ঠিক ১৯ বছর আগের স্মৃতিচারণ করতে বসবো আজ তোমার কাছে। ২০০১ থেকে ২০২০ অনেক বছরের দুরত্ব।

ঠিক ১৯ বছর আগের স্মৃতিচারণ করতে বসবো আজ তোমার কাছে। ২০০১ থেকে ২০২০ অনেক বছরের দুরত্ব।

3rd December 2001 : স্মৃতিচারণ

====================
বড় আকারের লেখা! পড়লে ধৈর্য ধরে পড়ার আহবান রইলো

ঠিক ১৯ বছর আগের স্মৃতিচারণ করতে বসবো আজ তোমার কাছে। ২০০১ থেকে ২০২০ অনেক বছরের দুরত্ব। স্মৃতি পাতা থেকে অনেক কিছু মুছে হয়ত গেছে কিন্তু সারাংশ কিছু রয়েই যায়।

আর আমার দোষ না গুণ সেটা জানি না, তবে এটা বলতে পারি, অনেক ছোট খাটো বিষয়ও আমার অনেক বিস্তারিত মনে থাকে। এটা আমার জন্য সবসময় যে খুব সুখকর হয় তা কিন্তু নয়। স্মৃতি সবসময় সুখের ঝাঁপি খুলে বসে না।

কখনও কখনও বেদনার কথাগুলোও মনে করিয়ে দেয়। উনিশ বছর আগের যে স্মৃতি আমি মনে করবো, সেটা তোমাদের দেখে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি। কখনও এভাবে লেখা হয়নি। তাই আমার মনে হয়েছে, অনেক কথা বলার সাথে সাথে এগুলোও বলা হয়ে যাক। ভালমন্দের মিশেল দেয়া আমার এক খন্ড অতীত। মনে পড়ে। মাঝে মাঝে বলতেও ইচ্ছে করে। কিন্তু আমার চিরচেনা আলসেমির জন্য হয়ে ওঠে না।

অনেক ভুমিকা করে ফেললাম। নিজের সাথে নিজে যখন কথা বলি তখন এত ভুমিকা লাগে না। কিন্তু যখন লিখতে শুরু করি? তখনকার কথা একটু আলাদা। আমি যখন লিখি, তখন আমার নিজেকে দু’টা অংশে ভাগ করে নেই। একাংশে আমি নিজেই বলতে থাকি, আরেকাংশ সেটা শোনে। আমার সেই আরেকাংশ হচ্ছো তুমি। এই তুমি কিন্তু আলাদা কিছু না! আমারই একটা অংশ যাকে আমি অকপটে বলে যাচ্ছি আমার না বলা কথাগুলো কোনরকম পরিমার্জন বা পরিবর্ধন না করেই।

আমার আজকের স্মৃতিচারণ আমার ‘বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়’ তথা BUET এর ভর্তি পরীক্ষা এবং তার আগে পরের কিছু কাহিনী নিয়ে। বেশ খানিকটা লম্বা তো বটেই। পড়তে পড়তে ধৈর্য রাখতে পারবে বলে আশাকরি। তবে শুরু করলাম। তবে একটু আগে থেকে। মানে আমার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরের সময় থেকে।

নটরডেম কলেজে ভর্তি হবার সময়কাল থেকেই আমার মনে একট বদ্ধমূল স্বপ্ন আমি নিয়ে আমি ভর্তি হয়েছিলাম। আমাকে একজন ‘এঞ্জিনিয়ার’ হতেই হবে এবং আমাকে BUET এ পড়তেই হবে। আমার খালাতো বোন ১৯৯৬ ব্যাচ আর্কিটেকচারে ভর্তি যখন হয় তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। তখন থেকেই আমার মনেও স্বপ্ন তৈরী হয় বুয়েট জিনিসটা তো তাহলে মন্দ না। সবাই ভাল বলে, সবাই করত প্রশংসা করে। যদিও বুঝতাম না কিছুই।

আমাদের সেই যুগে না ছিল ইন্টারনেট আর না ছিল এখনকার মত স্মার্টফোন। আমাদের সেই যুগে আমরা লেখাপড়া মানে শুধু বইই বুঝতাম। বইয়ের বাইরে থেকেও যে লেখাপড়া করা যায় এবং মানুষ অনেক কিছু জানতে পারে, সেই সম্পর্কে অন্তত আমার কোন ধারণা ছিল না। সেই সময়ে ইংলিশ গান শোনা এবং জিন্সের প্যান্ট পরাকেও উগ্রতা ধরা হত কোন কোন পরিবারে!

অনেক পরিবারেই এসব ভাল ধরা হত না। ইংলিশ গান শুনলে ছেলে মেয়ে গোল্লায় গেছে। এমন কিছু কিছু কথা তো আমিও শুনেছি। আর ইংলিশ মুভি মানেই সম্ভবত অনেকের কাছে সেটা ‘পর্নোগ্রাফি’ই ছিল। পর্নোগ্রাফির বাইরেও যে অসাধারণ কিছু ইংলিশ মুভি দেখা যেতে পারে, নানা বয়সের জন্য মুভিতে ভাগ করা থাকে সেগুলোও আমাদের সামনে উত্থাপন করা হত না।

আমাদের সেই ক্যাসেটের যুগেও আমাকে ইংলিশ গান লুকিয়ে চুরিয়ে শুনতে হত। বড়দের সাড়া পাওয়া মাত্রই ক্যাসেট বন্ধ। ইংলিশ ক্যাসেটের দিকে যে বিষ দৃষ্টিতে তাকাতো আমাদের গার্ডিয়ানরা, সেই অগ্নিচক্ষুর ভয়েই ইংলিশ গান শোনা আমার কাছেও একসময় ‘পাপ’ এর পর্যায়ে ছিল। সেই আমি যখন বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলাম, তখন থেকে ইংলিশ গান শোনার ব্যাপারে আর কোন নিষেধাজ্ঞা আর ছিল না। অনেকটা সাত খুন মাফ হবার মত ব্যাপার ছিল।

বুয়েটে ভর্তি হয়েছে, এখন তো ইংলিশ গান শুনতেই পারে! ব্যাপারট কিছুটা এমন ছিল। আর জিন্সের প্যান্ট? সমগ্র বুয়েট লাইফেও মাত্র বার কয়েক পরেছি সম্ভবত! গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট ছিল অনেকটা চিরসঙ্গী টাইপের!

আবার আগের প্রসঙ্গে ফেরত আসি। নটরডেম কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পরে অপশনাল সাব্জেক্ট চয়েস করতে হবে। ফর্ম আমার ঘরে। আমার বাবাকে বললাম, তুমি ফিলাপ করে দাও।

নটরডেম আমার কাছে স্বপ্নের মত একটা ব্যাপার ছিল। অনেক কড়াকড়ি করে শুনেও আমাকে ওখানে পড়ার ইচ্ছা থেকে কোন কিছুই পিছপা করাতে পারেনি। আমার বাবা ফর্ম নিয়ে বসলেন। হাতে উনার Uniball এর সিগনেচার পেন। যেই ফিলাপ করতে যাবেন, কারেন্ট চলে গেল।

চার্জার লাইট ছিল না তখন ঘরে। মোমবাতি জ্বালিয়ে উনি ফিলাপ করতে বসলেন। করলেনও ফিলাপ। অপশনাল সাব্জেক্টে তখন আমাদের সায়েন্সের ছাত্রদের জন্য তিনটা অপশন ছিল। এই তিন সাব্জেক্টের যে কোন একটা নিতে হবে। আর ম্যাথমেটিক্স সাব্জেক্টটা কলেজের নিয়মানুসারে সায়েন্সের সবার জন্য বাধ্যতামূলক। অন্য কলেজের অনেকেই ম্যাথমেটিক্সকে অপশনাল নিতে পারতো কিন্তু নটরডেম কলেজে ম্যাথমেটিক্স কে বাধ্যতামূলক রেখে অন্য তিনটার যে কোন একটা নিতে হবে অপশনাল সাব্জেক্ট।

