কদিন আগে এক জুনিওর এর লেখা পড়লাম ব্লগে।সে তার ভার্সিটি নিয়ে লিখেছে। “ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার আগেবাবা মা ভীষন স্বস্তিতে ছিলেন আমাকে এই ভার্সিটিতে দিয়ে। এখানে রাজনীতি নেই, গ্যাঞ্জাম নেই।আমারো কত স্বপ্ন ছিল এই ভার্সিটি নিয়ে ।সবাই মিলে হ্যাং আউটে যাব,চত্বরে বসে চুটিয়ে আড্ডা দিব,আর ক্যাফেটেরিয়া ?

আহ ক্যাফেটেরিয়া মানেই ভার্সিটি,ভার্সিটি মানেই ক্যাফেটেরিয়ার জম্পেশ আড্ডা।কিন্তু ভার্সিটিতে এসে সব কর্পুরের মত উবে গেল।র‍্যাগ নামে কিছু আছে,তাই তো আমার ধারনা ছিল না।ম্যানার এর রকমফের দেখে আমরা ঠটস্থ সবসময় ।না জানি কখন কার কাছে ম্যানার না জানার কারনে পবিত্র পবিত্র বানী হজম করতে হয়।একবার এক ভাইএর সাথে দেখা হল বাইরের রেস্টুরেন্টে।আমি ভাইকে দেখিনি দূরে ছিলাম বলে।সেজন্য ভার্সিটিতে এসে তিনি যে শব্দ দ্বারা ভূষিত করলেন ,আব্বু জানলে সেটাই আমার শেষ দিন হত ভার্সিটিতে।” 
ওর লেখা পড়ে কি যেন দলা আকিয়ে উঠল ভিতরে।আমার এখনো মনে আছে,জলজল করছে ক্যাম্পাসে আসার দিনটি। এই ক্যাম্পাসে প্রথম আসি আমি এক অসম্ভব মিষ্টি ভোরে।চারদিক বৃষ্টি বৃষ্টি গন্ধ,সাথে শীতল শুভ্রতা । রাতের বৃষ্টি ক্যাম্পাসকে করে তুলেছে আরো সবুজ ,আরো সজীব।ঝকঝকে রাস্তার মাঝে কোথাও অল্পসল্প পানি, যেন গোলাপির পাপড়ি,তাতে জলের ফোটা । কল্পনায় আমি দেখছি রাত নেমেছে কেবল ,আধো রাত ,আধো সন্ধ্যা।আমি দুর্বার বাংলার পাথুরে বেদিতে বসে দেখছি সেই রুপ ।আমি বসে আছি পদ্ম পুকুরের ধারে ,যেখানে স্বপ্ন দোলে পদ্মের সাথে সাথে ফিনকি তোলা জোতস্নায়।
বিকালের মিষ্টি বাতাসে আমি দেখছি টকটকে লাল কৃষঞ্চুড়ার দুলে ওঠা।নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস হচ্ছে না।এই সকাল আর বিকালে ,এই সন্ধ্যে আর রাত প্রতিদিনের জন্য হতে যাচ্ছে ? নাহ,আমি একটা দিনও এসব মিস করতে চাই না ।কিন্তু কুয়েটে এসে সবকিছু পালটে গেল।আমি জানলাম,লাল হলুদ রঙের আর জোতস্নায় মাখা রাতের দুর্বার বাংলা আমার জন্য না।পদ্মপুকুর আর পদ্ম,সে তো দিবা স্বপ্ন।ফুলে ভরা লন,তারিপাশে সার দেওয়া ইটের আসন ,শুধু পাশ দিয়ে হেটে যাওয়ার জন্যই ।আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতাম,আর ধন্য হতাম ম্যানারের শিক্ষানবিশ হয়ে।রাত নামলেই শুরু হত ম্যানার শিক্ষার ক্লাস।অমুক ভাইয়ের কল ,তমুক সিনিয়রের ফোন,আশ্চর্য। 
অবশ্য আমি কখনোই বড় ভাইদের দোষ দিব না।আমি জানি ,পরে মিশে দেখেছি তারা আসলে অমন না,যেমন প্রথম কদিন দেখেছিলাম।যে ভাইয়ের মুখ সবসময় ছিল আষাঢ় আকাশ,সে ভাইও বাস্তবে কত অমায়িক,তা অস্বীকার করি কিভাবে ?সমস্যা আমদের সিস্টেমের,যা আমাদের বলে আসছে বছরের পর বছর ধরে ,ছোটদের ম্যানার শেখাতে হয় ,নইলে তারা বখে যায়।
এই তত্ত্বই জন্ম দেয় নানান কিসিমের ম্যানার শিক্ষা কোর্স।সেই কোর্স পিষে ফেলে জুনিয়রের সাধ,অনেক অনেক সজীব স্বপ্ন। এই দেশে একটা ভাল ভার্সিটিতে ভর্তি হতে ছেলেরা দুবছর তিনমাস কি কষ্টটাই না করে । শেষ চারমাস অনেকেই বাসা যায় না এমনকি ইদেও।তারপর এক অসাধ্য সাধন করে যখন সে স্বপ্নের ভার্সিটিতে ভর্তি হয় ,তখন তাকে প্রথমেই শিখতে হয় ম্যানার ।
যখন তার হাপ ছাড়ার কথা, স্বপ্নময় জীবন অনুভব করার কথা,তখন সে ভয়ে কাপতে থাকে ,না জানি কখন কোন সিনিয়রের “ডাক “পড়ে।সেই ডাক এর বেলা যখন শেষ হয়,তখন কিন্তু সে আর হাপ ছাড়তে পারে না।কারন ততদিনে তার দেখা হয়ে গেছে সিজি আর লগ নামের দুই দৈত্যের সাথে।সে হঠাত করে বুঝতে পারে ,ভার্সিটিতে উঠলে আর পড়া লাগে না,শুধু চিল আর চিল,সবই বকোয়াস ।সে দৌড়ায় আর দৌড়ায় এবং চারটি বছর এভাবেই কেটে যায়।তাহলে এই ছেলেটি হাপ ছাড়বে কখন চাকরি নামের সোনার হরিন খুজতে গিয়ে নাকি বসের ঝাড়ি খেয়ে? 
