বাংলাদেশে নদ-নদীগুলো ছড়িয়ে আছে জালের মতো। নদীগুলো প্রকৃতিকে করেছে শোভামণ্ডিত। এই ভূখণ্ডকে করেছে ঐশ্বর্যমণ্ডিত। ঐতিহাসিকভাবেই এই অঞ্চলের নদ-নদীর গতি–প্রকৃতি ও প্রবাহ জটিল।
কিন্তু তা সত্ত্বেও নদীগুলোকে অতিক্রম করে স্থায়ী যোগাযোগের মাধ্যম সৃষ্টির আগ্রহটা মানুষের চিরন্তন। এখনো গ্রামগঞ্জে এমন বাঁশের সাঁকোর দেখা মিলবে। গ্রামে কোনো খাল পারাপারের জন্য অন্য মাধ্যম থাকলেও মানুষের আগ্রহ থাকে স্থায়ী সাঁকোর দিকে।
সব আবহাওয়ায়, রাতে-দিনে স্থায়ী যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে স্থায়ী সেতুর আবেদন চিরন্তন। বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ আজ নদী ও সাগরের ওপরও সেতু নির্মাণের সামর্থ্য রাখে।
এ জন্য যুগ যুগ ধরে মানুষ জ্ঞান আহরণ করছে, যাতে এই সেতু নির্মাণযোগ্য, সহজলভ্য, ব্যবহারযোগ্য ও দীর্ঘস্থায়ী হয়।
সব প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা, যেমন: ভূমিকম্প, বন্যা, খরা ও অন্যান্য মানবসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলা করে থাকে। সেতুর জন্য প্রয়োজন হয় সঠিক উপকরণ ভিত্তি ও কাঠামো নির্বাচন।
স্থানীয় মালামাল ও প্রযুক্তির ব্যবহার করলে সেতুর নির্মাণকাজে খরচ অনেক কম হয়। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ও নির্মাণশৈলী সেতুকে দীর্ঘ মেয়াদে লাভজনক করতে পারে।
সেতু তৈরির উপকরণ বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিতঃ
বাঁশ: বাঁশ হচ্ছে ঘাস পরিবারের বৃহত্তম সদস্য। আদিকাল থেকেই ঘরবাড়ি বা সাঁকো (পায়ে চলার ছোট সেতু) তৈরিতে বাঁশ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষ এখনো ছোট নদী–নালা পারাপারের জন্য বাঁশের তৈরি সাঁকো ব্যবহার করে।
কাঠ: যুগ যুগ ধরে মানুষ কাঠকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। তা ছাড়া ঘরবাড়ি, যন্ত্রপাতি তৈরি ছাড়াও ছোট দৈর্ঘ্যের সেতু তৈরিতে কাঠ ব্যবহার করা হয়।
ইট বা পাথরের গাঁথুনি: মোগল আমলে এই অঞ্চলে ছোট নদী-নালা পারাপারের জন্য ধনুক আকৃতির আর্চ সেতু তৈরিতে পোড়ামাটির ইট বা পাথরের প্রচলন ছিল।
ইস্পাত: লোহা ও কার্বনের সংকর ইস্পাত, যা নির্মাণসামগ্রী হিসেবে বহুল ব্যবহৃত উপকরণ। ব্রিটিশ আমলে অনেক ইস্পাতের তৈরি ট্রাস সেতু ও গার্ডার সেতু তৈরি হয়।
কংক্রিট: সিমেন্ট, বালু, খোয়া ও পানির যথাযথ মিশ্রণে তৈরি কংক্রিট সেতু তৈরির একটি আধুনিক উপকরণ। ব্রিটিশ-পরবর্তী সময়ে এ দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেতু নির্মাণে এর ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়। রিইনফোর্সড কংক্রিট ও প্রি-স্ট্রেসড কংক্রিট—এই দুই ধরনের কংক্রিটে সেতু তৈরি হয়।
সাধারণ কংক্রিটের চাপ ও আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা কম। তাই ইস্পাতের খাঁচার চারদিকে কংক্রিট জমিয়ে তাকে অত্যন্ত শক্ত, ঘাতসহ করা হয়। এ ধরনের কংক্রিটকে রিইনফোর্সড কংক্রিট বলা হয়।
রিইনফোর্সড কংক্রিটের সেতু হলো কংক্রিট ও ইস্পাতের দণ্ডের সমন্বয়ে তৈরি সেতু। প্রি-স্ট্রেসড কংক্রিট হলো কংক্রিট ও ইস্পাতের তারের সমন্বয়ে পূর্ব টানে তৈরি সেতু।
পলিমার: বর্তমানে অতি উচ্চ টান নেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন পলিমার সেতু তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলো সাধারণত কার্বন বা গ্লাসের আঁশের সমন্বয়ে তৈরি যৌগ।
