বাংলাদেশের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে যারা ফিজিক্সে ভালো তারা কি পড়তে চায় জিজ্ঞেস করলেই বলবে স্ট্রিং থিওরি বা পার্টিকেল ফিজিক্স, হাই এনার্জি ফিজিক্স, জেনেরেল রিলেটিভিটি, কসমোলজি & এস্ট্রোফিজিক্স, খুব লিমিটেড কনডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্স।
এইসবের বাহিরে কেউ কিছু করলেই প্রশ্ন তুলি ফিজিক্স কিনা। এইবারের নোবেল পুরস্কার নিয়েও আমরা এমনভাবে প্রশ্ন তুলছি যেন যারা নোবেল পুরস্কার সিলেক্ট করেন তারা কিছুই বুঝে না। সব বুঝা কেবল আমরাই বুঝি।
সদ্য নোবেল বিজয়ী John Hopfield একজন পদার্থবিদ। তিনি আন্ডার গ্রাজুয়েট করেছেন পদার্থবিজ্ঞানে। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি। তিনি ICTP থেকে ডিরাক মেডেল পেয়েছেন।
IUPAP থেকে বোল্টজম্যান অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। এছাড়া Albert Einstein World Award of Science পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি পদার্থবিজ্ঞান ব্যবহার করেই নিউরাল নেটওর্ক তত্ব দিয়েছেন। ইলেক্ট্রন প্রোটনের ব্যবহার থেকে আমাদের নিউরণের আচরণ ও চরিত্রের ভাষা জানা আরও কঠিন।
যেখানেই cause and effect আছে, প্রকৃতির দর্শন আছে, এটম কিংবা নিউরন আছে এবং তাদের আচরণের ব্যাখ্যা থাকে সেইসব ব্যাখ্যা দিয়ে আমাদের জ্ঞানের ফ্রন্টিয়ারকে পুশ করে সামনে নিয়ে যায় সেখানেই ফিজিক্স আছে।
পদার্থবিজ্ঞানকে সামাজিক বিজ্ঞানও বলা যায়। এই যে বিলিয়ন বলিওন ইলেক্ট্রন মেটালের মধ্যে দিয়ে কেমন করে চলে তার ভাষা আমরা দেই। বিশাল বিশাল প্লেনেট অনেক অনেক আলোকবর্ষ দূরে তার তাপমাত্রা কত, কি এলিমেন্ট সেখানে আছে সেগুলো আমরা পৃথিবীতে বসে বের করতে পাড়ার নাম পদার্থবিজ্ঞান।
পদার্থবিজ্ঞান বা ব্রাডলি স্পিকিং জ্ঞানের কোন শাখাই কোন একটি নির্দিষ্ট গন্ডিতে আটকে থাকা উচিত না। স্থির থাকা মানেই মৃত এবং এক সময় গন্ধ ছড়াবেই।
২০২১ সালে ফিজিক্সে নোবেল জয়ী জওর্জিও পারিসি বলেছেন “আমি মনে করি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার আরও বিস্তৃত হতে থাকা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে এবং ছড়িয়ে পড়া উচিত।
পদার্থবিজ্ঞান ক্রমশ আরও ব্যাপক হচ্ছে এবং এতে অনেক নতুন জ্ঞানক্ষেত্র যুক্ত হয়েছে যা অতীতে ছিল না বা পদার্থবিজ্ঞানের অংশ ছিল না।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, পদার্থবিজ্ঞান হলো বিজ্ঞানের সেই শাখা যা মূলত গাণিতিক ভিত্তির ওপর নির্ভরশীল এবং তা ধারণাগত কারণ এবং আধুনিক কম্পিউটারের অসাধারণ ক্ষমতার জন্য ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে।”
আমাদের উচিত নতুন নতুন ক্ষেত্রকে স্বাগতম জানানো। জওর্জিও পারিসি বলেন “কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কের বিপ্লবী আবিষ্কার এবং তার উন্নয়নের জন্য নোবেল পুরস্কার, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাইলফলক হিসেবে গণ্য হয়, তা অবশ্যই একটি বাধ্যতামূলক নির্বাচন।” নিউরাল নেটওয়ার্ক এর ব্যবহার কি কেবল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ?
