নাসার গুডাড স্পেস সেন্টারে লেকচার দিচ্ছেন সুলতানা নাহার

২০১৪,১৫,১৬ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে অবদানে ৪ অধ্যাপক পেলেন ‘রাজ্জাক-শামসুন লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’। একই বিষয়ে মৌলিক গবেষণায় অসাধারণ সাফল্যের জন্য তিনজন অধ্যাপক পেয়েছেন ‘রাজ্জাক-শামসুন পদার্থ গবেষণা পুরস্কার’। গতবছর ১২ নভেম্বর এই পুরস্কার তুলে দেয়া হয়।

পদার্থবিজ্ঞানে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্তরা হলেন- বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কিউএইউ-এর প্রধান অধ্যাপক ড. মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইদ্রিস মিয়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার বসাক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম আলফাজ উদ্দীন। এর আগে ২০১১ তে এই পুরস্কার পেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ললিত মোহন নাথ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম তারা পাবেন ৫০,০০ টাকার সম্মানী।

পদার্থবিজ্ঞানে ‘রাজ্জাক-শামসুন গবেষণা পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলেন- দক্ষিণ কোরিয়ার কিউং-হি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. কাজী মো. আবুল ফিরোজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ইসতিয়াক এম সৈয়দ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল কালাম ফজলুল হক। তারা পাবেন বছএ ২০,০০০ টাকার সম্মানী।

‘রাজ্জাক-শামসুন” ট্রাস্ট ফান্ডের দাতা অধ্যাপক ড. সুলতানা এন এতে নাহার স্বাগত বক্তব্য দেন ।

কিন্তু কে এই সুলতানা এন নাহার। তাকে নিয়ে লিখেছেন রউফুল আলম ।

অনুপ্রেরণার এক আঁধার সুলতানা নাহার
সবাই যখন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়, সুলতানা নাহারের স্বপ্ন তখন মহাকাশ বিজ্ঞানী হওয়ার। কিন্তু কী করে মহাকাশ বিজ্ঞানী হবেন, সেটা তাঁর ভালো জানা নেই। আশপাশের সবাই মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। নয়তো পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারও তাই পড়ার কথা। তবে তাঁর লক্ষ্যটা পাল্টে যায় হঠাৎ করেই। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেওয়ার পর তিনি কিছুটা অবসর পেলেন। সে সময় ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরিতে পড়তে গিয়ে তাঁর হাতে পড়ে মহাকাশ বিজ্ঞানের বই। সে বইতে বুঁদ হয়ে গেলেন তিনি। এই মহাশূন্যের মহ্যব্যাপ্তি তাঁকে নাড়া দেয়। ভাবিয়ে তোলে। সৌরজগৎ, ছায়াপথ, প্রক্সিমা সেন্টরি এগুলো তাঁকে বিস্মিত করে। মহাকাশ নিয়ে গভীরভাবে জানার তাড়না অনুভব করেন। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছে তাঁর মাথা থেকে দূর হয়ে যায়।