পরিসংখ্যান, বায়োলজি আর কম্পিউটার সায়েন্স। যখন এই তিনটার কোন একটাতে টিক চিহ্ন দেবার প্রসঙ্গ আসলো, তখন আমার বাবা বললেন, কোনটা দিব? আমি পাশেই বসা ছিলাম। আমি বললাম, আমার মেডিক্যাল এ পড়ার কোন ইচ্ছা নেই আর বায়োলজি ভাল লাগে না তেমন। অনেক ছবি টবি আঁকতে হয়। ইন্টারের বায়োলজি কনেক কঠিন। আমার এঞ্জিন্যারিং পড়ার শখ।

আমি পরিসংখ্যান নিতে চাই। আমি শুনেছি পরিসংখ্যানে নাম্বার উঠানো, আর ‘লেটার’ (১০০ তে কমপক্ষে ৮০ নম্বর) পাওয়া অনেক সহজ। তখনো আমাদের কাছে লেখাপড়াটা ছিল শুধুই মার্ক আর রেজল্ট সর্বস্ব একটা ব্যাপার! সেই চিন্তাধারা থেকেই আমি বলেছিলাম কথাগুলো। এসব শুনে আমার বাবা বললেন, বায়োলজি না নিলে তো মেডিক্যালেও পরীক্ষা দিতে পারবে না। তোমার অপশন কমে গেল। তখন আমিও বললাম, আমার তো মেডিক্যালে পড়ার ইচ্ছাই নাই।

তাহলে শুধু শুধু বায়োলজি পড়ে আমি কি করবো? তখন উনি ফর্মটা সামনে থেকে এক ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার যা খুশি তাতে টিক দিয়ে নিও। এই বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন।

আমি ফর্মটা আমার হাতে তুলে নিলাম। কারেন্ট চলে আসলো। আমি সারারাত ফর্মটায় কোন টিক চিহ্ন দিলাম না। ভাবলাম কাল জমা দেয়ার আগে টিক দিলেই তো হবে। পরেরদিন জমা দিতে গেলাম বাবার সাথেই। হাতের ফাইলটা থেকে ফর্মটা বের করলাম। তখনও অপশনাল সাব্জেক্টে টিক দেয়া হয়নি। বাবা বললেন, টিক দাও নি?

আমি বললাম এখন দিচ্ছি। উনার কাছ থেকেই কলম নিলাম। উনি বেশ অপ্রসন্ন মুখে কলম দিলেন। আমি হাঁটু গেড়ে বসে হাঁটুর উপরে ফাইল রেখে, ফর্মের ‘পরিসংখ্যান’ লেখা ঘরটায় টিক দিলাম বাবার চোখের সামনেই। এরপরে উঠে দাঁড়িয়ে, বুথে গিয়ে ফর্মটা জমা দিয়ে আসলাম।

আমার অপশনাল সাব্জেক্টের সাথে সাথে আমার অনেক ভাললাগার বিষয় পরিসংখ্যান আমার জীবনে যুক্ত হলো। পরবর্তিতে এই সাব্জেক্টটাই আমার জীবনে আশির্বাদ হয়ে এসেছে এবং ডক্টরাল রিসার্চ থেকে শুরু করে, এখন পর্যন্ত এই পরিসংখ্যান নেয়ার সুফল আমি আমার জীবনে পেয়ে যাচ্ছি। ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি, পরিসংখ্যান সাব্জেক্টটা যে কোন অনুষদেই বাধ্যতামূলক করে দেয়া উচিত।

Notredam college ndc

এত কাজে লেগেছে আমার। এখনও লাগছে। পরিসংখ্যান নেবার সুবাদে নটরডেম কলেজে আমার ঠাই হলো গ্রুপ-সেভেন এ! আমার রোল হল 1017170. আমাদের সময় সাতটি ডিজিটে হত। বিগত কয়েক বছরে গ্রুপের সংখ্যা ১০এর অধিক হবার কারনে এখন নটরডেমের রোল নাম্বার আট ডিজিটে হয়। আমি কিন্তু বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় এখনও আসিনি। কিছু মনে করো না।

আসছি। কিছু ইতিহাস না বলে নিলে বর্তমানের সাথে সংযোগ রক্ষা করা যায় না যে। আমি সেটাই করছি।

নটরডেম কলে জীবনে শেষ হয়ে গেল ২০০১ সালে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেল আগস্টের শুরুতেই। উচ্চমাধ্যমিক শেষ হলে অবসর আর কোথায়? ভর্তি পরীক্ষার দৌড়। আমাদের সময়ে ওমেগা আর সানরাইজ কোচিং এর অনেক নামডাক ছিল এঞ্জিনিয়ারিং এর জন্য। আমি ওমেগাতে ভর্তি হয়েছিলাম।

আমার বাবা সহকারেই গিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। নিজেই ফার্মগেট এ আসতাম যাইতাম। ওমেগা কোচিং এর কর্ণধার ছিলেন এঞ্জিনিয়ার মিজান ভাই। যিনি আমাদের অবশ্যই অনেক সিনিয়র ছিলেন। আগেভাগে ভর্তি হয়েছিলাম দেখে মনে হয় কোচিং থেকে ভাল একটা ডিসকাউন্ট ও পেয়েছিলাম ভর্তির ক্ষেত্রে।

ফার্মেগেটের আনন্দ সিনেমা হলের ঠিক পাশের একটা বিল্ডিং এ আমাদের ক্লাস হত। একদিন মিজান ভাই আমাদের ক্লাসে এসে নিজে হাইবেঞ্চে বসলেন। এরপরে আমাদের বুঝাতে শুরু করলেন, বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে আমাদের কত সাধনা করতে হবে।

উনার কথাগুলা শুনছিলাম আর মনে মনে হতাশই হচ্ছিলাম। কারণ এত সাধনা তো আমার মধ্যে আমি কোনকালেই খুঁজে পাইনি। কি সর্বনাশ! তাহলে কি আমার আর বুয়েটে পড়া হবে না? এই ছিল কপালে?

মিজান ভাই বলতে লাগলে, গোসল করার সময়েও কেমিস্ট্রির রাসায়নিক সঙ্কেত নিয়ে ভাবতে হবে। গায়ে পানি ঢালতে হবে আর মনে করতে হবে, জিপসামের সঙ্কেত কি! এরপর উনি নিজেই উপরে দিকে তাকিয়ে ঘুরন্ত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে জিপসামের রাসায়নিক সঙ্কেত বললেন!

ভয়ে আমার গলা শুকায়ে গেল! এমন তো কত হাজার হাজার রাসায়নিক ফর্মুলা আছে। আমি কি করবো তাহলে? এরপর মিজান ভাইয়ের চোখ গেল ফ্যানের দিকে? উনি বললেন, তোরা কেউ এই ফ্যানটা হাত দিয়ে থামায়ে দিতে পারবি? (উনি স্নেহাধিক্যে সবাইকে তুই করে বলতেন)।

আমি বললাম ভাই, ফ্যান ফুল স্পিড়ে ঘুরছে, এটা হাত দিয়ে থামাতে গেলে আঙ্গুল কেটে পড়ে যাবে। উনি বললেন, যাহ! তুই কিচ্ছু জানিস না। এটা এত জোরে ঘুরলেও এখানে ফোর্স মোটেও এত বেশী না যে আঙ্গুল কেটে পড়ে যাবে।

এই বলে উনি নিজেই হাই বেঞ্চের উপরে দাঁড়িয়ে গেলেন আর চলন্ত ফ্যানের ব্লেডের উপরে হাত দিয়ে ঠিকই ফ্যান থামিয়ে দিলেন। এরপর আমাদের বললেন, তোদের ফিজিক্স এভাবেই বুঝতে হবে! আমি মনে মনে প্রমাদ গুনতে লাগলাম! আমি পারবো তো? বুয়েটে চান্স পাবো তো?

