লাস সরকারী কর্মকর্তা আর তুমি হবা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার! আরও কত কি!
যাইহোক, একদিন ক্যাম্পাসে হঠাৎ দেখি আনন্দ মিছিল! কারন ছিল পুরো পলিটেকনিকে শুধুমাত্র একজন সিনিয়র ভাই DUET এ চান্স পেয়েছেন! খুশি হলাম এই ভেবে যে, যাক BSc ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পথ তাহলে এখনো খোলা আছে!
কিন্তু ডুয়েট আমাদের কাছে একটি স্বপ্ন একই সাথে একটি আতঙ্কের নাম, কারন দেশের লক্ষ লক্ষ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা লড়বে এই একটি মাত্র বিশ্ববিদ্যলয়ের জন্য।
আন্যদের মত আমিও সেই স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম এবং পাস করেই কোচিং এ ভর্তি হয়ে গেলাম। কিন্তু ইন্টারনাল ঝামেলার জন্য সেই বছর কোন এডমিশান টেস্টই হল না, ফলে অনেকই কোচিং ছেড়ে চলে গেল, ভর্তি হল প্রাইভেট ভার্সিটিতে।
হাল ছাড়লাম না, চালিয়ে গেলাম পড়াশুনা। ভাগ্যক্রমে, চান্সও পেয়ে গেলাম CSE তে।
ডুয়েটে ৪র্থ বর্ষের শেষের দিকে, যখন থিসিস লিখছিলাম আর মাথায় টেনশন ছিল পাশ করার পর কি করব! অপশন ৩টিঃ সরকারী চাকুরী, প্রাইভেট কোম্পানিতে জব আর না হয় বিদেশে উচ্চশিক্ষা।
আমার রুমমেটের জিআরই আর টোফেল পরা দেখে আমারও ইচ্ছা জাগত আম্যেরিকায় উচ্চশিক্ষার। তাই থিসিস লেখার সময়টা জিআরই তেই দিলাম। ফলে থিসিসে খারাপ করে ফাইনাল সিজিপিএ কমে গেল।
দুঃখ এখানেই শেষ না, আমি ম্যাথ আর ইংলিশে এতটাই বাজে যে জিআরই তে পেলাম ১৬০০ তে মাত্র ৯৫০, যা দিয়ে কোথাও এপ্লাই করা সম্ভব না।
দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে স্বল্প বেতনে জয়েন করলাম কিন্তু হাল ছাড়লাম না, IELTS এর জন্য প্রিপারেশান নিলাম।
কিন্তু মাত্র ৬.৫ পেতে আমাকে দুবার পরীক্ষা দিতে হল। ভাবলাম এখন এমন দেশের জন্য ট্রাই করি যেখানে জিআরই লাগে না।
অফারও পেয়ে গেলাম একটা জার্মান ইউনিভার্সিটি থেকে কিন্তু বাধা হয়ে দাড়াল টাকা, কারণ জার্মান ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন নেয়ার জন্য প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা শুধু দেখাতেই হয় না সাথেও নিয়ে যেতে হয়, পরে অবশ্য সব টাকা ফেরত দেয়।
বাবা বললেন, সরকারি চাকুরী করি এত টাকা কই পাব! জমি বিক্রি কর। শুনে অনেক কষ্টে স্বপ্নটা দমিয়ে রাখলাম।
এর মধ্যে বিয়ে হল, সংসার হল। হঠাৎ একদিন ইমেইল পেলাম সৌদি আরবের কিং ফাহাদ ইউনিভার্সিটি থেকে যে “আপনি কন্ডিশ্নালি একসেপ্টেড” মানে আমাকে আবার জিআরই দিতে হবে।
খুশিতে মুখটা কালো হয়ে গেল। কিছুদিন পর রিপ্লাই দিলাম “আমার পক্ষে পুনরায় জিআরই দেয়া সম্ভব না। এই স্কোরে পসিবল হলে আমি যেতে আগ্রহী” উত্তর আসল “ইয়েস” কিন্তু প্রথম সিমিস্টারে CGPA ৩.৫ এর উপরে পেতে হবে।
আমার সুসংবাদ শুনে সবাই বলতে লাগল, কেউ সৌদিতে যায় ইঞ্জিয়ারিং পড়তে?!!! তুমি আরবি জান?! ইত্যাদি। কারো কথায় কান না দিয়ে চলে এলাম মরুর দেশে।
যাইহোক, ভালই চলছিল মাস্টার্স …। কিন্তু শেষদিকে কাজের প্রেসার এত বেশি ছিল যে ল্যাবে ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করা লাগত। সামার চলে আসল, দেশে যাওয়ার জন্য বছরে ছুটি এই একটাই।
