“গবেষক” শব্দটির শুনলেই সাধারণত মস্তিষ্কে ভেসে ওঠে একজন এলোমেলো চুলের, ভারী ফ্রেমের চশমা পড়া, কিছুটা ক্র্যাক মাথার একজনের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু পৃথিবী বদলে যাচ্ছে…পাল্টে যাচ্ছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং এর জ্বলন্ত একটি উদাহরণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মেহেদী ফারুক।

পিঠজোড়া লম্বা চুল আর লম্বা গড়নের এই সদা হাস্যোজ্জ্বল ছেলেটিকে কেউ কার্জনে দেখলে তার জন্য প্রথম দেখাতে বিশ্বাস করা একটু কঠিনই যে ছেলেটি একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ। শুধু তাই না বাংলাদেশ থেকে এবছর সার্নে (CERN) ইন্টার্ন রিসার্চ করার জন্য যাওয়া একমাত্র ব্যক্তিটি তিনিই।

অন্যান্য পদার্থবিদদের থেকে ব্যতিক্রম এখানেই যে তিনি হতে চেয়েছিলেন একজন ফুটবলার শুধু তাই নয় পড়ালেখার ব্যাপারে নাকি তার তেমন কোন চিন্তাভাবনাই ছিল না বলে তিনি দাবি করেন। কিন্তু কিভাবে যেন কি হয়ে গেল আর তিনি ফুটবলের মাঠ থেকে দৌড়ে চলে এলেন সোজা সার্নের রিসার্চ ফিল্ডে আর করতে শুরু করলেন গবেষণা।

আসলে মেধাবীদের মাথায় কখন কি হয় তা বলা মুশকিল।

মেহেদীর জন্মের পর থেকে এ পর্যন্ত কেটেছে ঢাকার আরামবাগে। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল থেকে এস.এস.সি তারপর নটরডেম কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পাশের পর ২০০৮ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিজ্ঞান,ইলেকট্রনিক্‌স ও কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং (APECE) বিভাগে।

অনার্স শেষে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স করার সময় সুযোগ পান সার্নে রিসার্চ করার সুযোগ। আগে থেকে পদার্থবিজ্ঞানের উপর তেমন কোন আগ্রহ না থাকলেও APECE তে ১ম বর্ষে ভর্তি হবার পর আগ্রহ জন্মে পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি। যদিও ভর্তি হন APECE তে কিন্তু এরপর ইচ্ছা জাগে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান (Theoretical Physics) পড়ার।

কিন্তু সাবজেক্ট বদল করার বিভিন্ন ব্যাপার আর যেহেতু হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নেয়া তাই Physics ডিপার্টমেন্টে গিয়ে ঠিকভাবে মানিয়ে নিতে পারবেন কিনা সে আশঙ্কায় থেকে যান ফলিত পদার্থবিজ্ঞানেই (APECE) ।

ফলিত পদার্থবিজ্ঞানে পড়াশুনার পাশাপাশি ফিজিক্সের প্রতি আগ্রহ থাকায় ২য় বর্ষ থেকে নিজে নিজে শুরু করেন Theoretical Physics এর উপর পড়াশুনা করা। এক্ষেত্রে তিনি কাজ করা শুরু করেন Theoretical Physical বিভাগের অধ্যাপক ড. গোলাম মোহাম্মদ ভূঁঞার তত্ত্বাবধায়নে। এরপর ঝুঁকে পড়েন গবেষণার দিকে।

ফলাফল…৩য় এবং ৪র্থ বর্ষে থাকাকালে পরপর ২বছরে মেহেদীর ২টি গবেষণাপত্র পাবলিশ হয় ২টি জার্নালে। লিকুইড মেটালের উপর পাবলিশ করা এদুটি গবেষণা প্রকাশিত হয় বিখ্যাত দুটি জার্নালে।

প্রথম গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয় Elsevier Physica B তে এবং দ্বিতীয়টি প্রকাশিত হয়American Institute of Physics(AIP) তে। এবং দুটি রিসার্চওয়ার্কের মধ্যে প্রথমটি Elsevier ছাড়াও গ্রহণ করে NASA (National Aeronautics and Space Administration)।তার গবেষণাদুটি ছিল মূলত ” লিকুইড মেটাল অ্যালয় মিক্সিঙের ক্ষেত্রে কিছু কিছু অ্যালয় মিক্স না হয়ে বরং লেয়ার তৈরি করে, ঠিক কোন পর্যায়ে এসে তারা মিশে না এবং কোন কোন অ্যালয় গুলো মিশে না তা Theoretically Develop করা।”

