আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ও মাস্টার্সে ভর্তি নিয়ে অনেক লেখা লিখেছি। আজকে লিখছি গুরুত্বপূর্ণ আরেকটা বিষয় নিয়ে — কীভাবে আপনার প্রোফাইলকে আকর্ষণীয় করবেন যাতে করে ভর্তি এবং নানা রকমের অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ পেতে সুবিধা হয়।

আমেরিকায় গ্রাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষার মান বেশ ভাল বলে প্রতি বছর এখানকার নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি বা মাস্টার্সে ভর্তির জন্য প্রচুর অ্যাপ্লিকেশন পড়ে।

মোটামুটি মানের বিশ্ববিদ্যালয়েও অন্তত শ খানেক মানুষ অ্যাপ্লাই করে। এতজনের মধ্যে কী দেখে আপনাকে ভর্তি করা হবে বা দেয়া হবে রিসার্চ/টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ?

আমি নিজে দীর্ঘদিন ভর্তি কমিটির সদস্য হিসাবে হাজার হাজার অ্যাপ্লিকেশন যাচাই বাছাই করেছি। এই বছর থেকে পিএইচডি প্রোগ্রামের ডাইরেক্টর হিসাবে কাজ করছি। সেই আলোকে চলুন দেখা যাক —

১) টেস্ট স্কোর – টোফেল বা জিআরই স্কোর। অনেক জায়গাতে শুরুতেই টোফেল স্কোরের কাট অফ বা নিম্নসীমার ভিত্তিতে বাদ দেয়া হয় যাদের ইংরেজি জ্ঞান খুব কম তাদের। একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা একেক রকমের। জিআরই স্কোর অনেক জায়গায় আর চায় না এখন, তবে অনেক জায়গাতে সেটা দেয়া লাগে বটে।

টোফেলের পরে জিআরই বিশেষ করে জিআরই ভার্বাল ও কোয়ান্টিটেটিভ স্কোর দেখা হয়। ভার্বাল না হয় বোঝা গেল ইংরেজি জ্ঞানের জন্য, কিন্তু অংকের অংশটি কেন?

কারণ বিজ্ঞান বা প্রকৌশল বিষয়ক পিএইচডি বা মাস্টার্সে সাফল্যের সাথে জিআরই কোয়ান্টিটেটিভ স্কোর এর একটা সম্পর্ক আছে — সাধারণত যারা ভাল স্কোর করে তারা পিএইচডি গবেষণাতেও ভাল করে পরে। এই বিচারে জিআরই স্কোর দেখা হয়।

২) কোন বিশ্ববিদ্যালয় এবং জিপিএ/পজিশন — আন্ডারগ্রাজুয়েট কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করা, সেটা দেখা হয়। যদি কেউ নামকরা কোন আন্ডারগ্রাজুয়েট প্রোগ্রাম থেকে আসে, তাহলে তাকে আলাদা করে দেখা হয় বটে।

যেমন ধরা যাক, ভারতের আইআইটি বা চীনের সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আমেরিকাতেও সবাই জানে, তাই তাদের আন্ডারগ্রাজুয়েটেরা ভাল খাতির পায়। বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় আমেরিকার প্রফেসরদের কাছে খুব বেশি পরিচিত না। দুই একটি বাদে বাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হয়ত প্রফেসরদের কাছে চেনা নয়। সেই ক্ষেত্রে কীভাবে যাচাই করা হয়?

যদি আগে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষার্থী এসে থাকে, তার পারফরম্যান্স কেমন, তা দেখা হয়। যদি আগের শিক্ষার্থীরা ভাল করে, তাহলে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীটিও ভাল করে এটা ধরা হয়। এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচিতি পায় ভাল ছাত্র/ছাত্রীর সোর্স হিসাবে। (উদাহরণস্বরূপ বলি — আমার বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় অ্যাট আরবানা শ্যাম্পেইন বা ইউয়াআইইউসি।

সেখানে আমার আগের বছরে একজন শিক্ষার্থী যান, যাঁর ফলাফল দেখে প্রফেসরেরা বেশ মুগ্ধ হন। তাই আমি যখন আবেদন করি, তাঁরা সহজেই বুঝে নেন আমার আন্ডারগ্রাজুয়েট বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)

একটি ভাল মানের বিশ্ববিদ্যালয়, তাই আমার বছরে ৩জন এবং পরে প্রতি বছরে অন্তত ২/৩ জন করে কম্পিউটার সাইন্সে পিএইচডি এডমিশন পেয়ে এসেছে ওখানে।)