হাল ছাড়লাম না, দেশে না গিয়ে থিসিসের ব্যস্ততার মাঝেই আবারও জিআরই জন্য রেজিস্ট্রেশন করলাম। ছুটিতে সবাই দেশে চলে গেল, আমি হলের ৩য় তলায় আর নিচ তোলায় এক নাইজেরিয়ান সিনিয়র।
ক্যাম্পাস এতটাই ফাকা যে রাতের বেলায় চিৎকার করে ডাক দিলেও কেউ সাড়া দিবে না। কথা বলার আর কেউ থাকলো না। আমার মাস্টার্স ছিল রোবটিক্স নিয়ে।
কিছু দিন পর আমাকেও রোবট গোত্রের একজন ভাবতে শুরু করলাম আর মাঝে মাঝে আমার রোবটের সাথেই কথা বলতাম।
ছুটিতে ক্যফেও বন্ধ হয়ে গেল। তাই বাংলাদেশি হোটেল থেকে খাবার এনে ফ্রিজে রেখে দিতাম আর পুরো সপ্তাহ গরম করে খেতাম। এর মধ্যেই দিনে ল্যাবে থিসিস আর রাতে জিআরই চলতে থাকল।
জিআরইর রেজাল্ট দিল, এইবার মোটামুটি এপ্লাই করার মত স্কোর পেলাম। MS শেষে কাতার ইউনিভার্সিটি থেকে জবের অফার পেলাম, জয়েন করে ওখান থেকেই প্রেফেসরদের ইমেইল করতাম।
প্রোফাইল ভাল না হওয়ায় খুব একটা রিপ্লাই পেতাম না। তারপরও ডিসেম্বরের মধ্যে ৫টা ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করে দিলাম।
অবশেষে দীর্ঘ ৩ মাস অপেক্ষার পর দুটি ইউনিভার্সিটি থেকে ফুল ফান্ড স্কলারশিপের অফার পেলাম।
শুরু হয়ে গেল FIU তে PhD জার্নি। যাইহোক, পিএইচডিতে টিচিং এসিস্টান্ট এর দায়িত্ব পালনের সময়ই বুঝতে পারলাম যে, আমার ভেতরে টিচিং ম্যাটেরিয়াল নাই।
তাই সবসময় মাথায় ঘুরপাক খেত যে, পাশ করে আমি কি করব! পথ একটাই তা হল ইন্ডাস্ট্রিতে জব করা। কিন্তু এই পথের সব চেয়ে বড় বাধা হলঃ কোডিং বা প্রোগ্রামিং কম্পিটিশান। সেই অভিজ্ঞতাতো আমার শূন্য!!
জীবনে শুধুমাত্র একবারই প্রোগ্রামিং কম্পিটিশানে অংশগ্রহণ করছিলাম তাও আবার ফ্রিতে টি-শার্ট পাওয়ার জন্য।
সবারই জানা যে, ফেসবুক/গুগলের মত জায়েন্ট কোম্পানির জব ইন্টার্ভিউ যে কত ভয়াবহ কঠিন হয়। তা সত্ত্বেও, আমি ফেসবুক/গুগল কেই টার্গেট করলাম।
সাত পাঁচ না ভেবে, সাহস করে জিরো থেকে কোডিং প্রাকটিস শুরু করে দিলাম। কিন্তু Leetcode এ প্রব্লেম সল্ভ করতে গিয়ে দেখি, সল্ভ তো দুরের কথা আমি প্রশ্নই বুঝি না। হতাশ হয়ে যেতাম যখন দেখতাম সারাদিনে মাত্র একটি easy প্রবলেমও সল্ভ করতে পারিনি!!
হাল ছাড়লাম না, weekdays এ ল্যাবের কাজ শেষ করে রাতে প্রাকটিস করতাম আর ছুটির দিন কাজে লাগাতাম।
মাস দুয়েক পর আবিষ্কার করলাম যে আমি এখন নিজে নিজেই easy প্রবলেম সল্ভ করতে পারি। আরও কয়েক মাস প্রাকটিসের পর বুঝতে পারলাম আমি এখন ইন্টারভিউয়ের জন্য রেডি।
আপ্লাই শুরু করে দিলাম জায়েন্ট সব কোম্পানিতে। বড় বড় কোম্পানিতে ইন্টারভিউ যেমন কঠিন, ইন্টারভিউয়ের ডাক পাওয়া তারচেয়েও কঠিন।
শ’খানেক রিজেকশান ইমেইল পাওয়ার পর বুঝতে পারলাম, আমার Resume আর LinkedIn প্রোফাইল রেডি না। অন্যদিকে দুএকজন ছাড়া পরিচিত তেমন কেউ নাই যে আমাকে ঐসব কোম্পানিতে refer/recommend করবে।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর, প্রথম ডাক পেলাম Intel থেকে। ২ রাউন্ড ইন্টার্ভিউ পাশ করার পর, ডাক পেলাম ফাইনাল রাউন্ডের। মাত্র ১৩ পর্বের ফাইনাল রাউন্ড টেনেটুনে ভালই দিলাম।
কিন্তু কয়েকদিন পর ইনবক্সে রেজেকশান ইমেইল দেখে দুঃখে কষ্টে মনে হচ্ছিল এই রাস্তা মনে হয় আমার জন্য না, বাদ দিয়ে দিব!