এরপরে যথা সময়ে ক্লাস শুরু হয়ে গেলো কোচিং এ। রঙ বেরঙ এর ছাত্র ছাত্রী সব এক ক্লাসে। ক্লাস নিতেন সব বুয়েটে চান্স পাওয়া ভাইয়া আপুরা! আমি ভাল করে উনাদের চেহারা দেখতাম।

আর মনে হত, আচ্ছা বুয়েটে চান্স পেতে হলে যেমন চেহারা দরকার, তেমন চেহারা আমার আছে তো? উনারা এসে লেকচার শিট খুলে কি কি ম্যাথ যে পড়াতেন, আমার মনে হত আমি এক বর্ণও বুঝতাম না। অথচ ক্লাসের সবাই ফটাফট একেকটা উত্তর দিত।

আমার ইচ্ছে হতো নিজেকে মাটিতে মিশিয়ে দেই। কলেজের সবচেয়ে কুলাঙ্গার ছাত্রটা মনে হত নিজেকে! ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় তো সবই পারতাম।

তাহলে এখন কিছু পারি না কেন? আর এরা কি কি সব ম্যাথ করাচ্ছে? অঙ্কগুলো পারা তো দূরের কথা, আমি তো তেমন কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি লজ্জায় কাউকে কিছু বলতেও পারছি না। এ কি দশা হলো আমার? সবাই পারে আর আমি কিছুই পারি না। এভাবে এক কি দুই সপ্তাহ গেল। আমার মধ্যে ক্রমাগত হতাশা বাড়তে লাগলো।

আমার কাছে ক্রমশ মনে হচ্ছিলো, কোচিং এ মনে হয় অনেক কঠিন জিনিস পড়াচ্ছে। আমি তাহলে পারি না কেন? আমি কি তাহলে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে সব ভুলে গেলাম? আমি তো লেখা পড়া বাদ দিয়ে কোথাও বেড়াতে যাইনি তাহলে আমি সব ভুলে গেলাম কি করে?

মাথার মধ্যে এইসব সাতকাহন উল্টাপালটা ভাবনাগুলো মনে হয় আমাকে প্রায় পাগল করে ফেলছিলো। কোচিং এ যেতেই ইচ্ছা করে না।

সপ্তাহ দুয়েক পরে, প্রথম ফিজিক্সের উইকলি পরীক্ষা হলো। দুইশ মার্কের পরীক্ষা। আমি কিছু কিছু উত্তর করলাম। বেশীরভাগ প্রশ্ন লিখতে পারা তো দূরের কথা, আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। প্রায় ফাঁকা খাতা জমা দিয়ে চলে আসলাম। খাতাটা যখন দিয়েছিল তখন আমার সত্যি সত্যি ইচ্ছে করছিলো মরে যাই!

সবাই পেয়েছে একশ দেড়শো এর উপরে। আর আমি পেয়েছি ৪৫/২০০! মাত্র পয়তাল্লিশ! নিজের ভেতরে ভেতরে আমি অনেক অসহায় হয়ে পড়লাম! আমি তো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি আমার বুয়েটে চান্স পাবার আর কোন সম্ভাবনাই রইলো না। আমি কোচিং থেকে বের হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, আমি আর কোচিং এ পড়বো না।

 

বুয়েটে চান্স পাবার জন্য নিজের জন্য যে আত্মবিশ্বাস আমি অর্জন করেছিলাম কলেজ থেকে তার সবটাই আমি প্রায় যজ্ঞাহুতি দিয়ে ফেলেছি দুই সপ্তাহ কোচিং করতে গিয়ে। আর মিরপুর দশ থেকে ফার্মগেট যাতায়াত করতে করতে অনেকটা সময় লেগে যেত। আমি কাউকে না বলে কোচিং ছেড়ে দিলাম। আর ওমুখো হলামই না একদম।

BUET

রাতের বুয়েট

এটা আমার বাসায় জানতো না। যখন জেনেছিলো তখন অবশ্য এজন্য আমাকে কিছু বলে নি। কারণ আমার প্যারেন্টস আমাকে সারাক্ষণই পড়তে(!) দেখতো!

আমি সারাক্ষণ পড়ার মানুষ কোন কালেই ছিলাম না। আমার বড় ফুফু আমেরিকা থেকে কিছু টেবিল ম্যাট নিয়ে এসেছিলেন যেখানে আমেরিকার তৎকালীন সব প্রেসিডেন্ট এর নাম এবং তাদের কার্যকাল ছবি সহ দেয়া ছিল। জর্জ ওয়াশিংটন থেকে একেবারে উইলিয়াম ক্লিনটন পর্যন্ত। সেই ম্যাটটা ফুফু আমাকে একটা দিয়েছিলেন। আমার পড়ার টেবিলেই থাকলো।

বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ম্যাটটা দেখতাম। সেই সময় তো আর ফেসবুক বা ইন্টারনেট ছিল না আমাদের জন্য যে সেগুলো থেকে বিনোদন নেবো। সেই ম্যাটটা দেখতে দেখতে আমার সিরিয়াল ধরে সব মার্কিন প্রেসিডেন্ট এর নাম মুখস্ত হয়ে গেল। একদম সিরিয়াল ধরে সব! উনাদের সম্পর্কে কিছু কিছু মজার মজার তথ্য ছিল, সেগুলোও সব একেবারে মুখস্ত হয়ে গেল।

সবচেয়ে ওজনদার প্রেসিডেন্ট ছিলেন উইলিয়াম হাওয়ার্ড ট্যাফট! সেটাও মুখস্ত হয়ে গেল। আমার ছিল ফাউন্টেন পেন দিয়ে লেখার অভ্যাস। ফাউন্টেন পেনে কালি ভরে আমার যা যা মন চাইত লিখতাম। কখনও ফিজিক্স, কখনও কেমিস্ট্রি, কখনও অঙ্ক করতাম।

অল্প জায়গায় কি করে লিখতে হয় সে ব্যাপারে ওমেগার কর্ণধার মিজান ভাই আমাদের বলেছিলেন বাসার সব বাতিল কাগজ, পুরানো খবরের কাগজ হাতের ধারে রাখতে। সেগুলার চিপাচুপায় যত জায়গা পাওয়া যায়। সেগুলোতে অঙ্ক প্র্যাকটিস করতে বলতেন।

আমি মাঝে মাঝে করতাম সেগুলো যেন লেখা অল্প জায়গায় সারতে পারি। সেই অভ্যাসটা এখনো রয়ে গেছে। আমি আমার জীবনের লেখা বেশীরভাগ ছড়া আর কবিতা সব ফেলে দেয়া কাগজে লিখেছি। পরে সেটা ইন্টারনেটে সেভ করে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি।

৬ই সেপ্টেম্বর ২০০১ এসে গেল আমার জীবনের দ্বিতীয় ‘কালদিন’ এবং ‘কালরাত্রি’ হয়ে। আমি দ্বিতীয়বারের মত আমার বাবাকে প্রচন্ড হতাশার মধ্যে ফেলে দিলাম। এতটাই হতাশ যে উনি আমার সাথে কথাবার্তা বলতেও পছন্দ করতেন না তখন আর ঘরে ঢুকে আমাকে দেখতেও মনে হয় পারতেন না সেই সময়ে।

কারণ আমি উনাদের আশানুরূপ রেজাল্ট করতে তো পারিই নাই, এবং সেটা মাধ্যমিকের তুলনায় আরোও অনেকটাই খারাপ। মাধ্যমিকে ৯১৮ মার্ক পেয়ে মাত্র ৩ নাম্বারের জন্য স্ট্যান্ড করতে না পারার শোক আমি আমার মন থেকে ধুয়ে মুছে ফেলেছি অনেক আগেই। কিন্তু সেই শোক আমার বাবা অদ্যবধি ভুলতে পারেন নাই।