ডিফারেনশিয়াল সমীকরণ সমাধান করতে নিউরাল নেটওয়ার্ক এর ব্যবহার নাই? কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটেশনে নিউরাল নেটওয়ার্ক এর ব্যবহার নাই?
পার্টিকেল ফিজিক্স, এস্ট্রোফিজিক্স, কনডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্স আর স্টাটিস্টিক্যাল মেকানিক্সের কথা কি বলব? সর্বত্রই এখন নিউরাল নেটওয়ার্ক এর ব্যবহার আছে।
এই নিউরাল নেটওয়ার্ক এর বেসিস হলো এর আর্কিটেকচার যাকে বলি গ্রাফ বা নেটওয়ার্ক। অর্থাৎ আমাদের ব্রেইনের নিউরনকে নোড এবং এদের কানেক্শনের দ্বারা নিউরণের যেই আর্কিটেকচার তৈরী হয় তাকেই আমরা নেটওয়ার্ক বলি।
গ্রাফ তত্বের জনক হলেন নেওনার্ড অয়লার। এরপর যুগতনকারী বিপ্লব ঘটিয়েছেন পল এরদস, আলফ্রেড রেনি, স্ট্রোগৎজ, ওয়াটসন এবং বাড়াবাসী। নেটওয়ার্ক তত্বের উপর আমার ছাত্র লিয়ানা, মিশুক ও দেবাশীষকে আমরাও একটি মডেল প্রস্তাব করেছি যাকে আমরা মেডিয়েশন ড্রিভেন এটাচমেন্ট নেটওয়ার্ক বলি।
তবে এটি আরও ৮-১০ বছর আগে করলে বিশাল হৈচৈ পরে যেত। বিজ্ঞানে সময়কে ধরতে পারাও একটি বড় বিষয়। আমরা বরাবরই এই ক্ষেত্রে পিছিয়ে এবং এই জন্যই আমরা ছোটখাটো পদার্থবিদ। যখন সবাই ফ্র্যাক্টালে কাজ ছেড়ে দিল আমি তখন ধরেছি এবং কিছু মৌলিক কাজ করেছি।
তাতে কি? পার্কোলেশন তত্বের যখন যৌবন পেরিয়ে গেল তখন আমরা এই বিষয়ে কাজ শুরু করেছি এবং আমাদের কিছু মৌলিক কাজ আছে। তাতে কি? কিন্তু আমি মজা পাই। গবেষণা করে আনন্দ পাওয়াটাই আসল। আমার ছাত্রছাত্রীরাও আনন্দ পায়।
পদার্থবিজ্ঞানের ফ্রন্টিয়ারকে পুশ করতে থাকতে হবে। আসুন না আমরা মিন না হই। আমাদের অধ্যাপক মাহবুব মজুমদার এমআইটিতে ইঞ্জিনিয়ারিং করে ক্যামব্রিজ থেকে তত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করেছেন।
তারপরেও আমরা বাংলাদেশিরা তাকে পদার্থবিদ বলতে কার্পণ্য করেছি। প্রশ্ন করেছি: ভাই তোমারতো ফিজিক্সে আন্ডার গ্রাজুয়েট নাই। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাকে পদার্থবিদ হিসাবে স্বীকৃতি দিলেও আমরা দিতে কার্পণ্য করি। আমরা এমনই।
গণিতের ক্ষেত্রেও আমরা এমন। বাংলাদেশে গণিত মানে ফ্লুইড ডাইনামিক্স এবং আশেপাশের কিছু সাবজেক্ট। বাংলাদেশে কোন পদার্থবিদ বা গণিতবিদ কেয়সের কাজ করে না। শুধু ভারতেই শত শত বিখ্যাত বিজ্ঞানী এই বিষয়ে কাজ করছে। সব কিছুতেই আমরা খুব ন্যারো।
– কামরুল হাসান মামুন