: লিমন ভাই, আমি শুনেছি আগে ‘য়’ বর্ণ ছিল না। এটি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আবিষ্কার। 
— ঠিকই শুনেছিস। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর য বর্ণের নিচে বিন্দু বা ফুটকি দিয়ে য় বর্ণ প্রচলন করেন।
: কেন, লিমন ভাই?
— ‘য’ বর্ণের আসল উচ্চারণ হল ইঅ। সংস্কৃত থেকে প্রাকৃত হয়ে বাংলা ভাষা যখন হল তখন প্রাকৃত থাকতেই য ধ্বনির উচ্চারণ হয়ে গেল জ ধ্বনির মতো, অর্থাৎ ইংরেজি j. বাংলা ভাষায় য ধ্বনির উচ্চারণ জ ধ্বনিসম। যেমন, যক্ষ উচ্চারণ জোকখো, যত উচ্চারণ জতো, যুগ উচ্চারণ জুগ।
: তারপর?
— কিন্তু য-এর আসল উচ্চারণ তো ‘ইঅ’, ইংরেজিতে y.
বাংলা য-ফলার মধ্যে সে উচ্চারণটি এখনো কিছুটা আছে। যেমন: কাব্য, বাক্য, সাম্য। এখানে তো য-ফলার উচ্চারণ জ-ধ্বনির মতো হচ্ছে না। হলে তো হত যথাক্রমে কাব্‌জ, বাক্‌জ, সাম্‌জ। কিন্তু তাতো হচ্ছে না তা-ই না নীলা?
এটি আরও ভালো বোঝা যায় হিন্দিতে। আমরা বাংলায় বলি,
কন্যা; হিন্দিতে বলা হয় কন্ইয়া,
বাংলায় গদ্য; হিন্দিতে গদ্ইয়,
আমরা বলি অভ্যাস; হিন্দিতে অভ্ইয়াস।
: হুম। আচ্ছা এটা কত সালের কথা যখন বিদ্যাসাগর ‘য়’ বর্ণ প্রচলন করেন?
— ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। ১৮৪৭ সালে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে দেন এবং বাংলা বর্ণমালা সংস্কারের উদ্যোগ নেন। ১৮৫৫ সালে বিদ্যাসাগরের বিখ্যাত “বর্ণপরিচয়” বইটি দুইভাগে প্রকাশিত হয়। সংস্কৃতের বেড়াজাল ভেঙে বাংলা বর্ণমালার সংস্কার সাধন করেন এতে তিনি।
: আচ্ছা, এরপর বলো।
— সংস্কৃত ভাষা লেখায় ‘য়’ বর্ণ নেই। সংস্কৃতের “य” বর্ণটি বাংলায় “য” হরফ দিয়ে লেখা হত, কিন্তু শব্দে অবস্থানভেদে এর উচ্চারণ “জ” (j) ধ্বনি কিংবা “ইঅ”-এর মতো উচ্চারিত হত। 
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলায় ‘য়’ বর্ণ প্রচলন করার পূর্বে শব্দের মাঝে ও অন্তে অন্তঃস্থ য দিয়ে ‘ইঅ’ উচ্চারণ হত। যেমন:
এখন আমরা লিখি ‘সময়’, আগে লেখা হত সময; কিন্তু উচ্চারণ হত সময়। 
সংস্কৃত ও হিন্দি ভাষা লেখা হয় দেবনাগরী লিপিতে। এই বর্ণমালায় ‘য়’ নেই। যেমন বাংলায় আমরা লিখি ‘নয়ন’। হিন্দিতে অন্তঃস্থ য দিয়ে লেখে,
नयन = নয়ন।
আগে আমাদেরও ‘য়’ যখন ছিল না তখন এই সমস্যা দূর করার জন্য বিদ্যাসাগর য-এর নিচে বিন্দু বা ফুটকি দিয়ে ‘য়’ বর্ণ প্রচলন করেন।
বিয়োগ শব্দের মাঝের য় আসলে অন্তঃস্থ য। যেমন, বি+যোগ= বিয়োগ।
: একটু কঠিন লাগছে। আচ্ছা বলে যাও।
— বাংলা শব্দ উচ্চারণকালে ‘য়’ বর্ণটি যে স্বরবর্ণের সঙ্গে যুক্ত থাকে তার উচ্চারণ প্রাপ্ত হয়। যেমন: 
য়্+অ= য়; উচ্চারণে অ। যেমন সময়, বিষয় ইত্যাদি।
আবার, য়্+আ= য়া, উচ্চারণে আ, যেমন দয়া।
য়্+ই= য়ি, উচ্চারণে ই; যেমন দয়িত; 
এভাবে,
য়্+ঈ= য়ী, যেমন জয়ী, 
য়্+উ= য়ু, যেমন বায়ু।
: বাহ অনেক কাহিনি লিমন ভাই। আচ্ছা হিন্দিতে ‘য়’ বর্ণ নেই তুমি বলছ?