সেখানে মাত্র দুই বছর যেতে না যেতেই আবার আমি তাকে শোকানলে ভাসিয়ে দিলাম। কি আশ্চর্য! ২০০১ এ আমাদের উচ্চমাধ্যমিকে ঢাকা বোর্ড এ এবারো ২০তম স্ট্যান্ড মার্ক এলো ঠিক মাধ্যমিকের মতই ৯২১ এবং সেটা পেল আমার স্কুল জীবনের সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু রেজা! রেজা এবং আমি দুইজনেই মাধ্যমিকে ৯১৮ পেয়ে ৩ নাম্বারের জন্য স্ট্যান্ড মিস করেছিলাম। রেজা এবার সেই ঘাটতি পুরণ করে নিয়েছে। আর আমি? আশা ভরসার সব বলয় থেকে ছিটকে চারটা লেটার সহ ৮৬৬ নাম্বার, স্টার নিয়ে পাশ করলাম ইন্টারমিডিয়েট।

পরীক্ষা এবং রেজাল্ট নিয়ে আমি সবসময় ভীষণ নার্ভাস থাকি। এজন্য আমার মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক কোন রেজাল্টই আমি নিজে আনতে যাই নি। দুই দফাই আমার বাবা গিয়েছিলেন এবং যারপরনাই হতাশ হয়ে ফিরে এসেছেন।

উচ্চমাধ্যমিকে অনেক আশা করেছিলেন আমি হয়ত ২০জনের মধ্যে থাকতে পারবো। আমার বন্ধু রেজা পেরে গেল। আমার দ্বারা কিছু হলো না। বাসায় এসে কথার পর কথা শুনতে লাগলাম।

আমার বাবা সরাসরি আমার মুখের উপরে কিছু না বললেও পাশ দিয়ে এমন ভাবে আমাকে শুনায়ে শুনায়ে কথা বলতেন যে প্রতিটা কথা আমার বুকের ভেতরে গিয়ে লাগতো।

রেজা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েই আমেরিকা চলে যায়। ও এখনও সেখানেই আছে এবং পারিবারিক ভাবেই ওরা সবাই মার্কিন নাগরিক। রেজা স্নাতকের লেখাপড়া সব আমেরিকাতেই করেছে।

আমার ঘনিষ্ট বন্ধুর সাথে তুলনা করে করে আমাকে প্রতিপদে পদে কথা শুনতে হয়েছে। আমি নিজেকে ঘরে বন্দী করে ফেললাম। টেবিল আর আমার খাট, আমার খাট আর টেবিল। এর বাইরে আমার আর কোন জগত ছিল না।

আমি বাসার কারও সাথে খেতে বসতাম না। খাবার নিয়ে আমার পড়ার টেবিলে চলে আসতাম। সেখানেই খেতাম। নিজের প্রতি নিজেরই একরকম ঘেন্না ধরে গেছিলো।

তার উপরে কোচিং করছিলাম না। মনে মনে জিদ করেছিলাম, ইন্টারমিডিয়েটে খারাপ করেছি বলে আমাকে এত কথা শুনতে হচ্ছে? ঠিক আছে বুয়েটে চান্স আমাকে পেয়ে দেখাতেই হবে।

আমার এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। জীবনে আমি কোথাও ভর্তি হবার জন্য এমন মরিয়া হয়ে উঠিনি যতটা বুয়েটে ভর্তির জন্য মরিয়ে হয়ে গেছিলাম মনে মনে। কাউকে কিছু বলতাম না। একা একা অঙ্ক করতাম, পড়তাম।

মনে মনে আল্লাহর কাছে চাইলাম, আমাকে তুমি এবার আর বিমুখ করে দিও না খোদা! আমার যে আর উপায় নেই! মনে মনে আমার দিন রাত একাকার হয়ে গেছিল। ভয়, লজ্জা আর অপমানে!

এভাবেই চলে যাচ্ছিলো দিনকাল। যখন আমার বাবা দেখলো আমি কোচিং এ যাচ্ছি না, তখন জিজ্ঞাসা করা হলে আমি বলেছিলাম, কোচিং শেষ। ম্যাটেরিয়াল সব দিয়ে দিয়েছে। আমি নিজে নিজে পড়ছি। উনি এ নিয়ে আর কথা বাড়াননি।

আমাকে নিয়ে উনি আদৌ কোন আশার আলো দেখতে পেয়েছিলেন কিনা জানি না। আর আমিও তখনও কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বলে কিছু আছে, সেটা জানতাম বলেও মনে হয় না। বেসরকারী কোন প্রতিষ্ঠানে পড়ার কথা অচিন্ত্য ছিল।

দেখতে দেখতে রমজান মাস এসে গেল। তখন নভেম্বর মাস চলছে। আমি একরকম গৃহবন্দী। পাশের বাসায় আমার এক বন্ধু ছিল খাদেমুল ইসলাম রাসেল। ওর কাছে মনে হয় একবার কি দুইবার গিয়েছি। এর বেশী কিছু না। বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষায় ইন্টিগ্রেশন জটিল আকারের দেয় কিছুটা। আমি দোকান থেক স্নাতকের ইটিগ্রেশন বই কিনে নিয়ে আসলাম। প্রফেসর আবু ইউসুফ স্যারের বই। সেখান থেকে ইন্টিগ্রেশন করা শুরু করলাম একা একাই। অনেক কিছুই নিজে নিজে শিখতে লাগলাম। সেই ২০০১ সাল থেকে আমার মধ্যে যে ইন্টিগ্রেশনের প্রতি ভালবাসা তৈরী হল, সেটা এখনও আছে।

এখনও আমি গণিতের যে যে শাখায় কাজ করেছি তার মধ্যে আমার সবচেয়ে পছন্দ হল সমাকলন বা ইন্টিগ্রেশন। আমি এখনও ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দিতে পারি শুধু ইন্টিগ্রেশন করেই। আমাদের ভর্তি পরীক্ষায় দুইটা ইন্টিগ্রেশন দিয়েছিল। তার একটা আমার এখনও মুখস্ত আছে এবং সেটা আমি মাত্র দুই লাইনে করে ফেলেছিলাম। cos x dx কে যে d(sin x) লিখে, অন্য চলক না ধরে, সরাসরি প্রতিস্থাপন করে ইন্টিগ্রেট করা যায় সেটা আমি আবু ইউসুফ স্যারের বই দেখে শিখেছিলাম এবং সেই বিদ্যা আমি বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় অ্যাপ্লাই করেছিলাম সার্থক ভাবে।

মনে পড়ে সেই কথা। রমজান মাসের শুরুতেই বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষার ফর্ম ছাড়া হলো। আগে ফর্ম কিনে সব নাম্বার সহ জমা দিবে, সেখান থেকে তারা হাজার পাঁচেক ছাত্র ছাত্রীকে পরীক্ষার জন্য অ্যালাউ করবে যাদের ফিজিক্স+কেমিস্ট্রি+ম্যাথমেটিক্স এই তিন সাব্জেক্টের সম্মিলিত নাম্বার ক্রমান্বয়ে সর্বোচ্চ থেকে শুরু হবে।

আমার ফর্ম কিনতে এবং জমা দিতে এবারো আমি যাইনি। আমার একজন চাচা আমার হয়ে কাজটা করে দিয়েছিলেন। পরে দেখলাম আমার তালিকায় নাম এসেছে। আল্লাহর অশেষ দয়া, আমার ঐ তিন সাব্জেক্টের নাম্বার উচ্চমাধ্যমিকে বেশ অনেকটাই ভাল ছিল।