জিপিএ পজিশন এগুলোর গুরুত্ব কম নয়, যদিও সেটা শেষ কথা তাও না। কারো জিপিএ খুবই খারাপ হলে একটু ঝামেলা পোহাতে হবে বৈ কি। যদি ক্লাস পজিশন প্রথম দিকে থাকে, তাহলে সেটা অনেক কাজে লাগে।

আর অনেক সময়ে ট্রান্সক্রিপ্ট ঘেটে কোন কোর্সে কী গ্রেড পেয়েছে, তাও দেখা হয়। যেমন কম্পিউটার সাইন্সে পিএইচডি এডমিশনের সময়ে যদি দেখা যায় শিক্ষার্থীটি প্রোগ্রামিং এর কোর্সে সি বা ডি গ্রেড পেয়েছে একাধিকবার, স্বভাবতই তার মানের ব্যাপারে প্রশ্ন উঠবে।

৩) স্টেটমেন্ট অফ পারপাস – এখানে দেখা হয় শিক্ষার্থীটি স্পষ্ট করে তার নিজের চিন্তাধারা ও পরিকল্পনার কথা গুছিয়ে লিখতে পেরেছে কি না

৪) রেকমেন্ডেশন লেটার — এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীটি সম্পর্কে প্রফেসরেরা কী বলেছেন, তা অবশ্যই পড়ে দেখা হয়। তবে পুরানো লেটার কপি পেস্ট করে অথবা অপ্রাসঙ্গিক কথায় ভরা লেটার পাঠিয়ে লাভ নাই।

দুঃখজনক হল বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রফেসরের লেখা লেটার সম্ভবত ছাত্ররা নিজেরা লিখে দেয়, প্রফেসরেরা খালি সাইন করেন। ফলে লেটারে উদ্ভট বা অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা লেখা থাকে, যা সহজেই ধরা যায়। এসব লেটারের কোন দাম নাই, তা বলাই বাহুল্য।

৫) রিসার্চ/পাবলিকেশন – আন্ডারগ্রাজুয়েটে রিসার্চ করা থাকবে সেটা আশা করা হয় না। তবে যদি থাকে, এবং যদি সেটা পেপার আকারে পাবলিশ হয়, তাহলে এই শিক্ষার্থীর গুরুত্ব খুব বেরে যায় ভর্তির ক্ষেত্রে। (তাই বলে ভুয়া জার্নালে পাবলিশ করে লাভ নাই, ভর্তি কমিটির লোকজন বুঝতে পারে কোনটা আসল আর কোনটা প্রিডেটরি নকল জার্নাল)।

বিশেষ করে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্টশিপের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা খুব কাজে আসে।

৬) এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটি — ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীটি কি অসাধারণ কোন কাজ করেছে পড়ালেখার পাশাপাশি? ভলান্টিয়ার কোন কাজ? অথবা লিডারশিপ পজিশন? আপনার হবি কি সেটা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু আপনি কি মানবকল্যাণের কোন ভলান্টিয়ার কাজে অংশ নিয়েছেন?

অথবা আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ক্লাব যেমন ডিবেটিং ক্লাব বা প্রোগ্রামিং ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ছিলেন? এই রকমের কাজগুলো দেখে লিডারশিপ পোটেনশিয়াল বোঝা যায়। সেটা অনেক সময়ে কাজে আসতে পারে বটে।

৭) প্রফেসরের আগ্রহ — সবশেষে বলি প্রফেসরের আগ্রহের কথা। যদি কোন প্রফেসর আপনাকে নিতে চান, তাহলে উপরের অনেকগুলো ব্যাপারে ঘাটতি থাকলেও সেটা এড়িয়ে ভর্তি ও অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ মিলতে পারে। তাই প্রফেসরদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সেটা করতে পারলে আপনার ভর্তি ঠেকায় কে?

মোটের উপরে এগুলোই হল বিভিন্ন ফ্যাক্টর যা দিয়ে ভর্তি কমিটি যাচাই করে পিএইচডি বা মাস্টার্সে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর আবেদন। তাই আগে থেকেই পরিকল্পনা করুন, কীভাবে এগুলোতে ভাল করে আপনার প্রোফাইলকে করবেন আকর্ষণীয়।

#আমেরিকায়উচ্চশিক্ষা
Writter: Ragib Hasan