সত্য হল, ভার্সিটিতে ওঠার পরের কিছুদিনই শুধু একজন তরুণের জন্য থাকে বেচে থাকার ঠিক নিজের স্বপ্নের মত করে।কিন্তু তখনই চাপে র‍্যাগের দুঃস্বপ্ন। কদিন আগে আমি এক বন্ধুর রুমে গেলাম।দেখি,সেখানে অনেকের ভীড়,ল্যাপ্টপে সবাই কি যেন দেখছে।আমার বন্ধুটি বিড়বিড় করছে ভাইরে এর যে কি হবে ,খালি ক্যাম্পাসে আসুক,দে,দে,স্ক্রীনশট দিয়ে রাখ।ব্যাপার হল, এক জুনিয়র ১৭ এর অফিশিয়াল গ্রুপে পোস্ট দিয়েছে। সে মাঝামাঝি এক সাব্জেক্ট পেয়েছে।-বলে রাখি,এই “মাঝামাঝি” ব্যাপারটা তার নিজের ধারনা।বাস্তবে সব সাব্জেক্টই ভাল ,সবারই আছে যথাযথ সুযোগ ,প্রয়োজন তার যথাযথ ব্যবহারের ।
– সে লিখেছে,আমি যদিও একটা মাঝআমাঝি সাব্জেক্ট পেয়েছি,তারপরও মনে করি ,এখান থেকে সফল হতে পারব, ,যেন ভার্সিটি আমাকে নিয়ে গর্ব করে। “একথায় সমস্যা কোথায় ?যারা চিরূনি চালিয়েও ম্যানারের অভাব খুজে পান নি,তাদের অবগতির জন্য,সে “মাঝামাঝি ” সাব্জেক্টকে “মাঝামাঝি ” সাব্জেক্ট বলছে,এটাই তার “অপরাধ”।জি হ্যা ,বিশ্বাস করুন ,আর নাই করুন ,এটাই “অপরাধ” হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। 
আরেকটা গল্প বলি। সেদিন আমাদের ব্যাচ গ্রুপে এক ফ্রেন্ড এক জুনিয়রের ছবি আপ্লোড করেছে,নিচে ক্যাপশন,এই ছোট ভাইটিকে কিভাবে ম্যানার শেখানো যায় ফ্রান্স?অপরাধ,সে ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর শখ করে ভার্সিটির নাম লেখা ভাস্কর্যের সাথে ছবি তুলেছে!!!!!!!! কি ,অসুস্থ লাগছ?,লাগাই উচিত। শেষ করব,একটা কথা বলে। সিস্টেম নিজে নিজে বদলে না,তাকে বদলাতে হয়। এজন্যই কুরান পাকে আল্লাহ বলছেন, রা’দ ১৩:১১
 لَهُ‌و مُعَقِّبَٰتٌ مِّنۢ بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِۧ يَحْفَظُونَهُ‌و مِنْ أَمْرِ ٱللَّهِۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْۗ 
For each one are successive [angels] before and behind him who protect him by the decree of Allah . Indeed, Allah will not change the condition of a people until they change what is in themselves. আর আজ সময় বদলে যাওয়ার ,আমার ,আমাদের ।জুনিয়রর আসছে ,আসবে ক্যাম্পাসে,কুয়েটে ,একইভাবে বুয়েটঁ রুয়েট ,চুয়েটেও।জুনিয়ররা আমাদের কাছে শিখুক ম্যানার না,বদলে যাওয়ার ,বদলে দেওয়ার দীক্ষা।এই লেখা পড়ে শুধু একজন ,হ্যা শুধু একজনেরো যদি মনে হয়, এখন সময় বদলে যাওয়ার ,তাহলেই এই লেখা স্বার্থক।

Md Omar Faruque, Khulna University of Engineering & Technology(KUET)