ভূমিকা না দিয়েই শুরু করি। অনেকেরই প্রশ্ন থাকে- আমাদের বিদ্যুৎ চাহিদা সর্বোচ্চ ১০-১৩ হাজার মেগাওয়াট, শীতের দিনে চাহিদা আরো অনেক কম থাকে। কিন্তু বর্তমানে ইন্সটল ক্যাপাসিটি তাহলে কেন ২০,৮১৩ মেগাওয়াট?

কি কারণে চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত ৭-১০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করার ব্যবস্থা রাখা হল? এই অতিরিক্ত বিদ্যুৎ দিয়ে আসলে আমরা করবো টা কি? এই সব প্রশ্নের উত্তর নিচে দেখানো হলোঃ

১. বর্তমানে আমাদের সিস্টেম লস ১০.৬৬ শতাংশ। সিস্টেম লস হলো বিদ্যুৎ কেন্দ্র হতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ তারের মধ্য দিয়ে গ্রাহকের কাছে পাঠানোর সময় তারের মধ্যে বিদ্যুতের যে লসটা হয় অথবা কেউ বিদ্যুৎ চুরি করলে যে লস হয় সেটায় হল সিস্টেম লস। যেহেতু সিস্টেম লস ১০.৬৬ শতাংশ তাই আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২০,৮১৩ মেগাওয়াট থাকলেও সিস্টেম লসের কারণে গ্রাহকের কাছে ২,২১৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পৌঁছাতে পারবে না। গ্রাহকের কাছে সর্বোচ্চ ১৮,৫৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাঠানো যাবে।

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে ৪ কোটির বেশি গ্রাহকের সর্বোচ্চ চাহিদা ১০-১৩ হাজার মেগাওয়াট। ২,২১৮ মেগাওয়াট সিস্টেম লস হওয়ায় গ্রাহকের কাছে পৌছানো যাবে সর্বোচ্চ ১৮,৫৯৪ মেগাওয়াট। তাহলে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ এখন আর ৭-১০ হাজার মেগাওয়াট না হয়ে ৫-৭ হাজার মেগাওয়াট হচ্ছে। দিন দিন শিল্পকারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং গ্রাহকদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে এই অতিরিক্ত পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।

২. হঠাৎ করে কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিগ্রস্ত কেন্দ্রটি পুরোপুরিভাবে দীর্ঘ সময় বন্ধ রাখতে হয়। কারণ সেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সরবরাহ করতে পারে না। এমতাবস্থায় যাতে দেশে কখনো বিদ্যুৎ ঘাটতি না হয়, সেই জন্য অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা রাখা হয়। যেন দেশের যে কোনো পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল রাখা যায়।

৩. বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলেও মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ রাখতে হয় কারণ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোনো যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেলে সেগুলো যথাযথভাবে ঠিক করতে হয়। যতক্ষণ না পর্যন্ত এই কেন্দ্রের সকল ধরনের যন্ত্রপাতি ঠিক করা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ রাখা হয়। এই পরিস্থিতিতেও যেন দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা যায় সেই জন্য অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

৪. বর্তমানে আমাদের সর্বোচ্চ ১,০৩৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ (সিস্টেম লস বাদে) চুক্তি অনুযায়ী আমদানি করতে হয় এবং দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের সংখ্যা ১৩৭টি। এই সবগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্র যদি একসাথে চালু করা হয় তাহলে সেখান থেকে সর্বোচ্চ ১৭,৫৩৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গ্রাহকের কাছে সরবরাহ করা যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো দেশের সবগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্র কি একসাথে চালু করা সম্ভব?

সবগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্র কখনো একসাথে চালু করা সম্ভব না কারণ মনে করুন একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৪টি জেনারেটর আছে, যদি সবগুলো জেনারেটর একসাথে চালু থাকে তাহলে জেনারেটরগুলোতে প্রচুর পরিমানে তাপ উৎপন্ন হয়। তাই একটা সময় ঠান্ডা করার জন্য সবগুলো জেনারেটর বন্ধ রাখতে হয়। আর একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সবগুলো জেনারেটর বন্ধ মানে পুরো বিদ্যুৎ কেন্দ্রটাই বন্ধ। যার কারণে সবগুলো জেনারেটর একসাথে না চালিয়ে প্রথমে হয়তো ২টি চালানো হয়, সেগুলো গরম হলে ঠান্ডা করার জন্য বন্ধ রাখতে হয়। অপরদিকে অবশিষ্ট যে দুটি জেনারেটর প্রথমে বন্ধ রাখা হয়েছিলো, বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল রাখতে সেগুলো আবার চালু করা হয়।

যদিও বলা হয় সবগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে গ্রাহকের কাছে সর্বোচ্চ ১৭,৫৩৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব, কিন্তু সেগুলো থেকে কখনো একসাথে ১৭ হাজার মেগাওয়াট সরবরাহ করা সম্ভব হবে না কারণ সব কেন্দ্র একসাথে চালানো সম্ভব না, তাই সেখান থেকে হয়তোবা একসাথে ১১-১৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে। অপরদিকে ১,০৩৬ মেগাওয়াট আমদানি হচ্ছে। তাহলে একসাথে খুব হলে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার মেগাওয়াট সরবরাহ সম্ভব। যা প্রায় আমাদের চাহিদার সমান বললেই চলে।

উপরোক্ত কারণে আমাদের চাহিদার চেয়েও অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা রাখা হয়। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি বিদ্যুতের উপর নির্ভর করে। দেশের শিল্প কলকারখানা চালাতে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ লাগে। মানুষ হয়তো কয়েকদিন না খেয়ে থাকতে পারে, কিন্তু বিদ্যুৎ ছাড়া আমাদের যেন এক মুহূর্তও চলে না। আমরা যে ইন্টারনেট ব্যবহার করি সেটার জন্যও কিন্তু বিদ্যুৎ দরকার। একটানা কয়েকদিন বিদ্যুৎ না থাকলে মানুষের জীবনযাপনের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিও একদম পঙ্গু হয়ে যাবে। তাই আমাদের অনেক বিদ্যুৎ দরকার, তাছাড়া দিন দিন শিল্পকারখানার সংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাই ভবিষ্যৎ সুরক্ষার কথা চিন্তা করে আমাদের চাহিদার থেকেও অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদানের ক্ষমতা রাখা হয়েছে।

রবিউস-সানি