রাবার: রাবার প্রধানত ব্যবহৃত হয় সেতুর পাটাতন বহনকারী গার্ডারের নিচে শেষ প্রান্তে, যাতে সেতু শীত-গ্রীষ্মে, দিনে-রাতে তাপমাত্রার পরিবর্তনে এবং যানবাহনের চলাচলের সময় প্রসারণ-সংকোচন ও নড়াচড়া সহ্য করতে পারে। এ ছাড়া বিশেষ ধরনের রাবার বিয়ারিং সেতুকে ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি থেকে রক্ষা করে।
কাঠামোভেদে সেতুঃ
আর্চ সেতু: আর্চ হলো ধনুক আকৃতির এমন একটি কাঠামো, যার বিস্তার থাকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খোলা জায়গাজুড়ে এবং সেটি ওই জায়গার ওপর সম্পূর্ণ কাঠামোর ভার বহন করতে সাহায্য করে। একে অনেকে খিলানিও বলে। আর্চ দিয়ে সাধারণত বিভিন্ন অলংকৃত তোরণ ও দালানকোঠার সামনের অংশ নির্মাণ করা হলেও অন্যান্য নানা ধরনের অবকাঠামো, যেমন বিভিন্ন সেতু নির্মাণে এর ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যালান্সড ক্যান্টিলিভার সেতু: এ ধরনের সেতুর পাটাতন তার স্তম্ভের দুদিকে ভারসাম্য বজায় রেখে বিস্তৃত থাকে।
সাধারণ সেতু: এ ধরনের সেতুর পাটাতনের দুই প্রান্তে বিশেষ অবলম্বনের ওপরে ভর করে থাকে। এ ধরনের সেতু সাধারণত কংক্রিট বা ইস্পাতের তৈরি হয়। ইস্পাতের সেতু মূলত গার্ডার বা ট্রাসের তৈরি হয়। অন্যদিকে, কংক্রিটের সেতু স্ল্যাব, গার্ডার, বক্স গার্ডার বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে।
ঝুলন্ত সেতু: এ ধরনের সেতুর পাটাতন মূলত ইস্পাতের তারের মাধ্যমে বিশেষ কায়দায় ঝুলে থাকে। স্টেইড ও সাসপেনশন সেতু ঝুলন্ত সেতুর দুটি প্রধান প্রকারভেদ।
সেতু নির্মাণের পদ্ধতিঃ
ভিত্তি নির্মাণ: নদীর মাঝে ভিত্তি নির্মাণ সেতু নির্মাণের প্রথম চ্যালেঞ্জ। নদীর মধ্যে ভিত্তি দুই ধরনের হয়ে থাকে।
ক. ক্যাশন ভিত্তি: এটি পানিরোধী কূপ আকৃতির অবকাঠামো, যা নদীর মধ্যে তৈরি করা হয় এবং পরে কংক্রিট দিয়ে ভরা হয়।
খ. পাইলিং: পাইলিং ভিত্তি বহুল প্রচলিত একটি পদ্ধতি। সাধারণত পাইল দুই ধরনের হয়। উল্লম্ব পাইল ও তির্যক পাইল। পাইল সাধারণত কংক্রিট বা ইস্পাতের তৈরি হয়।
গ. নদীর ওপর গার্ডার স্থাপন: নদীর ওপরে গার্ডার স্থাপনের লাগসই পদ্ধতি প্রয়োগ নির্মাণের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। নদীর ওপর গার্ডার দুটি পদ্ধতিতে স্থাপন করা হয়।
- ১. গার্ডার অন্য জায়গায় তৈরি করা হয়। তারপর ফেরিতে করে সেতুর মূল জায়গায় আনা হয়। তারপর ক্রেনের মাধ্যমে যুক্ত করা হয়।
- ২. ভিত্তিস্তম্ভের ওপর সার্ভিস ট্রাসের সাহায্যে ব্যালান্সড ক্যান্টিলিভার পদ্ধতিতে স্তম্ভ থেকে দুদিকে সমানভাবে একই সঙ্গে সেতুর পাটাতন নির্মাণ করা।
- ৩. অস্থায়ী স্থাপনা তৈরি করে নদীর ওপর সরাসরি গার্ডার নির্মাণ করা হয়।
ঘ. ভূমিকম্প থেকে প্রতিরোধ: ভূমিকম্পের ঝুঁকি থেকে সেতুর অবকাঠামোকে রক্ষার জন্য রাবারের তৈরি বিয়ারিং ব্যবহৃত হয়।
বিয়ারিং বেশ কয়েক রকম হয়, যেমন: পট বিয়ারিং, লেড রাবার বিয়ারিং ইত্যাদি। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু সেতুতে ধাতব পিন্টেল ব্যবহৃত হয়েছে।
পদ্মা সেতুতে দোলক বিয়ারিং ব্যবহার হওয়ার কথা আছে।