২০০ নাম্বারের মধ্যে আমি পেয়েছিলাম ফিজিক্সে ১৮৩, ম্যাথমেটিক্সে ১৮৫ আর কেমিস্ট্রিতে ১৬১। পরে যখন আমাকে পরীক্ষার উপযুক্ত বলে নির্বাচন করলো বুয়েট পরীক্ষা কমিটি, আমি রোলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমার ভর্তি পরীক্ষার রোল নাম্বার ২০৩।

তার মানে সারা বাংলাদেশ থেকে যারা অ্যাপ্লাই করেছে তাদের ওই তিন সাব্জেক্টের সমিলিত নাম্বার অনুসারে আমার সিরিয়াল হয়েছে ২০৩। তবে কথা আছে, একাধিক জনের সম্মিলিত নাম্বার হুবহু এক হয়ে গেলে তাদের নামের অ্যালফাবেটিক ওর্ডার অনুসারে সাজাতে হবে।

আমার নাম যেহেতু Z দিয়ে শুরু হয়, সেহেতু আমার নাম শেষের দিকেই থাকবে বলাই বাহুল্য। তবুও নিশ্চিত হলাম, পরীক্ষা তো দিতে পারছি! এবার দিন গোনার পালা। পরীক্ষা ৩রা ডিসেম্বর ২০০১, সকাল ৯ টায়। হিসেব করে দেখলাম ১৭ নাম্বার রোজার দিনে পরীক্ষা। কোন রোজা এবং তারাবির নামাজ ছাড়ার কোন প্রশ্নই আসে না।

আমি নিয়মিত রোজা করতে লাগলাম এবং তারাবির নামাজও পড়তে লাগলাম। এক একটা দিন যায় আর আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন খালি খালি হয়ে আসে। ইফতার সাহরী সবকিছুতেই কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করতে লাগলাম, আল্লাহ আমাকে পার করে দাও।

শুধু চান্স পাওয়া নিয়েই নয়। আমি আরেকটা জিনিস খুব ভয় পেতাম। অনেক দোয়া করতাম যেন আমাদের ভর্তি পরীক্ষায় অঙ্কের ‘বিন্যাস সমাবেশ’ চ্যাপ্টার থেকে কোন অঙ্ক না আসে! আর আমি যেন ক্রিকোনমিতির কোন সূত্র ভুলে না যাই। এই চিন্তা আমার মনকে আচ্ছন্ন করে রাখতো। খুব দোয়া করতাম এগুলা নিয়ে। বিন্যাস সমাবেশের অঙ্ক আমার কাছে সবসময়ই খুব বিরক্তিকর এবং জটিল মনে হতো। আমার কোন ভাললাগা কাজ করতো না। দিন ক্রমশ এগিয়ে আসছে।

আমি নিজে নিজে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। পরীক্ষা একেবারে নাকের ডগায় চলে এলো। ২ ডিসেম্বর রাত ১০টা বাজে তখন। একটু আগেই তারাবির নামাজ পড়ে এসেছি।

নিজের মনকে একটু হালকা রাখার জন্য সবার সাথে একুশে টিভির খবর দেখছিলাম আর কি মনে করে যেন, কেমিস্ট্রি দ্বিতীয় পত্র থেকে একদম শেষ অধ্যায়ের ‘রাইবোজ’ এর চাক্রিক গঠন আঁকছিলাম। আমার জানামতে ওটাই আমার বুয়েট ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির শেষ পড়া। এরপরে আমাকে জোর করে ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হল শুয়ে পড়ার জন্য এবং বাসায় সবাই সেদিন আগেই শুয়ে পড়লো যেন আমার কোন অসুবিধা না হয়। আমি শুয়ে পড়লাম ঠিকই, ক্লান্তও লাগছিলো। ঘুম আসছিলো।

কিন্তু তারপরেও মনে হলো ঘুম হলো না। আধো ঘুম আধো জাগরনের মত একটা অবস্থা তৈরী হয়ে গেল। সেইভাবেই আমি শুয়ে রইলাম। বারবার এপাশ ওপাশ করছিলাম। মনে মনে চাইছিলাম আমার একটু ঘুম হোক! আধা ভাসা ঘুম যাকে বলে সেটাই হল।

সাহরীর সময় বাবা মার ঘর থেকে অ্যালার্ম বেজে উঠলো, সেটা আমি ঘুমের মধ্যেও স্পষ্ট শুনলাম। সাথে সাথে আমার চোখ খুলে গেল। উঠে গেলাম। তেমন খেতে পারলাম না কিছু। এরপর ফজরের নামাজ পড়ে আবার এওটু শুয়ে থাকলাম জাস্ট। আর ঘুমানো সম্ভব নয়। কারণ বাবার সাথে মটর বাইকে করে বের হয়ে পড়বো সকাল ৭ টার মধ্যেই। কোন রিস্ক নেয়া যাবে না।

সাতটায় ঘর থেকে বের হবার আগে দুই রাকাত নামাজ পড়ে আম্মুর কাছে দোয়া চেয়ে বের হলাম।

buet

IIT Building, BUET

বাবা মটর বাইকে করে নিয়ে গেলেন আমাকে বুয়েটে। ক’টায় পৌঁছেছিলাম ঠিক মনে নাই, তবে নির্বিঘ্নেই গেছিলাম। গিয়ে সিট খুঁজে দেখলাম সিভিল বিল্ডিঙ এ সিট পড়েছে। সিভিল বিল্ডিং পেতে তো আর কষ্ট হবার কথা নয়। আমি কি পোষাক পরে গিয়েছিলাম আমার সেটাও মনে আছে। কালো রঙের ফুলহাতা কলার ছাড়া গেঞ্জি, আর গ্যাবার্ডিনের ঢোলা একটা প্যান্ট। শীতকালেও আমি জুতা পরি না। পায়ে যথারীতি স্যান্ডেল।

৯ টা বাজার বেশ কিছুক্ষণ আগেই আমি চলে গেলাম হলের উদ্দেশ্যে। যাবার আগে বাবা কে বললাম, দোয়া কইরো। আমার বাবা আমার মুখ ধরে কপালে একোটা চুমু দিলেন। সাহস দিয়ে বললেন, চিন্তা করো না, পরীক্ষা ইনশাল্লাহ ভাল হবে। আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম। এরপরে অন্য সবার সাথে দেখাদেখি হলে চলে গেলাম। আমার সিট পড়েছিল একদম সামনের বেঞ্চের কোনায়।

আমার পাশে একটা ছেলে বসেছিল। আর সেই ছেলেটার ঠিক পেছনেই বসেছিল আমার স্কুলের বন্ধু তানভীর! আমার রুমে আমার স্কুলের বন্ধুকে দেখে আমার মনের সাহস মনে হল বেড়ে গেল। আমি চুপচাপ দোয়া দুরুদ পড়তে লাগলাম। চোখ একটু একটু পরপর ঘড়ির দিকে চলে যাচ্ছিলো। পরীক্ষা শুরুর ১০ কি ১২ মিনিট আছে ইনভিজিলেটর দুইজন আসলেন। একজন সিনিওর শিক্ষক।

গম্ভীর মুখে চেয়ারে গিয়ে বসলেন। আরেকজন অপেক্ষাকৃত কম বয়স্ক স্যার। সিনিওর শিক্ষক যিনি ছিলেন তিনি সিভিল এঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর বসুনিয়া স্যার। আমি পরে জেনেছিলাম। অন্য শিক্ষকের কথা আমার একদমই মনে নেই। বসুনিয়া স্যার আমাদের নিয়ম কানুনগুলো জানিয়ে দিলেন। আর একটু একটু পর পর বলতে লাগলেন ‘রিল্যাক্স’। এটা একটা সাধারন পরীক্ষা!

