সুপ্রশিক্ষিত ও দক্ষ নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট (NYPD)র দক্ষতায় অতিদ্রুত ধরা পড়েছে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত তরুণ প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ফাহিম সালেহের খুনী তারই ৪ বছরের ব্যক্তিগত সহকারী ২১ বছর বয়েসী টাইরেস ডেভন হাসপিল।
১৭ বছর বয়স হতেই একসাথে কাজ করা টাইরেসকে অনেক বিশ্বাস করে তার অন্যতম একটি উদ্যোগ এডভেঞ্চার ক্যাপিটালের দায়িত্ব দিয়েছিলো ফাহিম।
এডভেঞ্চার ক্যাপিটাল থেকেই মূলতঃ ফাহিমের সকল প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রিত হতো।
ফাহিমের সরলতার সু্যোগ নিয়ে ২১ বছরের এই ধূর্ত কৃষ্ণাঙ্গ তরুণের মাথায় দুষ্টবুদ্ধি চাপে। ৯০,০০০ ডলারের চেয়ে বেশী পরিমাণ অর্থ সে আত্মসাৎ করে।
এই ঘটনা জানতে পারার পর সঙ্গত কারেনেই ফাহিম টাইরেসকে বরখাস্ত করে। তবে,পুরনো সহকর্মী হিসেবে তার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে কোনো অভিযোগ জানায় না।
বরং তাকে সংশোধিত হবার সুযোগ দেয়,আত্মসাৎ করা টাকা কিস্তিতে শোধ করার সুযোগ দেয় তাকে।
এটাই ছিলো ফাহিমের সবচেয়ে বড় ভুল,যার কারণে তাকে অকালে প্রাণ হারাতে হয়েছে টাইরেস ডেভন হাসপিল নামের তারই নুন খাওয়া এই অকৃতজ্ঞ ও বেঈমান কৃষ্ণাঙ্গ তরুণের হাতে।
পুলিশে রিপোর্ট করা থাকলে টাইরেস ওর ক্ষতি করার সাহস করত না।
করোনা মহামারী আর লক ডাউনের এই বাজারে এক লাখ ডলার অনেক বড় অংক।
টাইরেস ডেভন হাসপিল ভাবে,ফাহিমকে মেরে ফেলতে পারলে তাকে আর এই টাকা দিতে হবে না, ঘটনাটাও ধামাচাপা পড়ে যাবে।
যেই ভাবা সেই কাজ। পারসোনাল সেক্রেটারী হবার সুবাদে ফাহিমের গতিবিধি তার জানা ছিলো।
ফাহিম লকডাউনের শুরু থেকে নিউইয়র্কের অন্য প্রান্তে মা-বাবার সাথে কোয়ারান্টাইনে ছিলো।
করোনার প্রকোপ কিছুটা কমায় নিউইয়র্কে লকডাউন শিথিল হলে,ফাহিম তার লাক্সারি এপারট্মেন্টে ফিরে আসে।
নিউইয়র্ক সিটির সবচেয়ে নিরাপদ ও বিত্তশালীদের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত ম্যানহাটানের লোয়ার ইস্ট সাইডে এই অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স।
ফাহিমের এই লাক্সারী ফ্ল্যাটে লিফট দিয়ে ঊঠতে হলে হাইলি সিকিউর চাবি দিয়ে উঠতে হতো।
সেই চাবি লিফটের বিশেষ জায়গায় রাখলে চাবিটির মাধ্যমে সয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় লিফটটি চাবির মালিকের ফ্লোর চিনতে পারতো ও তাকে সেখানে পৌঁছাত।
ঘটনার দিন,১৬ই জুলাই ২০২০ য়ে ফাহিম যখন লিফটে ওঠে,খুনি টাইরেস তার মুখ মাস্ক পরে,মাথা হুডিতে ঢেকে,ফাহিমের সাথে একই লিফটে ওঠে।
সে অন্য একটা ফ্লোরের চাবি লিফটের বিশেষ জায়গায় পাঞ্ছ করার ভান করে। অতঃপর সে ফাহিমের সাথে সপ্তম ফ্লোরে যায়।
সি সি টিভির ফুটেজ দেখে পুলিশ ধারণা করছে ফাহিমের পেছনে পেছনে সপ্তম ফ্লোরে নামার পর দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়।