ঙ. মূল সেতু ও সেতুস্তম্ভের মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ কবজা: তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে প্রতিটি বস্তু প্রসারিত হয়। এ প্রসারণ যাতে সেতুর ক্ষতি করতে না পারে, সে জন্য এই কবজা ব্যবহার করা হয়।
চ. ফলিং অ্যাপ্রন পদ্ধতিতে নদীশাসন: নদী তার আপন গতিতে এপার ভেঙে ওপার গড়ে দিক পরিবর্তন করে চলে। সেই নদীকে শাসন করে সেতু তৈরির পর সেতুর নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে বাধ্য করতে হয়। সেখানেই সেতু নকশার একটি গুরুত্বপূর্ণ সফলতা নিহিত। এই পদ্ধতিতে পাথরের চাঁই নদীর পাড়ে জমা রাখা হয়।
সেতু নির্মাণের কৌশল নির্বাচনঃ
বাংলাদেশের সেতু হতে হবে আমাদের ভূপ্রকৃতি, ভূগঠন ও জলবায়ুর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তা অবশ্যই অন্য দেশের তুলনায় অনেকটাই আলাদা হবে। বাংলাদেশের ভূপৃষ্ঠের প্রায় অর্ধেক অংশ পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা—এই তিন বৃহৎ নদীপ্রণালির সর্বনিম্ন ভাটিতে অবস্থিত এবং গড় উচ্চতা ১০ মিটার সমন্বিত রেখার নিচে।
উচ্চতা ও ভূমিরূপের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতিকে প্রধান তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়—টারশিয়ারি যুগের পাহাড়, প্লাইস্টোসিন সোপান এবং নবীন যুগের প্লাবনভূমি এলাকা। সমুদ্র সমতল থেকে খুব বেশি উঁচু নয় আমাদের স্থলভাগ। তাই প্রতিবছর প্রবল মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ফলে দেশের অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়।
পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র (যমুনা) ও মেঘনা নদী এবং তাদের অসংখ্য উপনদী ও শাখানদীবাহিত কোয়াটারনারি যুগের (প্রায় ২০ লাখ বছর আগে থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত) পলি বাংলাদেশের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ এলাকায় সঞ্চিত হয়েছে।
সাম্প্রতিক কালে পলিজ সমভূমির মধ্য, উত্তর ও পশ্চিম অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি এবং নিষ্কাশনব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। গত ২০০ বছরে গঙ্গা ও তিস্তা নদীর গতিপথ পূর্বমুখী হওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। সেই সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র হয়েছে পশ্চিমমুখী।
তারপরও নদ-নদীই বাংলাদেশের প্রাণরেখা। এর স্রোতোধারাকে অক্ষুণ্ন রাখতে হবে এবং সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। একবিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে এসে যখন আমরা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের স্বপ্ন দেখি, তখন আমাদের প্রয়োজন পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ সব নদীর ওপর একাধিক সেতু তৈরি।
আমাদের ভবিষ্যৎ সেতু কেমন হবেঃ
আমাদের এমন সেতু নির্মাণ করতে হবে, যেখানে মানুষ, গাড়ি ও ট্রেন দ্রুতগতিতে চলবে, যা বহু যুগ ধরে সময়ের চাহিদা মেটাবে।
সেতুগুলো বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি ও নিসর্গের সঙ্গে মিলেমিশে সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, বিশ্বকে বাংলাদেশের গর্ব বুকে ধরে আকৃষ্ট করবে। সম্ভবত, এটাই আমাদের জীবনের বাইরে দেশের ও বিশ্বের জন্য করার সম্ভাব্য উপায়। আমাদের আন্তরিক চিন্তা সেখানে থাকা উচিত।
লেখাঃ ড. আ.ফ.ম. সাইফুল আমিন, বুয়েট