তোমার রিল্যাক্স থাকো! স্যার এর মুখে এক একবার ‘রিল্যাক্স’ শুনছিলাম আর আমার মনে হচ্ছিলো আমি ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠি। অযথাই ভয় পাচ্ছিলাম। আমার জন্য ব্যাপারটা কেমন যেন জীবন মরণ টাইপ হয়ে গেছিলো। সারা জীবনের স্বপ্ন আমার বুয়েটে পড়তে হবে। পাবো তো চান্স? আমি মাত্র দুইটা ফর্মই কিনেছিলাম।

বুয়েট আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অন্য কোথাও পরীক্ষা দেয়ার কথা চিন্তা করা তো দূরের কথা, আমি ফর্ম কেনার কথাও চিন্তা করিনি। এখনও এটা চিন্তা করতে আমার গা শিউরে ওঠে। কি ভয়ঙ্কর এক জুয়া খেলেছিলাম নিজের ভাগ্য নিয়ে।

আমাদে সময় এঞ্জিরিয়ারিং অনুষদে দুই ভাগে পরীক্ষা হত। মোট ৬০ টি প্রশ্ন ৬০০ নাম্বারের পরীক্ষা। সবই লিখতে হবে। প্রথম বুকলেটে থাকবে ম্যাথমেটিক্স ১৮ টি প্রশ্ন, ফিজিক্স ১৮ টি প্রশ্ন আর ইংলিশ ৬ টি প্রশ্ন! এটা শেষ হয়ে গেলে ১০ মিনিটের বিরতি দিয়ে দেয়া হবে দ্বিতীয় বুকলেট।

সেটায় থাকবে শুধুমাত্র ১৮ টি কেমিস্ট্রির প্রশ্ন। এখন শুনছি ইংলিশ নাকি নেয়াই হয় না! আমাদের সময় ইংলিশ ছিল। যথা সময়ে ঘন্টা দিয়ে দিলো।

প্রথম পর্বে কোশ্চেন বুকলেট আগেই দেয়া ছিল। আমরা নাম রোল লিখে বসে ছিলাম। দোয়া দুরুদ পড়ছিলাম। ঘন্টা দেবার সাথে সাথে বুকলেট খুললাম আল্লাহর নাম নিয়ে। প্রতিটি প্রশ্নের জন্য সর্বসাকুল্যে বরাদ্দ ৩ মিনিট!

এর বেশী ব্যায় করে ফেললে, পরের প্রশ্নের জন্য সময় কমে যাবে। আমি চট চট করে সবগুলা পৃষ্টা উলটে দেখলাম কোশ্চেন ঠিক মত প্রিন্ট করা আছে কিনা! এমন নির্দেশ দেয়া ছিল। আমার প্রশ্নে কোন সমস্যা ছিল না। প্রথমেই অঙ্ক এবং ম্যাট্রিক্সের অঙ্ক দিয়ে শুরু। দেখি এমন কোন কঠিন প্রশ্ন না।

ম্যাট্রিক্স করতে গিয়ে দেখি আমার প্রায় ৭ মিনিটের মত ব্যায় হয়ে গেছে। হঠাৎ করে মাথায় রক্ত উঠে গেল। নিজেকে বোঝালাম অসুবিধা নেই। এরপরে দ্রুত উড়ে উড়ে যেতে লাগলাম। যেগুলো প্রথম দেখাতেই খটকা মনে হচ্ছিলো, সেটা বাদ দিয়ে পরেরটায় চলে গেলাম। এমন করতে করতে যাচ্ছি। এক সময় দেখি বুকলেট শেষ!

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমার হাতে কিভাবে যেন এখনও অনেক সময় রয়ে গেছে। কোত্থেকে যেন মনের মধ্যে অনেক সাহস পেয়ে গেলাম আমি। আমার শুরু করলাম প্রথম থেকে দেখা। যেগুলো ফাঁকা রেখে গিয়েছিলাম সগুলোতে চোখ বুলালাম! আল্লাহর সাহায্য মনে হয় একেই বলে!

শুরুতে না পারা অনেক কিছুই এখন দেখি পারছি। চট চট করে যেগুলো পারলাম করতে লাগলাম। আর যেগুলো চিন্তা করেও মাথায় আসছিল না সেগুলো ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর নামে, পারাগুলোর উত্তর মেলাতে লাগলাম ক্যালকুলেটর দিয়ে।

অনেকেই হয়ত বললে বিশ্বাস করবে কি না জানি না। আমি আমার প্রথম বুকলেটটা প্রায় আড়াই বারের মত রিভিশন দিতে পেরেছিলাম। আমার মনোবল অনেক অনেক বেড়ে গেল। ঘন্টা পড়ে গেল। প্রথম বুকলেট জমা দিয়ে দিলাম।

বসুনিয়া স্যার আবার বলতে লাগলেন রিল্যাক্স রিল্যাক্স! আমার এবার আর একটুও ভয় লাগছিল না। মনে সাহস বেড়ে গেল। এরপর তো শুধুই কেমিস্ট্রি আমার জন্য। আর যারা আর্কিটেকচারে পরীক্ষা দেবে ওদের আবার কোন বিল্ডিং এ কখন যেতে হবে বলে দিলেন। আমি সেটার তোয়াক্কা করলাম না। আমার কি?

আমার তো আর আর্কিটেকচারে পরীক্ষা নেই। ওয়াশরুমে যাবার কিছু ইচ্ছা থাকলেও সেটা স্থগিত করে দিলাম। ভাবলাম একবারে পরীক্ষা শেষ করে নেই। আর অল্প একটুই তো।

দশমিনিট পরে আবার ঘন্টা পড়লো। এবার শুরু হলো কেমিস্ট্রি পরীক্ষা। প্রথম প্রশ্ন দেখেই মন আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। রাইবোজ এর চাক্রিক গঠন আঁকতে হবে! কাল রাতে আমার পড়া শেষ জিনিস! মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম।

কেমিস্ট্রিতে সব তো আর অঙ্ক ছিল না। কিছু কিছু লেখার জিনিস ও ছিল। সাহস বেড়ে গেল। বেশ ভালই দিলাম কেমিস্ট্রি। কিছু বাদ রাখেছিলাম বলে মনে পড়ে না। মোটামুটি পেরেছিলাম। মনের সাহস বেড়ে গেল। মনে আশাও বাড়তে লাগলো। হয়তো আল্লাহ মুখ তুলে চেয়েছেন।

হয়তো আমি পার পেয়ে যাবো। মন থেকে ঐকান্তিক ভাবে কিছু চেয়ে পাইনি আল্লাহর কাছে, সেটা হয়নি কখনও! একসময় পরীক্ষা শেষ হলো। আমি হাফ ছেড়ে বাচলাম।

কিন্তু শরীর ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল আমার। অনেক কষ্টে হাঁটছিলাম হল থেকে বের হয়ে। সিঁড়ি দিয়ে নামলাম। নির্দিষ্ট জায়গায় দেখলাম বাবা দাঁড়িয়ে আছেন।

উনি যান নি কোথাও। বুয়েটের বাইরে মেডিক্যালের দিকে যে মসজিদ আছে সেখানে বসে বসে অপেক্ষা করছিলেন। আমাকে দেখে মুচকি হেসে আমার মুখের ভাব খেয়াল করলেন।

আমিও একটু মুচকি হেসে দিলাম। শুধু জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন হয়েছে? আমি সেটার উত্তর না দিয়ে এইটুকুই বললাম, ইনশাআল্লাহ চান্স পাবো! কিন্তু কোথায় বা কোন সাব্জেক্টে পাবো বলতে পারছি না। বাবা বললেন আলহামদুলিল্লাহ। মনে মনে একটু আশা পেয়েছিলেন কি?