মেহেদীর সার্নে যাবার সুযোগ আসে মূলত গবেষণাপত্র প্রকাশের পরই । তিনি ২০১৩ সালের অক্টোবরে আবেদন করেন ২০১৪’র সার্ন সামার ক্যাম্পের রিসার্চ ওয়ার্কশপে ইন্টার্ন হিসেবে রিসার্চ করার জন্য। এরপর তিনি পেয়ে যান ফুল ফ্রি স্কলারশিপে সার্নে ইন্টার্ন রিসার্চ করার সুযোগ।

মেহেদী বলেন, সার্নে আবেদনের তেমন কোন যোগ্যতা ক্যাটাগরি উল্লেখ করা নেই শুধুমাত্র কমপক্ষে ৩য় বর্ষের ছাত্র হলেই আবেদন করা যাবে তবে এক্ষেত্রে চান্স পাবার জন্য রিসার্চওয়ার্কের গুরুত্ব উল্লেখযোগ্য। প্রতি সামারেই আয়োজন করা হয় এই সামার ক্যাম্পের। মেহেদী বলেন শুধু পদার্থবিজ্ঞানই না সার্নে অনেক প্রকারের যেমন ওয়েব ডেভেলাপিং, ডাটা এনালাইসিস,সিভিল,মেকানিক্যাল ইত্যাদি বিষয়ের উপরও কাজ হয়।

কিন্তু সার্নে ফলিত পদার্থবিজ্ঞানের ডিমান্ড সবচেয়ে বেশি থাকায় তিনি আবেদন করেন।সীমিত পরিমাণ ছাত্রদের জন্য রিসার্চের সুবিধা থাকা সত্ত্বেও নিজ যোগ্যতায় সুযোগ পেয়ে যান মেহেদী। ইন্টার্ন রিসার্চার নিয়োগের ক্ষেত্রে সব আবেদনকারীদের মধ্যে থেকে মাত্র ৪% ছাত্র সুযোগ পেয়ে থাকে সার্নে।

এবছর সকল আবেদনের থেকে প্রায় ২০০ জন আবেদনকারীকে শর্টলিস্টেড করা হয়।সার্নের রিসার্চারগন এই ২০০ জন থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্র অনুযায়ী রিসার্চ করার জন্য প্রত্যেকে ৫ জনের একটি তালিকা সার্নে জমা দেন এবং সেখান থেকে সার্ন প্রত্যেককে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে রিসার্চ করার সুযোগ করে দেয়।

এবং এবারের সামার ক্যাম্পে ২০০ জনের প্রায় ২০ জনের মত আবেদনকারী সুযোগ পেয়েছেন হিগস-বোসনের উপর গবেষণার জন্য তাদের মধ্যে আমাদের ঢাবির মেহেদী একজন। সার্নে হিগস-বোসনের উপর রিসার্চে মেহেদী কাজ করবেন সার্নের পি.এইচ.ডি হোল্ডার ইতালিয়ান রিসার্চার আন্দ্রেয়া মাসারনির সাথে যিনি বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ইস্টার্নের পোস্ট ডক্টরেট।

নিজের রিসার্চওয়ার্ক সম্পর্কে সংক্ষেপে মেহেদি বলেন যে ”বিজ্ঞানী পিটার হিগসের প্রেডিকশন অনুযায়ী অনেক আগেই হিগস-বোসন পাওয়া যায় এবং হিগসের দেয়া মেথড অনুযায়ী পাকিস্তানের বিজ্ঞানী আব্দুস সালাম ও স্টিফেন ওয়াইনবার্গ একটি মডেল ডেভেলাপ করেন যা সালাম-ওয়াইনবার্গ স্ট্যান্ডার্ড মডেল নামে পরিচিত।

এবং এই মডেলটির মাধ্যমে ৩টি ফোর্সকে (Strong, Weak and Electromagnetic Force) এক করা যায় এবং এর মাধ্যমে ওই ফোর্সের জন্য প্রেডিক্ট করা পার্টিকেল ( w+, w- and z boson) সহজেই পাওয়া যায় ১৯৭০এর দশকে। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছিল না হিগসের মেথড অনুযায়ী প্রেডিক্ট করা হিগস-বোসন পার্টিকেল।

