বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ শুরুর নয় বছর আগের থেকে শুরু, ১৯৬২ সাল। আইয়ুব খানের মার্শাল ল বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের অভ্যন্তরের কিছু মানুষ স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিন ছাত্রলীগ নেতার (সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ) উদ্যোগে গঠিত হয় “নিউক্লিয়াস”, যা “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ” নামেও পরিচিত। জয় বাংলা স্লোগানের উত্থান, জাতীয় পতাকা তৈরী ও উত্তোলন, জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণ সহ আরো অনেক নীতি কৌশল প্রণয়নই হয় এই নিউক্লিয়াসের হাত ধরে।
১৯৭০ সালের ৭ জুন (ছয় দফা দিবস বা মনু মিয়া দিবস) সিদ্ধান্ত হয়, শ্রমিক জোট ও ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানানো হবে। এ আয়োজনে বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার প্রদান করার সিদ্ধান্ত নেয় জয় বাংলা বাহিনী। কুচকাওয়াজ ও গার্ড অব অনারের দায়িত্ব আসে কাজী আরেফ আহমেদের উপর। “নিউক্লিয়াস” থেকে জয় বাংলা বাহিনীর ব্যাটালিয়ন ফ্ল্যাগ বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সাথে এও জানানো হয় এই ব্যাটালিয়ন ফ্ল্যাগই ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পতাকার সম্মান লাভ করবে।
১৯৭০ সালের ৬ই জুন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ১১৬ নম্বর রুমে পতাকা বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। আ স ম আব্দুর রব ও মনিরুল ইসলাম মণি (মার্শাল মণি) জানালেন পতাকার জমিন হবে ব্যাটল গ্রিন। শাহজাহান সিরাজ জানালেন মাঝখানে লাল কিছু একটা যেন থাকে, আর কাজী আরেফ আহমেদ জানালেন মানচিত্রের কথা যা হবে সোনালি রঙ এর (পাট ও সোনালি ধানের সাথে মিল রেখে)। তখন ঢাকায় ছিলেন অংকন শিল্পী কুমিল্লা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা শিবনারায়ণ দাস। সব কিছু ঠিক ঠাক। ঝামেলা বাঁধলো মানচিত্র নিয়ে। একটা মানচিত্র (বিশেষত বাংলাদেশের) সেলাই করে ঠিক ঠাকভবে পতাকায় বসানো ছেলেখেলা নয়।
মানচিত্রের ডিজাইনের জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের (বুয়েট) তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু একজনকে সাথে নিয়ে এলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন্নাহ হলে (বর্তমান তিতুমীর হল)। সেখানে তিতুমীর হলের ৪০৮ নম্বর কক্ষে থাকতেন হাসানুল হক ইনু সাহেবের কাজিন এনামুল হক। তার কাছ থেকে অ্যাটলাস নিয়ে সেই কক্ষেই ট্রেসিং পেপারে বাংলাদেশের মানচিত্রের ডিজাইনটা আঁকা হলো। আর এই ডিজাইনই (ট্রেসিং পেপারের) লাল বৃত্তের উপর বসিয়ে পতাকার উপর মানচিত্র আঁকার কাজ সম্পন্ন করেন শিবনারায়ণ দাস। এভাবেই বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সাথে বুয়েটের নাম জড়িয়ে রইলো।
উল্লেখ্য, অনেক প্রাতিষ্ঠানিক জায়গায় শিবনারায়ণ দাস কে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রূপকার বলা হয়ে থাকে যা মোটেই সমীচীন নয়। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ছিল একটা সামষ্টিক প্রয়াস যেখানে অনেক মানুষের অবদান জড়িত।
সেদিন ৭ই জুন, বঙ্গবন্ধুর হাতে লাঠিতে মোড়ানো সেই পতাকাটি তুলে দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে পল্টন ময়দানে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকাটি উত্তোলন করা হয়। ১৬ই ডিসেম্বর লাল সবুজের মাঝে সোনালি মানচিত্রের এই পতাকা হাতে নিয়েই বিজয়ীর বেশে মুক্তিযোদ্ধারা বাড়ি ফেরেন।
#রুধির_নৈবেদ্যে_বিজয়স্নাত_বাংলাদেশ

Thank to BUET Debating Society 

তথ্যসূত্রঃ
১। সামহ্যোয়ার ইন ব্লগঃ https://www.somewhereinblog.net/blog/khomany01/29898736
৩। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে র ও সিআইএ এর ভূমিকা—–মাসুদুল হক