বাঁধের সামনে আরেকটা বাঁধ নির্মাণ কি সত্যিই কোন বাস্তবসম্মত সমাধান নাকি মানুষের সরলমনের ফ্যান্টাসি/ফিকশন

(প্রথমেই বলে নেই আমার স্পেশালাইজেশন ওয়াটার রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং এর উপর। আমার সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশুনার একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল “ইন্ট্রিগেটেড ওয়াটার রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট”। এছাড়াও প্রফেশনাল লাইফে আমি একজন ব্রিজ ডিজাইনার (যেটাও বাঁধের মতো নদীর উপর একটা ইন্টারভেনশন)। আমি এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড ও পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের ৩ টা ব্রীজ প্রজেক্টে সরাসরি যুক্ত ছিলাম। তাই নিচের লেখাটা আমি যথেষ্ট প্র‍্যাক্টিকাল নলেজ নিয়েই লিখছি।)

এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি যে দাবীটা আমার চোখে পরছে সেটা হল বাঁধের সামনে আরেকটা বাঁধ নির্মাণ করেন, যত টাকা লাগে দেশের জনগণ দিবে।মজার ব্যাপার হচ্ছে আমাদের দেশে কিন্তু অলরেডি এরকম সিনারিও রয়েছে। তিস্তা নদীর উপর ভারত যে বাঁধ নির্মাণ করেছে সেটার নাম “গাজলদোবা বাঁধ”। তার একটু ডাউনস্ট্রিমেই বাংলাদেশে নীলফামারীতে তিস্তা নদীর উপরেই রয়েছে “তিস্তা বাঁধ।” এই তিস্তা বাঁধ উত্তরাঞ্চলে “মঙ্গা” মোকাবেলায় খুবই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখলেও এত অল্প দূরত্বে দুইটি বাঁধ নদীর ডাউনস্ট্রিমকে একদম ধূ ধূ বালুতে পরিণত করেছে। তাই আপনি যদি অপরিকল্পিতভাবে ইন্ডিয়ার সব ট্রান্সবাউন্ডারি রিভারের বাঁধের সামনে আরেকটা বাঁধ নির্মাণ শুরু করেন, তাহলে খুব ভালো সম্ভাবনা আছে বাংলাদেশ পুরোপুরি মরূভূমিতে পরিণত হবে।

দ্বিতীয়ত, ইন্ডিয়া বাঁধ খুলে দিলে আমরা আমাদের বাঁধ বন্ধ করে দিব, বন্যার পানি আবার ভারতে চলে যাবে। শুনতে খুব মজার মনে হলেও ব্যাপারটা এত সিম্পল না। নদীর ধর্ম হচ্ছে আপস্ট্রিম থেকে ডাউনস্ট্রিমে যাওয়া। তাই আপনি বাংলাদেশ অংশে একটা বাঁধ নির্মাণ করে দিলেই নদী রিভার্স দিকে প্রবাহিত হওয়া শুরু করবে এটার সম্ভাবনা খুবই কম।এক্ষেত্রে দুইটা জিনিস হতে পারে ১. নদী ব্যারেজের আশেপাশে আরেকটা অলটারনেট রুট তৈরী করে সেদিক দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করবে, ২. নদীর পানি বাঁধের একদম আপস্ট্রিমেই জমা হতে হতে এক সময় বাঁধ ভেঙ্গে ফেলবে বা ওভারটপ করবে। দুইটা সিনারিওতেই কিন্তু পরিণতি একই-বাংলাদেশে আরো ভয়ানক ফ্ল্যাশ ফ্লাড এবং তীব্র নদী ভাঙন।

তাহলে কি এর কোনো সমাধান নেই?
অবশ্যই আছে। প্রথমত, ভারতের উপর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে অতিদ্রুত পানিবন্টন চুক্তি করতে হবে।মনে রাখতে হবে, ভারত বাংলাদেশের বর্ডারে ৩০ টার মতো বাঁধ নির্মাণ করেছে।অথচ এক ফারাক্কা বাঁধ ছাড়া আর কোনো বাঁধের সাথেই পানি বন্টন চুক্তি নেই। তাছাড়া কোনো প্রকার গাইডলাইন ফলো না করে এক রাতের মধ্যে বাঁধের সব কয়টি দরজা খুলে দেওয়ার মত জঘন্য/ঘৃণিত কাজগুলো কে জবাবদিহিতার আয়তায় আনতে হবে।

দ্বিতীয়ত, সেঁচ প্রকল্প বা মেগা স্কেলে রিজার্ভার প্রকল্প হাতে নিতে হবে। খুব সহজ ভাষায় যদি বলি, নদীর প্যারালালে একটা কৃত্রিম খাল/রিজার্ভার খনন করে রাখবেন।বন্যার সময় নদীর পানি উপচে এই খাল/রিজার্ভারে জমা হবে। যা খরার মৌসুমে চাষাবাদের কাজে ব্যবহার করা যাবে। তবে এক্ষেত্রে ফসলী জমির উর্বরতা কমে যাওয়ার খুব ভাল সম্ভবনা রয়েছে।বাংলাদেশের মাটি উর্বর হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে বন্যার সময় পানির সাথে চলে আসা পলি।আমার যতদূর মনে পরে আওয়ামী লীগ সরকার এরকম একটা প্রকল্পের জন্য ৩-৪ বছর আগে চীনের সাথে চুক্তি করেছিল। সেই প্রকল্পের কাজ আদৌ শুরু হয়েছে কিনা জানা নেই।

তৃতীয়ত, নদীর নাব্যতা রক্ষা করা। বাংলাদেশ ঘনঘন বন্যা হওয়ার পেছনে অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে ভারতীয় অংশে বাঁধ থাকার কারণে বাংলাদেশি অংশে নদীর প্রস্থতা এবং গভীরতা কমে যাওয়া। নদীর এই ক্ষয়ে যাওয়া নাব্যতাকে পরিকল্পিত ড্রেজিং বা অন্য কোন উপায়ে রক্ষা করতে পারলেও বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব।

সবশেষে, ইন্ট্রিগেটেড ওয়াটার রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট খুবই কমপ্লিকেটেড একটা জিনিস। তাই এই ফিল্ডে অপরিকল্পিত যে কোন জিনিস আশীর্বাদের বদলে অভিশাপ বয়ে নিয়ে আসে। অতীতে বাংলাদেশের উপকূলে অপরিকল্পিতভাবে পোল্ডার নির্মাণের মাধ্যমে লবণাক্ততা বাড়িয়ে ফেলারও নজির রয়েছে। তবে বিপরীত চিত্র রয়েছে নেদারল্যান্ডে। যারা সফল “ইন্ট্রিগেটেড ওয়াটার রিসোর্স ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে নিজেদের ইফেক্টিভ ল্যান্ডের পরিমাণ ২০% পর্যন্ত বাড়াতে সক্ষম হয়েছে।

– তাণভীরুল ইসলাম অমিও