সত্তর দশকের শেষেও মোহাম্মদপুরের সাতমসজিদের পাশেই ছিল বুড়িগঙ্গা নদী (বাঁয়ে), দখলে বিপর্যস্ত নদী এখন হারিয়ে ফেলেছে আদি চ্যানেল – ছবিঃ সংগৃহীত

বুড়িগঙ্গা ফিরবে ১৯২৬ সালে

সাড়ে ৭ কিলোমিটার অংশ হাতিরঝিলের চেয়ে আধুনিকভাবে সজ্জিত হবে। নদীর দু’পাশে থাকবে বিনোদন কেন্দ্র উন্মুক্ত স্থান সবুজবেষ্টনী

ভরাট হওয়া বুড়িগঙ্গা নদীর প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার অংশকে পুরোনো চেহারায় ফিরিয়ে আনতে চায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ১৯২৬ থেকে ১৯৪০ সালের সিএস (ক্যাটাস্ট্রাল সার্ভে) ম্যাপ অনুসরণ করে যেখানে নদী ছিল, সেই অংশকে আবারও সেই আঙ্গিকে প্রবহমান নদীর রূপে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

নদীকে পুরোনো চেহারায় ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি নদীর দু’পাশে প্রশস্ত সড়ক নির্মাণ এবং হাতিরঝিলের চেয়ে আধুনিকভাবে সজ্জিত করে নদীর দু’পাড়ের প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকাকে দৃষ্টিনন্দন করে তৈরি করা হবে।

বুড়িগঙ্গা নদীর এই আদি চ্যানেলকে ফিরিয়ে এনে প্রকল্পটা বাস্তবায়িত হলে ইসলামবাগ থেকে শুরু করে রায়েরবাজার এলাকার চেহারা আমূল বদলে যাবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভিপ্রায় অনুযায়ী এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান ডিএসসিসির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।

মেয়র বলেন, ‘আমরা আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেল পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নিয়েছি। সেজন্য মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিকে (এমআইএসটি) পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এমআইএসটি ইতোমধ্যে একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আমরা সেই প্রতিবেদনের ওপর আরও কাজ করছি।’

অবশ্য প্রায় ১০০ বছর আগের চেহারায় বুড়িগঙ্গাকে ফিরিয়ে আনা একেবারে সহজ নয় বলেও মনে করছেন অনেকে। তারা বলছেন, প্রভাবশালী মহল যে যার মতো বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল দখল করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।

প্রশাসনের সহযোগিতায় জাল-জালিয়াতি করে অনেকে নদীর জায়গার দলিলও নিজের নামে করে ফেলেছেন। এসব দখলকে পোক্ত করতে কোথাও কোথাও মসজিদও গড়ে তোলা হয়েছে।

অনেক দখলদার আদি চ্যানেলের জায়গায় স্থায়ী অবকাঠামো গড়ে তুলেছেন। এখন সেসব জায়গায় নামিদামি প্রতিষ্ঠান, শিল্পকলকারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি রয়েছে। এ জন্য প্রকল্পটির বাস্তবায়ন নিয়েও তারা সংশয়ে আছেন।

প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষও মনে করছে, কাজটা হবে খুবই চ্যালেঞ্জিং। এ প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খায়রুল বাকের বলেন, এ প্রকল্পটি হাতিরঝিলের চেয়ে তিনগুণ বেশি এলাকা নিয়ে হবে।

কাজেই কাজটা বাস্তবায়ন করা বেশ কঠিন। এই জায়গাটির প্রায় পুরোটাই দখল হয়ে গেছে। কিন্তু হাতিরঝিলটা দখলমুক্ত ছিল। এ জন্য এখানে চ্যালেঞ্জও বেশি। মেয়র মহোদয় নির্দেশ দিয়েছেন সিএস ম্যাপ অনুসরণ করে নদীর সীমানা চিহ্নিত করতে।

এতে করে কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। বর্তমানে সেই সীমানা চিহ্নিত করার কাজই চলছে। ডিএসসিসি চায় কাজটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে হাতিরঝিলের চেয়ে আরও পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়ন করতে।

জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কামরাঙ্গীরচর এলাকায় নির্বাচনী জনসভায় বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপর তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার তাপস দায়িত্ব নেওয়ার পর এমআইএসটিকে কনসালট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দেন।

এমআইএসটি ড্রোন ব্যবহার করে ভরাট হওয়া বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল শনাক্তের চেষ্টা করে। তারা দেখতে পায়, ওই সাড়ে সাত কিলোমিটার এলাকার মাত্র এক কিলোমিটার এলাকার ফাঁকে ফাঁকে সরু খালের মতো বুড়িগঙ্গার অস্তিত্ব বিদ্যমান। বাকি অংশ সম্পূর্ণ ভরাট হয়ে গেছে। সেখানে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের ঘরবাড়ি, কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট প্রভৃতি।

ফলে আদি চ্যানেল শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। আবার একটি জায়গায় প্রশস্ত জলাশয় থাকলেও তার মাঝখানে একটি ছোট কালভার্ট তৈরি করা হয়েছে।

কী উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল, তাও স্পষ্ট তারা বুঝতে পারেনি। এসব নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে তারা ইসলামবাগ থেকে রায়েরবাজার পর্যন্ত একটি সোজা নদী তৈরির প্রস্তাব দেন।