যা প্রায় ৪০ বছর পর পাওয়া যায় সার্নে । এবং এতে আছে সালাম-ওয়াইনবার্গের প্রোপার্টিজ গুলোও।এখন আমার কাজ হচ্ছে এই হিগস-বোসনে এসব প্রোপার্টিজ ছাড়া আরও কোন আলাদা প্রোপার্টিজ আছে নাকি তা খোঁজা এবং থাকলে তা অনুযায়ী থিওরিটাকে ডেভেলাপ করা ”

বাংলাদেশে রিসার্চের সুযোগ সুবিধা নিয়ে কিছুটা দুঃখ প্রকাশ করেন মেহেদী।তিনি বলেন একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে রিসার্চের জন্য যে পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা দরকার তা আমাদের নেই।

এছাড়া রিসার্চের ক্ষেত্রে বর্তমান কোর্স কারিকুলাম ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের অভাবও একটি বড় কারণ। আর হায়ার স্টাডিজের ক্ষেত্রে একটি দেশে যদি রিসার্চের সুবিধা কম থাকে তাহলে স্কুল-কলেজের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের তেমন কোন পার্থক্য থাকে না বলে জানা মেহেদী।

সার্নে রিসার্চের সুযোগ-সুবিধার সাথে আমাদের দেশের রিসার্চের মধ্যে যে ব্যপক পার্থক্য তা সম্পর্কে মেহেদী বলেন “পুরো পৃথিবীতে খাদ্যের পিছনে যে পরিমাণ টাকা খরচ হয় তার প্রায় ৩ গুন টাকা শুধুমাত্র সার্নেই বিনিয়োগ করা হয় রিসার্চ করার জন্য।

তাহলে পড়াশুনায় অবধারিতভাবে তারা উন্নতি করবেই। কারণ পড়াশুনায় উন্নতি করার জন্য আসলে খুব বেশি কিছু করতে হয় না। পড়াশুনার জন্য যথার্থ পরিবেশ তৈরি করতে পারলে আর যথার্থ গাইডেন্স দিতে পারলে দেখা যাবে যে ,যে কোনো মানের ১০ জন ছাত্রের মধ্যে কমপক্ষে ৫ জন ভালো করবেই এবং এটি কিন্তু খুব স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া।

কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত এই ১০ জনকে এসব সুবিধা না দেয়া যায় ততক্ষণ ৫ জনের ভালো করার আশা করা ঠিক যৌক্তিক না। আর বাইরে রিসার্চের ক্ষেত্রে ইউরোপ আর আমেরিকার রিসার্চ করার পদ্ধতি কিন্তু কিছুটা ভিন্ন।

আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেমন ক্যালটেক,এমআইটি সবসময় শীর্ষে থাকে কারণ দেখা যাবে পৃথিবীর শীর্ষ ২০ টি বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্স আর ম্যাথ ডিপার্টমেন্ট অত্যন্ত শক্তিশালী ।

এসব বিশ্ববিদ্যালয় গুলো বেসরকারি হবার কারণে তাদের ফান্ডিং করে বিভিন্ন কোম্পানি। প্রত্যেকটি ডিপার্টমেন্টকে এসব কোম্পানি টাকা দেয় রিসার্চ করবার জন্য । এবং যার ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা ওইসব কোম্পানিভিত্তিক রিসার্চে মনোযোগ দেয়।

তাদের ঝোঁক থাকে মূলত ম্যাটেরিইয়াল সাইন্স,মোবাইল-টেলিকমিউনিকেশন, ন্যানোটেকনোলজির দিকে কারণ এসব ক্ষেত্রে রিসার্চের ফলাফল বেশ দ্রুত পাওয়া যায় এবং এগুলোর আউটকাম বেশি। ফলে দেখা যায় তাদের তাত্ত্বিক বা থিওরেটিকাল পদার্থবিজ্ঞানে তাদের আগ্রহ কিছুটা কম থাকে।