কিন্তু পরিবারকে কী করে বোঝাবেন তিনি? এর মধ্যে মেডিকেল ও বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিলেন। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে সুযোগ পেলেন। পরবর্তীতে বুয়েটে সুযোগ পেয়ে সেখানে ভর্তিও হয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁর মগজের নিউরন দখল করে নিয়েছিল নক্ষত্র, গ্রহ-গ্রহাণু আর ধূমকেতুরা। সেখান থেকে মুক্তির কোনো উপায় ছিল না। স্বপ্নতাড়িত সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেন ফিজিকস পড়তে। তিনি অ্যাস্ট্রনমি (জ্যোতির্বিদ্যা) পড়বেন—এটাই তার তীব্র ইচ্ছা।
সুলতানা নাহার লাজুক প্রকৃতির। সত্তরের দশকের মেয়ে। সমাজ তখনো অনেক চুপসে আছে। সুলতানার কর্ম ও ধর্ম একটাই—পড়াশোনা। বাসা, বিশ্ববিদ্যালয় আর পড়াশোনার বাইরে তেমন সময় কাটেনি তাঁর। অনার্সের রেজাল্ট বের হলো। তাঁর শিক্ষক এসে জানালেন, তুমি ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়েছ! সুলতানা উচ্ছ্বসিত। পরিবারের কাছে খুব গর্ব নিয়ে সে খবর দিলেন। যে মেয়েটি ডাক্তার হয়নি বলে পরিবার কষ্ট পেয়েছে, সে এখন ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট! তাও আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিকস ডিপার্টমেন্ট থেকে! আত্মীয়-স্বজনরা বাবা-মাকে বোঝাল, মেয়েটা যেনতেন নয়! কয়েক দিন পর এল ইতিহাস গড়ার সংবাদটা। তাঁর শিক্ষক এসে বললেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিকস ডিপার্টমেন্ট থেকে এর আগে কোনো মেয়ে অনার্সে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়নি। সুলতানাই প্রথম নারী! প্রথম হওয়ার গল্পটা এখানেই শেষ নয়। সুলতানা মাস্টার্সেও ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হলেন। সত্যিকারের অধরা হয়ে গেলেন!

গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতি স্কুলের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সুলতানা নাহার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই তাঁর গবেষণায় হাতেখড়ি। অধ্যাপক এ এম হারুন-অর-রশিদের অধীনে গবেষণা করলেন। এবার দেশের পাট চুকাতে হবে। স্বপ্ন যাঁর যত বড়, শ্রম তার তত বেশি—সুলতানা সেটা জানতেন। ১৯৭৯ সালের বাংলাদেশে যখন অসংখ্য ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করতে চাইত না, সুলতানা তখন পাড়ি দিলেন আটলান্টিক মহাসাগর। পৌঁছালেন আমেরিকায়। পিএইচডি করলেন অ্যাটমিক থিওরিতে। পোস্টডক করলেন। এরপর শুরু করলেন নিজের গবেষণা। এই সুলতানা নাহারকে খুঁজে পাই আমি। যোগাযোগ করি। দীর্ঘ সময়ের কথায় তাঁকে জানি। তাঁর কর্মকে জানি। তাঁর লক্ষ্যের অটুটতা আমাকে শিহরিত করে।
সুলতানা নাহার অ্যাস্ট্রো ফিজিকসের গবেষক। মহাকাশের বস্তুদের নিয়ে তাঁর গবেষণা। আমেরিকার ওহাইয়ো স্টেট ইউনিভার্সিটির রিসার্চ প্রফেসর তিনি। কথা বলার আগে খুব দ্বিধা ছিল মনে। তাঁর কয়েকটি গবেষণাপত্র পড়ে নিলাম আগেই। পড়ে বুঝলাম, সাদামাটা মনের মানুষ। প্রচণ্ড পরিশ্রমী! আমেরিকা ছাড়াও তিনি ভারত, মিশর ও অন্যান্য কয়েকটি দেশে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশে স্কুল-কলেজ পরিচালনাসহ অন্যান্য কাজ করার চেষ্টা করেন। বাবা-মায়ের নামে চালু করেছেন ফাউন্ডেশন ও বৃত্তি। পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় অবদানের জন্য প্রতি বছর দিচ্ছেন ‘রাজ্জাক-শামসুন’ গবেষণা পুরস্কার।
সুলতানা নাহারের দৃঢ় প্রত্যয় আর সাহস আমাকে মুগ্ধ করেছে। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে, আশির দশকের একটি মেয়ে গবেষক হতে চেয়েছে-এটা অভাবনীয়! আমার কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা তাঁকে নিবেদন করলাম। যদিও এর চেয়ে অধিক প্রাপ্য তাঁর। তিনি বললেন, এই যে মহাবিশ্বকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানছি, এই জানাতেই আমার আনন্দ! এর চেয়ে বড় আনন্দ যে আমারও জানা নেই, হে বিদুষী! আপনি আমাদের গৌরব! বাঙালি নারীর জন্য অনুপ্রেরণার আঁধার!

ড. রউফুল আলম: গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া (UPenn), যুক্তরাষ্ট্র।