যাইহোক হাল ছাড়লাম না, একে একে ডাক পেলাম Roku, FeedEx, Nike, Stripe, LinkedIn, Tesla, Uber এর মত বড় বড় কোম্পানি থেকে।
কিন্তু ফাইনাল সিমেস্টার, তাই একদিকে যেমন পিএইচডির কাজের প্রেসার অন্যদিকে ইন্টারভিউ। তারপরও সব ইন্টারভিউ ভালই দিলাম, আর মনে মনে আশা করতে থাকলাম যে, যদি মাল্টিপল অফার পাই, তাইলে কোনটাকে হ্যাঁ বলব!!
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই যে, সপ্তাহ না যেতেই একে একে সবগুলো কোম্পানি আমাকে রিজেক্ট করে দিল। শেষ বাতিটিও নিভে গেল, আশা করার মত আর কিছুই বাকি থাকল না।
এতগুলা রেজেকশান খাওয়ার পর কিভাবে সোজা হয়ে দাঁড়াব! কিভাবে আবার নতুন করে প্রাকটিস শুরু করব! কিছুই মাথায় আসছিল না। ঠিক সেই মুহূর্তে পাশে দাঁড়ালেন আমার বউ।
বললেন “দেখ, আমারা শুধু চেষ্টা করতে পারি, বাকিটা সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা, হালছেড় না”।
আন্যদিকে আব্বু আম্মু সবসময় দোয়া করতেন এবং সাহস দিয়ে বলতেন, লেগে থাকো বাবা, তোমার জব হবেই ইনশাল্লাহ।
এইবার এপ্লাই করে দিলাম ছোটবড় সব কোম্পানিতে। ডাকও পেলাম। ইন্টারভিউ দিতাম ঠিকই কিন্তু মনে কোন আশা রাখতাম না।
হতাশা যখন চরম পর্যায়ে আর মানসিক ভাবে ভেঙ্গে চুরমার, ঠিক তখনই একটা স্টার্টআপ কোম্পানি থেকে প্রথম জব অফার পেলাম। এটা যে কি আনন্দের তা ভাষায় প্রকাশ করার মত না।
এদিকে পিএইচডি ডিফেন্স দিয়ে দিলাম। এবং এর কিছুদিন পরপরই ফেসবুক থেকে ইন্টারভিউয়ের ডাক পেলাম, দীর্ঘ ৭ রাউন্ড রোলার কোস্টারের পর একদিন বিকেলে হঠাত ফেসবুক থেকে কল পেলাম!
বলল “আপনার সবগুলো ইন্টারভিউ ভাল হওয়ায় মেটা আপনাকে হেড অফিসে E4 Software Engnieer (ML) হিসেবে অফার করতে চায়!!………”
আনন্দে আমরা শুধু বাকরুদ্ধ হয়ে শুনছিলাম, যা এখন শুধুই ইতিহাস……
কেউ আপনাকে অবহেলা করবে, কেউবা উপহাস, কারও কাছে হয়ত তুচ্ছ, কেউবা খাটো করে দেখবে, কিন্তু আপনি তাৎক্ষনিকভাবে কথার মাধ্যমে উত্তর দিতে পারেন, অথবা সেগুলোকে শক্তিতে পরিণত করে আপনার কাজের মাধ্যমে উত্তর দিতে পারেন।
স্বপ্ন দেখতে ভয় পাবেন না, বড় বড় স্বপ্ন দেখুন, আপনার যোগ্যতা বা সামর্থ্যের বাইরে স্বপ্ন দেখুন। নিরাশ হবেন না, চেষ্টা চালিয়ে যান, অন্যের সাথে তুলনা করবেন না।
মনে রাখবেন, যত বড় সফলতা আপনি অর্জন করতে চাচ্ছেন, তার চেয়েও বড় মাপের ব্যর্থতা হজম করার শক্তি আপনার থাকতে হবে।
আপনার ঘড়িতে যখন সময় হবে তখন কেউ আপনাকে আটকাটে পারবে না। হাল ছাড়বেন না, একদিন আপনিও সফল হবেন।
Abdullah Al Mamun
Software Engineer (Machine Learning)
Meta (Facebook)
Menlo Park, California, USA