মূলত এসব কারণেই আমেরিকাতে প্রচুর ছাত্র রিসার্চ করতে যায়।

কিন্তু ইউরোপের ব্যাপারটা কিছুটা ভিন্ন। সেখানে রিসার্চের বেশিরভাগই হয় সরকারি অর্থায়নে এবং এর ফলে সেখানে হিগস-বোসন এর মত বিষয় যেগুলো দীর্ঘমেয়াদি রিসার্চ সেগুলোর ক্ষেত্রে সমস্যা হয় না। ফলে দেখা যায় যে, Theoretical Physics এর ক্ষেত্রে ইউরোপে রিসার্চ করার অনেক সুযোগ আছে।

কিন্তু ইউরোপে আমাদের দেশ থেকে আমেরিকার ছাত্র যাওয়ার হার কম। এজন্য দেখা যায় Theoretical Physics এর ক্ষেত্রে আমাদের দেশের রিসার্চার প্রায় নেই বললেই চলে। বাংলাদেশে রিসার্চের ক্ষেত্রে ড. গোলাম মোহাম্মদ ভূঁঞা স্যার ছাড়া Theoretical Physics এ উল্লেখযোগ্য ভাবে আর তেমন কেউ নেই। ”

প্রিয় বিজ্ঞানী পল আদ্রিয়ান মরিস ডিরাকের মত ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে Theoretical Physics এ চলে আসা মেহেদীর পড়াশুনা ছাড়া আরও দুটি জিনিস জড়িয়ে রয়েছে জীবন জুড়ে । তা হচ্ছে ফুটবল এবং মিউজিক। হেভি মেটালপ্রেমী মেহেদীর প্রিয় ব্যান্ড ব্ল্যাক সাবাথ।

এছাড়া বাংলাদেশী লেজেন্ডারি রক ব্যান্ড ওয়ারফেইজেরও একনিষ্ঠ ভক্ত তিনি । আর যার Aim in Life ই ছিল ফুটবলার হওয়া সেই মেহেদীর ফুটবল নিয়ে অর্জনও ঈর্ষান্বিত । ম্যানইউ এবং ব্রাজিলের পাঁড় সমর্থক মেহেদী । প্রিয় খেলোয়াড় ব্রাজিলের রোনালদিনহো।

ম্যান ইউ তে খেলার ইচ্ছা ছিল ছোট বেলা থেকেই কিন্তু তা না পারলেও APECE ফুটবল টীমে নিয়মিত খেলেছেন স্ট্রাইকার হিসেবে। এছাড়া তিনি ছিলেন APECE এর ফুটবল কোচও । ফুটবলপ্রেমের এক মজার কাহিনি রয়েছে তার জীবনে।

কলেজে থাকাকালে তিনি চিঠি পাঠান ম্যান ইউ কোচ স্যার অ্যালেক্স ফারগুসনের কাছে এবং বিস্ময়কর ভাবে তার চিঠির জবাবও দেন ফারগুসন। চিঠির সাথে পাঠান তৎকালীন ম্যান ইউ খেলোয়াড়দের সবার অটোগ্রাফসহ একটি পোস্টকার্ড।

এরপর আর তার সাথে যোগাযোগ করার সময়-সুযোগ হয়ে ওঠেনি, না হলে বলা তো যায় না ম্যানইউতে খেলার আজীবনের স্বপ্ন হয়ত পূরণ হতেও পারত। মেহেদীর এতসব সফলতার কারণ হিসেবে বলা যায়…ভালো করার ইচ্ছা,অধ্যবসায় ও পরিশ্রমকে।

এছাড়াও এসবের পিছে মূলমন্ত্র হয়ে কাজ করেছে স্বপ্ন দেখা…এবং তা পূরণ করার ইচ্ছা ।
কোথা থেকে পেলেন তিনি এই স্বপ্ন দেখে তা পূরণের ইচ্ছা ??

তাকে এই মূলমন্ত্র দেয়া লোকটি আর কেউ নয়…

স্বয়ং স্যার অ্যালেক্স ফারগুসন
মেহেদীকে দেয়া চিঠিতে বাতলে দিয়ে ছিলেন জীবনে বড় হওয়ার তাড়না যা আজ পর্যন্ত পালন করে আসছেন মেহেদী । কি লেখেছিলেন অ্যালেক্স ফারগুসন যা পাল্টে দিলো মেহেদিকে???
লিখেছিলেন …

“Always Dream Big….and the Achievement will be Bigger”

Written By- Adnan Rahman Aurnob
Dept. of Leather Engineering

Interviwed By- Md. Khairul Bashar Shajal

সুত্র – DU TIMZ