টাইরেস টেসার গান পাঞ্চ করে উচ্চমাত্রার বৈদ্যুতিক শক দিলে ফাহিম সালেহ অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। তারপর খুনি টাইরেস অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় সমাধা করে জঘন্য হত্যাকাণ্ড।
অজ্ঞান ফাহিম সালেহকে এপার্টমেন্টের ভিতরে নিয়ে গলা আর ঘাড়ে কয়েকবার ছুরি মেরে হত্যা করা হয়।
সেদিন টাইরেস চলে গিয়ে পরদিন লাশ গুম করে দেয়ার জন্য মঙ্গলবার দুপুরে আবার ফিরে আসে।
ইলেক্ট্রিক করাত দিয়ে কেটে ব্যাগে ভরার সময় ফাহিমের খালোতো বোন এসে কলিং বেলের বাটন চাপলে টাইরেস ওভাবেই সব ফেলে পেছনের ফায়ার এক্সিট সিঁড়ি দিয়ে পালিয়ে যায়।
নিউইয়র্কের পুলিশ খুনির সাথে ফাহিমের মোবাইলের এস,এম, এস, পড়েই প্রথমে জানতে পারে টাকা আত্মসাতের বিষয়টি।
তারপর, টাইরেসের কেনাকাটার রেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখতে পায়, সে একটা চেইন স কিনেছে,যা ফাহিমের মৃতদেহকে গায়েব করার উদ্দেশে টুকরো টুকরো করতে ব্যবহার করা হয়েছিলো।
তখন পুলিশের সন্দেহের অবকাশ থাকে না কে প্রকৃত খুনি।
অতঃপর খুনি টাইরেসের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে অবশেষে তাকে পালিয়ে থাকার জায়গা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
টাইরেস যে খুনী তার আরেকটা প্রমাণ হিসেবে ওর কাছ থেকে ফাহিমের ক্রেডিট কার্ডও উদ্ধার করেছে পুলিশ।
এই কার্ড ব্যবহার করে টাইরেস ইতিমধ্যে প্রচুর কেনাকাটাও করেছে।
যে মানুষটা ওকে চুরির দায়ে জেলে না দিয়ে আরেকটা সুযোগ দিয়েছিল, তাকেই হত্যা করল টাইরেস। এজন্যই বলা হয়, মানুষের চাইতে নিষ্ঠুর আর অকৃতজ্ঞ প্রাণী আর নেই।
লেখাঃ ইফতেখার মাহমুদ।
ফাহিমের পরিচয় ও সাফল্যের ইতিহাসঃ
ফাহিমের মৃত্যুর খবরটা আসার আগে আমাদের দেশের খুব বেশি মানুষ ফাহিম সালেহ’র নাম জানতেন না হয়তো, কারণ আড়ালে থেকেই কাজ করতে পছন্দ করতেন তিনি।
পাঠাওয়ের সহ-প্রতিষ্ঠাতা তিনি, পরে নিজের অংশের শেয়ার বিক্রি করে পৃষ্ঠপোষক পদে ছিলেন। জোবাইক, যাত্রী-সহ আরও কিছু দারুণ প্রোজেক্টে তিনি ছিলেন বিনিয়োগকারী।
এর বাইরে নাইজেরিয়াতে গোকাডা (Gokada) এবং কলাম্বিয়াতে পিকঅ্যাপ (Picap) নামে আরও দুটি রাইড শেয়ারিং কোম্পানি শুরু করেছিলেন, ভালো মুনাফাও অর্জন করেছিলেন সেখান থেকে।
ফাহিমের বাবা এবং মা দুজনেই ছিলেন বাংলাদেশী। বাবা সালেহ উদ্দিনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে, আর মা নোয়াখালীর মানুষ।
ফাহিমের জন্ম হয়েছিল সৌদি আরবে, বাবা সালেহ উদ্দিন তখন সেখানে কর্মরত ছিলেন।
ফাহিমের জন্মের পরে তাদের পরিবার আমেরিকা চলে গিয়েছিল, ফাহিমের শৈশব-কৈশোরের সবটাই তাই আমেরিকাতেই কেটেছে।
তিনি পড়াশোনা করেছেন ইনফরমেশন সিস্টেম নিয়ে, আমেরিকার বেন্টলি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
দারুণ মেধাবী ছিলেন ফাহিম, মাথায় সারাক্ষণ নতুন নতুন আইডিয়া গিজগিজ করত।