পেয়েছিলেন হয়ত। না পেলেও তো আমি দোষ দিতে পারছি না। দুই দুইবার আমি তাকে প্রচন্ড হতাশ করেছি। পরীক্ষা দিয়ে এসে মনে হল আমার মাথা পুরো ফাঁকা হয়ে গেছে।

শরীরে বল নাই। রোজার ক্লান্তি কিছুটা আর গত রাতের ভাসা ভাসা ঘুমের ইফেক্ট কিছুটা ভর করলো শরীরে। বাসায় চলে আসলাম।

সেবার আমি নিয়ত করেছিলাম রমজানের শেষ দশদিন মাসজিদে অবস্থান করা বা এ’তেকাফ করবো। যেহেতু পড়ার আর কোন প্রেসার আপাতত নেই, কাজেই বাসা থেকে কোন আপত্তি তুললো না। সানন্দে সবাই রাজী।

আমি বললাম তাহলে আগামীকাল দিনটা আমি শ্যামলী ছোট খালার বাসা থেকে ঘুরে আসি।

এরপর ১৯ নাম্বার রোজার ইফতারের আগে তো আমাকে মাসজিদে চলে যেতে হবে। যথাসময়ে আমি মাসজিদে অবস্থান করতে লাগলাম।

ধর্মীয় বিধান অনুসারে শুধু ওয়াশরুমে যাওয়া ছাড়া মাসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে না। সময় মত বাসা থেকে কেউ না কেউ খাবার এনে দিতে লাগলো মাসজিদে। আমার সাথে আরেকটা ভাই এবং বয়স্ক এক মুরুব্বী গোছের মানুষ তারাও ছিল এতেকাফে।

একা থাকলে যে একাকীত্ব বোধ হত সেটা আর হল না। ঐ ভাইয়ার সাথে আমি অনেক ফ্রি ছিলাম। রোজা, নামাজ, কোরান তেলাওয়াত আর গল্পে গল্পে আমাদের সময় পার হতে লাগলো। বুয়েট থেকে বলা ছিল দুই সপ্তাহ পরে রেজাল্ট দেয়া হয়ে।

অর্থাৎ রোজার ঈদের কয়েকদিন পরে। আমি সেভাবেই থাকলাম আর ঐকান্তিক ভাবে দুয়া করতে লাগলাম, আল্লাহ আমি যেন ব্যর্থ না হই। সেবার রোজা হয়েছিল ৩০টি। ঈদের তিনদিন আগে আমার বাবা শার্ট প্যান্ট করে নয়টা বা দশটার দিকে হাজির মাসজিদে। অসময়ে। এমন সময় তো উনি আসেন না।

এসে দেখলেন আমি কোরাণ শরীফ পড়ছিলাম জোরে জোরে। কিছুক্ষণ পাশে বসে শুনলেন আমার পড়া। এরপর বললেন, আচ্ছা তোমার ভর্তি পরীক্ষার রোল যেন কত ছিল?

আমার একটু সন্দেহ লাগলো। আমি বললাম কেন? উনি বললেন, না তোমার ছোটখালু জিজ্ঞাসা করছিলেন। আমি বললাম ২০৩। এরপর উনি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমা সারাদিন যেভাবে মাসজিদে কাটে সেভাবেই কাটলো।

আমি তখনো জানতাম না, ঐদিনই বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে দিয়েছে এবং বুয়েট যে প্রতিবছর নির্দিষ্ট তারিখের কিছুদিন আগেই হঠাৎ করে সার্কুলার দিয়ে রেজাল্ট দিয়ে দেয় সেটা আমার জানা ছিল না। আমার মনের ভেতরে ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ হয়নি।

আমি সারাদিন আমার মতই স্বাভাবিক ছিলাম। আমার বাবা জানতেন আমি রেজাল্ট দিবে জানতে পারলে হয়ত টেনশনে থাকতে পারবো না। আর তখন মোবালের যুগ ছিল না। আমার বাবার কাছে ছিল, আমার কাছে নয়। এজন্য উনি আমাকে বলেন নি।
এশার আযান হয়ে গেছে। আমি এশা এবং তারাবির নামাজের জন্য আগেভাগে তৈরী হয়ে প্রথম কাতারে গিয়ে দাঁড়িয়েছি।

ইকামাত শুরু হয়ে যাবে। সবাই দাঁড়িয়ে গেছে নামাজের জন্য। আমি খেয়াল করলাম আমার জামা কে যেন পেছন থেকে টানছে!

আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে, কোন ভুল হয়ে গেল কিনা সেটা মনে পরে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম আমার চাচা, যিনি আমার বাবার আপন খালাতো ভাই এবং বাবার থেকে কিছুটা বড় বয়সে, আমরা নঈম আঙ্কেল বলে ডাকি, সেই আঙ্কেল আমাকে হাতের ইশারায় পেছনে ডাকছেন। হাসছেন!

আমি হতবিহ্ববল হয়ে কাতার থেকে বের হয়ে আঙ্কেলের সাথে মাসজিদের দরজার কাছে চলে এলাম। শুধু এইটুকুই বললাম আঙ্কেল কি হইসে? উনি হেসে দিয়ে বললেন, ‘শাওন কংগ্রাচুলেশন্স! তুমি বুয়েটে চান্স পেয়েছো’! বিশ্বাস কর, এই কথা শোনার সাথে আমার মনে হল আমার পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে গেল।

আমি আর কিছুই চিন্তা করতে পারছিলাম না। আঙ্কেল বললেন, নামাজের পরে তোমার আব্বু এসে জানাবে। আমি বললাম, আঙ্কেল আজকে দিলো রেজাল্ট? ঈদের পরে দেয়ার কথা ছিল। বললেন, হ্যাঁ আজকেই দিয়েছে। তোমার আব্বু আর খালু গিয়ে রেজাল্ট নিয়ে এসেছে।

তখন বুঝলাম সকাল বেলা আমার কাছ থেকে রোল নাম্বার জিজ্ঞাসা করার রহস্য। তখনকার দিনে তো ইন্টারনেটে রেজাল্ট নেয়ার সুযোগ ছিল না। হাজার হাজার মানুষের ভিড় উপেক্ষা করে না জানি কত কষ্ট করে উনাদের রেজাল্ট আনতে হয়েছিল সেদিন! আমি নঈম আঙ্কেলকে আর কিছু বলতে পারলাম না। গলা শুকিয়ে গেল। পানি যে খাবো সেই সুযোগও নেই।

ইকামাতের শেষ পর্যায়ে। আমি আঙ্কেলকে থ্যাঙ্ক ইউ বলে আবার নামাজে চলে গেলাম। তবে এবার তো শেষের কাতারের দিকে। ইমাম সাহেব তাকবীরে তাহরিমা “আল্লহু আকবর” বলে নামাজ শুরু করে দিলেন। আমিও নামাদের দাঁড়িয়ে গেলাম।

খেয়াল করলাম আমার পুরো শরীর কাঁপছে! আমার দুই চোখ দিয়ে দরদর করে পানি ঝরতেসে!
আমার সেই মুহুর্তের অনুভুতি, জীবনের কোন আনন্দের সাথে তুলনীয় নয়।

আমাকে যেদিন ডক্টরাল রিসার্চের ডিফেন্সের পরে প্রথম আমাকে ‘ডক্টর জায়েদ কংগ্রাচুলেশন্স’ বলে থিসিস কমিটির চেয়ারম্যান হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেদিনও আনন্দ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা বুয়েটে চান্স পাওয়ার আনন্দের সাথে কোন অবস্থাতেই তুলনীয় নয়।

সেদিন নামাজে আমার চোখ থেকে পানি ঝরছিলো। আর ডক্টর উপাধি পাওয়ার দিন আমি একটু শুকনা হাসি দিয়েছিলাম।