— না, নেই। সেখানে ‘য’ এর উচ্চারণ হয় ইঅ ইংরেজিতে y. যেমন বাংলায় আমরা বলি,
যুবরাজ, হিন্দিতে বলে Yubaraj, আমরা বলি যাদব, হিন্দিতে Yadab. এভাবে যামিনী>Yamini, যোগী>Yogi, যদু>Yadu, যশ>Yash.
: বেশ সুন্দর। আচ্ছা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণমালায় আর কী কী সংস্কার করেন?
— অনেক।
: যেমন।
— য় বর্ণটি যেমন তিনি প্রচলন করেন, তেমনি ‘ড়’ আর ‘ঢ়’ বর্ণ দুটিও প্রচলন করেন।
: বলো কী লিমন ভাই? এর আগে এ ধ্বনিদুটোর উচ্চারণ ছিল না তবে?
—উচ্চারণ ছিল। শব্দের মাঝে ও অন্তে হলে ‘ড’ ও ‘ঢ’ লেখা হত।
: কেমন সেটি?
— যেমন ‘কড়ি’ শব্দটি আগে লেখা হত ‘কডি’ কিন্তু উচ্চারণ হত কড়ি। 
তেমনি আষাঢ় শব্দ লেখা হত ‘আষাঢ’, কিন্তু উচ্চারণ হত আষাঢ়। বুঝেছিস, নীলা। বিদ্যাসাগর এই সমস্যা দূর করার জন্য ড এবং ঢ-এর নিচে ফুটকি দিয়ে প্রচলন করেন ড় এবং ঢ় বর্ণের।
: বাহ। বাংলা বর্ণমালার জন্য অনেক সংস্কার করেন তো তিনি। আমরা তো এখন জানিই না। 
— এই জন্যই তো তিনি বিদ্যাসাগর। আরও আছে। সংস্কৃত স্বরবর্ণমালায় অনুস্বার, বিসর্গ, চন্দ্রবিন্দু ছিল। এসব যেহেতু ব্যঞ্জনবর্ণ, তাই বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণমালায় এদের ব্যঞ্জনবর্ণে অন্তর্ভুক্ত করেন। 
এছাড়া স্বরবর্ণে আগে আরও কিছু বর্ণ ছিল। যেমন “দীর্ঘ-ৠ” এবং “দীর্ঘ-ৡ”। বিদ্যাসাগর এ দুটি বর্ণ বর্জন করেন। 
এছাড়া স্বরবর্ণে “ঌ” (উচ্চারণ লি) বর্ণ ছিল।
: ‘লি’ দিয়ে শব্দের ব্যবহার বলো তো, লিমন ভাই?
— যেমন লিচু ফলটিকে লেখা যায় ঌচু (ঌ=লি)।
বিদ্যাসাগর এই ‘লি’ বর্ণটি নিয়ে কিছু বলেননি। কালের প্রবাহে এটি অকেজো হয়ে এখন বাংলা বর্ণমালা থেকে খসে হারিয়ে গেছে।
: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একাই তো বাংলা বর্ণমালাকে হাতে ধরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন দেখছি।
— এই জন্যই তো তাঁর উপাধি বিদ্যাসাগর। তারপর ধর যতিচিহ্নেরও প্রচলন করেন বিদ্যাসাগর। 
: বিরামচিহ্নও? 
— হ্যাঁ। প্রাচীন বাংলায় মাত্র দুটি বিরাম চিহ্ন ছিল, এক দাঁড়ি (।), ও দুই দাঁড়ি (।।)। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ইংরেজি ভাষার অনুকরণে অন্য বিরাম চিহ্নগুলোর প্রচলন করেন বাংলা ভাষায়।
সোজা কথায় বাংলা বর্ণমালা ও এর সংস্কারে বিদ্যাসাগরের অবদান অপরিসীম। তাঁকে বলা হয় বাংলা গদ্যের জনক।
: ঠিকই বলা হয়। প্রাতঃস্মরণীয় মানুষ তিনি।
– Morshed Hasan