স্কুল জীবন থেকেই প্রযুক্তির প্রতি তার সীমাহীন আগ্রহ। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি টিনেজারদের জন্য সোশ্যাল নেটওয়ার্ক বানিয়েছিলেন, নাম টিন-হ্যাংআউট ডটকম।
শুরুর দুই বছরের মাথায় বছরে বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় দেড় কোটি টাকা আয় হয় এই সাইট থেকে।
আঠারো বছর বয়সেই কোটিপতি হয়ে গিয়েছিলেন ফাহিম! এরও আগে উইজ টিন নামের একটা ওয়েবসাইট তৈরি করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন স্কুলে, বেশ ভালো অংকের টাকা আয় হয়েছিল তখনও।
ছোটবেলায় প্র্যাংক কল তো আমরা কমবেশি সবাই করেছি, আননোন নাম্বার থেকে কাউকে ফোন দিয়ে মজা করেছি।
সেই আইডিয়াটা কাজে লাগিয়ে প্র্যাংক কলের একটা ওয়েবসাইট বানালেন।
সেখানে কিছু রেকর্ডেড অডিও আপলোড করা ছিল, ইউজাররা সেসবের মধ্যে থেকে যেকোন একটা পছন্দ করে নিয়ে কারো সঙ্গে মজা করতে পারতেন।
শুরুতে ব্যাপারটা ফ্রি ছিল, কিন্ত ইউজার বেড়ে যাচ্ছে দেখে ফাহিম এটাকে পেইড সার্ভিস বানিয়ে ফেললেন।
তিনি খানিকটা শঙ্কায় ছিলেন, টাকা দিয়ে মানুষ এরকম সার্ভিস ব্যবহার করবে কিনা। তাছাড়া প্র্যাংক কলের ইউজারদের বেশিরভাগ ছিল কিশোর, তাদের হাতে খুব বেশি টাকা থাকেও না।
কিন্ত ফাহিমকে অবাক করে দিয়ে প্রতিদিন গড়ে বিশ ডলার করে অ্যাকাউন্টে ঢুকতে শুরু করলো। উৎসাহী হয়ে ফাহিম সেখানে অডিও’র পরিমাণ বাড়ালেন, ইউজারও বেড়ে গেল।
বিশ থেকে শুরু হয়ে প্রতিদিন একশো-পাঁচশো এমনকি হাজার ডলারও আসা শুরু হলো।
কয়েক বছরের মাথায় ফাহিম প্রায় এক মিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয় করলেন এই প্র্যাংক কল সার্ভিস থেকে।
তরুণ বয়সে তিনি যেসব প্রোজেক্টের পেছনে বিনিয়োগ করেছেন, সেগুলোর টাকা এসেছে এই প্র্যাংক কল সার্ভিস থেকেই।
পাঠাওয়ের তিনজন প্রতিষ্ঠাতার একজন ফাহিম সালেহ, তবে যুক্তরাষ্ট্রে থাকায় খুব বেশি মানুষের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন না। ২০১৪ সালে দেশে এসেছিলেন ফাহিম।
ওই সময়ে যুক্ত হন রাইড শেয়ারিং কোম্পানি পাঠাওয়ের সঙ্গে।
২০১৫ সালে যখন বাইক রাইড শেয়ারিং নিয়ে কারো তেমন কোন ধারণাই ছিল না, তখন মাত্র ১০০টি বাইক নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল পাঠাও।
সেই পাঠাও এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাইড শেয়ারিং কোম্পানী, প্রায় ১ লক্ষ রাইডার কাজ করেন পাঠাওয়ে, প্রায় চার হাজার কোটি টাকা এই কোম্পানি মূল্যমান, কয়েক’শ কোটি ইনভেস্টমেন্ট।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, পাঠাওয়ের আগমনের কারণে অজস্র মানুষ অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হয়েছে।
বেকার যুবকরা রাউড শেয়ারিংয়ে নাম লিখিয়েছে, মোটর সাইকেলের বিক্রি বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
লেখক: সাইদুজ্জামান আহাদ। পূর্ণাঙ্গ লেখাপূর্ণাঙ্গ লেখা
এ সংক্রান্ত সবগুলো লেখা পড়ুন এই লিংকে