উল্লেখ্য আমার পি.এইচ.ডি থিসিস ডিফেন্স ও রমজান মাসেই হয়েছিল এবং তখনও আমি রোজা অবস্থাতেই ডিফেন্স দিয়েছি। আমার সেই নঈম আঙ্কেল আর বেঁচে নেই। যার মুখ থেকে জীবনের সবচেয়ে কাঙ্খিত সুসংবাদ শুনেছিলাম সেই আঙ্কেল কয়েক বছর আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কখনও ভুলি না উনার কথা। মন থেকে দুয়া করি আঙ্কেলের জন্য।

আমার মা বুয়েটের রেজাল্ট দেয়ার একদিন আগেই ঈদ করতে আমার নানাবাড়ি খুলনা চলে গিয়েছিলেন।

যাবার আগে মাসজিদের গেটের কাছে এসে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গিয়েছিলেন। রাতে আমার বাবা এলেন। তখন উনার কাছ থেকে শুনলাম আমি বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষায় ৪০৮ তম হয়ে উত্তীর্ণ হয়েছি। ২০৩ সিরিয়ালে পরীক্ষা দিয়ে মেধাতালিকায় ৪০৮তম! আমার মাথায় প্রথমেই যেই উদ্ভট কথাটা মাথায় এসেছিল, আমি তো অ্যালকেন এর মত! CnH2n+2 অর্থাৎ কার্বনের নাম্বার যত হাইড্রোজেন তার দ্বিগুন থেকে দুটি বেশী!

আমার এই উদ্ভট চিন্তার কোন মানেই হয় না। ২৮ রোজা চলে তখন। যদি রোজা ২৯ টি হয় তবে পরশুদিন ঈদ। কোনভাবেই টিকেট পাওয়া সম্ভব নয় বাসের। সব বুকিং হয়ে যাচ্ছে। বাবাকে কিছু বলার সাহস পেলাম না।

আসলে আমারও নানুবাড়িতে সবার মত যেতে ইচ্ছা করছিলো। এত আনন্দের সংবাদ ঘটে গেল জীবনে, সবার মধ্যে না গেলে কিভাবে হয়। পরেরদিন ঈদের চাঁদ উঠলো না। অর্থাৎ রোজা আরেকটা বাড়িয়ে ৩০টি করতে হবে।

ঈদ একদিন পরে হওয়াতে আবার কতগুলো বাসের টিকেটের সুযোগ হাতে আসলো। পরদিন বাবা বললেন, তুমি কি খুলনা যেতে চাও? আমি বললাম, ইচ্ছা তো করছে। তখন উনি বললেন, চিন্তা করো না, ঈদ একদিন পরে হওয়াতে টিকেট পাওয়া যাবে। আমি ম্যানেজ করে ফেলবো।

তারপরদিন অর্থাৎ ৩০ নাম্বার রোজা বা শেষ রোজার ইফতার করার সাথে সাথে আমাদের দশদিনের এতেকাফ শেষ হলো। আমি জিনিস পত্র গুছিয়ে বাসায় এসে নাইট কোচে খুলনা রওনা দিলাম। ভোর রাতে গিয়ে পৌছুলাম নানাবাড়ি। আমার জীবনের একটা শ্রেষ্ঠ ঈদ ছিল সেটি।

অবশ্য তখনও কিসে পড়তে পারবো না পারবো সেটা নিয়ে মানুষের জল্পনা কল্পনার শেষ ছিল না। আমার বাবা তো অনেকটা অস্থির হয়ে পড়েছিলেন যখন শুনেছিলেন এই রেজল্টে তো কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড এঞ্জিনিয়ারিং হবে না।

তখন উনার মধ্যে আবার কিছুটা হতাশা কাজ করেছিল বৈকি!
আমার আম্মু অবশ্য একটু ব্যতিক্রম এক্ষেত্রে। উনি শুনেই বলেছিলেন, তুমি কেমিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং নিও। তোমার জন্য ভাল হবে সেইটা।

ল্যাবে কাজ করতে পারবা! উনার কথাটা মাথায় বসে গিয়েছিল আমার। আমার কেমিস্ট্রি তো আমার বরাবরই অনেক প্রিয় বিষয়। কাজেই আমিও মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, বুয়েট এবং কেমিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং!

ঈদ করে খুলনা থেকে আসার পরে একদিন সাবজেক্ট চয়েসের ফর্ম ফিলাপ করতে বসলাম। সেটা হাতে নিয়ে দেখলাম সবগুলা ডিপার্টমেন্ট এর নাম দেয়া।

তখন দশটি বিষয় ছিল। নিজের পছন্দ অনুসারে ১ থেকে ১০ নাম্বার দিতে হবে। এরপরে চান্স পাওয়ার সিরিয়াল অনুসারে যেটা হয়। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।

কি করলে আমি কেমিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং পাবো তাও বুঝতে পারছিলাম না। বাবা বললেন তুমি তোমার মিলন ভাইয়ার কাছে জিজ্ঞাসা করো। ও তোমাকে ভাল পরামর্শ দিতে পারবে। মিলন ভাইয়াকে ফোন দিলাম।

মিলন ভাইয়া বুয়েটের মেকানিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং থেকে ১৯৯৩ সালের ব্যাচ। পাশ করে চাকরীতে ঢুকে গেছেন। ১৯৯৭ সালে আমি যখন ক্লাস নাইন এ পড়তাম তখন মিলন ভাইয়াদের কোচিং এ আমি পড়তাম। আর উনি আমার দ্বিতীয় স্তরের কাজিন হন।

উনি আমাকে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন, যে আমি কম্পিউটার আর ইলেক্ট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্ট কে যদি ১ এবং ২ দেই তাহলে আমার মেরিট পজিশন অনুসারে পাবো না। এছাড়া ওই দুইটাকে ১,২ তে রাখলে তিন নাম্বারে আমি যেটাই দিব, সেটাই পেয়ে যাবো! আমি আশায় বুক বাধলাম।

উনি এও বুঝিয়ে দিলেন, ঐ দুই ডিপার্টমেন্ট কে ১ বা ২ তে না রেখে অন্য কোন ডিপার্টমেন্ট কে ১ দিলেও আমি সেটা পেয়ে যাবো। আমি বুঝে গেলাম। আমি আমার পছন্দ অনুসারে আমার প্রিয় ডিপার্টমেন্ট কে আমার পছন্দের তালিকায় ১ নাম্বারে রাখলাম। পরে পেয়েও গেলাম সেটা।

উল্লেখ থাকে যে, এই মিলন ভাইয়াও কিছুদিন আগে অর্থাৎ ২০শে নভেম্বর ২০২০, কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন মাত্র ৪৬ বছর বয়সে। আমাদের জীবনের দুই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকা নঈম আঙ্কেল আর মিলন ভাই, কেউই আর দুনিয়ার নেই। আল্লাহ তাদের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল করুণ।

ঠিক ১৯ বছর আগের স্মৃতিচারণ করতে বসবো আজ তোমার কাছে। ২০০১ থেকে ২০২০ অনেক বছরের দুরত্ব।২০০২ সালের জানুয়ারীর ৬ তারিখে আমাদের ডাকা হলো মেডিক্যাল চেকাপ এবং আইডি কার্ড নেয়ার জন্য। এবারো আমার বাবার সাথেই গেলাম। গিয়ে দেখলাম অফিসিয়ালি আমাকে কেমিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং দেয়া হয়েছে এবং আমার রোল নাম্বার পেলাম 0102010 অর্থাৎ আমার রোল হল দশ!

আমার আগে মাত্র ৯ জন কেমিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং নিয়েছে। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম যে আমি আমার পছন্দের সাব্জেক্ট পেয়ে গিয়েছি। আপাতত এই ছিল আমার স্মৃতিচারণ! ইন্টারমিডিয়েট থেকে শুরু করে কেমিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট পাওয়া পর্যন্ত।

লেখাঃ শাওন জায়েদ বিন জাকির

সহকারী অধ্যাপক

রসায়ন বিভাগ