এ জন্য প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়। পাশাপাশি যেখানে নদীর জমি আছে, সেটাও ব্যবহারের কথা বলা হয়। মেয়র তাপস প্রতিবেদনটি পর্যবেক্ষণ করে এমআইএসটিকে জানিয়ে দেন, এতে করে নদীর মূল গতিপথ উদ্ধার করা যাবে না।

অনেকে মামলা-মোকদ্দমাও ফাঁদতে পারে, তাহলে কাজ আর এগোবে না। বরং নদীর মূল গতিপথ চিহ্নিত করে পুরোনো আঙ্গিকেই নদীকে ফিরিয়ে আনতে হবে। কোথাও নদীর প্রশস্ততা বাড়াতে হলে প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করা যাবে। এতে করে অনেক কম পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। ফলে প্রকল্প ব্যয় অনেক কমবে।

তিনি নির্দেশ দেন, সিএস ম্যাপ অনুসরণ করেই আদি বুড়িগঙ্গাকে উদ্ধার করতে হবে। এভাবে ইসলামবাগ থেকে রায়েরবাজার বেড়িবাঁধের পশ্চিম পাশের কালুনগর খাল দিয়ে বুড়িগঙ্গাকে যুক্ত করা হবে। এটা ফিরিয়ে আনা গেলে নৌ চলাচলও করতে পারবে। বর্তমানে ডিএসসিসি ও এমআইএসটি মিলে জোরেশোরে এ কাজটিই করছে।

এমআইএসটির খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, নদীর দু’পাশে দৃষ্টিনন্দন সবুজবেষ্টনী, উন্মুক্ত স্থান, বিনোদন স্পট তৈরি করা হবে। একই সঙ্গে চ্যানেলের দু’পাশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পর্যাপ্ত সংখ্যক সেতু বা ওভারপাস তৈরি করা হবে। পুরো চ্যানেলটি উদ্ধার হলে রাজধানীর একটি বড় অংশের জলাবদ্ধতারও নিরসন হবে।

অবহেলিত কামরাঙ্গীরচর, ইসলামবাগ, লালবাগ, হাজারীবাগসহ ওই এলাকার নদীর দু’পাশের মানুষের জীবনযাত্রার চেহারাও বদলে যাবে। এলাকার পরিবেশের আমূল পরিবর্তন ঘটবে।

পুরো এলাকা আধুনিক বাসযোগ্য হিসেবে পরিণত হবে। এ জন্য প্রাথমিক ব্যয় চিন্তা করা হচ্ছে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল ল’ ইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘কাজটা কঠিন। কিন্তু অসম্ভব নয়।  সরকার চাইলেই সম্ভব।’

তিনি বলেন, ‘এর আগে আদি বুড়িগঙ্গার কিছু অংশ উদ্ধার করে হাতিরঝিলের মতো একটা প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়েছিল। সেটা আমরা বিরোধিতা করেছিলাম। কিন্তু সিএস ম্যাপ অনুসরণ করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা গেলে সাধুবাদ জানাব।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খানের মতে এই উদ্যোগটা আরও আগেই নেওয়ার প্রয়োজন ছিল।

তিনি বলেন, ‘এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ঢাকার বড় অংশের জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান ঘটবে। এভাবে রাজধানীর অন্যান্য খাল বা পানি নিস্কাশন চ্যানেলগুলো উদ্ধার করা প্রয়োজন।

তাহলে রাজধানীর জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান ঘটবে। ধাপে ধাপে রাজধানীকে পরিচ্ছন্ন ও উন্নত করে গড়তে হবে।’

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রকল্পের (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘সংশোধিত ড্যাপে বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল পুনরুদ্ধারে সুপারিশ করা হয়েছে। ডিএসসিসির বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল পুনরুদ্ধারের এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে রাজউক সব ধরনের সহযোগিতা দেবে।’

বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলের দু’পাশের এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে ইসলামবাগ, কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ শ্মশানঘাট, শহীদ নগর, ঝাউচর, হাজারীবাগ সেকশন, কালুনগর, বউবাজার, সিকদার রিয়েল এস্টেট ও সিকদার মেডিকেল কলেজ।

এ এলাকাগুলো খুবই অবহেলিত। আর আদি চ্যানেলের নোংরা পরিবেশ, আবর্জনায় পূর্ণ থাকায় দু’পাড়ের বসবাসের পরিবেশ দূষিত হয়ে পড়েছে। কামরাঙ্গীরচরের বাসিন্দারা জানান, ১৯৮৭-৮৮ সালে বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল হয়ে তারা নৌকায় করে টঙ্গীর ইজতেমায় যেতেন।

১৯৯০ সালে বেড়িবাঁধ হওয়ার পর দ্রুতগতিতে বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল দখল শুরু হয়। ডিএসসিসির ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের (কামরাঙ্গীরচর এলাকা) কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন বলেন, বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল পুনরুদ্ধারে আমরা বহু আগে থেকেই সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি। ইতোমধ্যে মেয়র এলাকাটি পরিদর্শন করে গেছেন। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থানীয় পর্যায় থেকে আমরা সব ধরনের সহযোগিতা দেব।

তথ্যঃ সমকাল, ১৭ নভেম্বর