(এক বালতি সমবেদনা যারা র‍্যাংকিং নিয়ে পড়ে আছেন)

.

 

 

চিলে কান নিয়েছে, এই শুনে চিলের পেছনে দৌড়ানোটা আমাদের অনেকের প্রিয় স্বভাব। আর সেই চিল যদি বিদেশী চিল হয়, তবে তো কথাই নেই। ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত বিদেশী চিল হলে তো সোনায় সোহাগা। সম্প্রতি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গু
লোর র্যাংকিং নিয়ে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় তোলপাড় শুরু হয়েছে, এমনকি খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছেও কৈফিয়ত তলব করা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ঐ তালিকায় অন্য কাউকে কাউকে পেছনে ফেলতে পেরে রয়েছে আত্মহারা হবার পথে। জ্ঞানগর্ভ নানা লেখা আসতে শুরু করেছে, বিশেষজ্ঞরা গবেষণা শুরু করেছেন, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার দুরবস্থা সম্পর্কে “চিন্তাশীলদের” চিন্তার আর কমতি নেই আজ।


(১)
ঘটনার শুরুতে যাওয়া যাক। স্পেনের একটি সংস্থা Consejo Superior de Investigaciones Científicas (CSIC), যা দেশটির বৃহত্তম সরকারী গবেষণা সংস্থা। এর একটি গবেষণাগার এর নাম সাইবারনেটিক্স ল্যাব। এখান থেকেই প্রতি বছর প্রকাশ করা হয় ওয়েবোমেট্রিক্স র্যাংকিং অফ ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিস। সম্প্রতি ২০১০ এর র্যাংকিং প্রকাশিত হয়েছে, আর তাতে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান এরকম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (২৯১৬), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় (৪৫৭৭), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (৫৫৩১),আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ (৫৮৮২তম স্থান), ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (৬২১০), ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (৬৩৫৯), ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (৬৮৬০), নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (৭০৭৮), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (৭১৯৬), ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (৮৭৫৯), জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় (৮৭৮৯), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (৯৪০৯), আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (১০২০৩), ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি (১০৪৭৪), নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (১০৫০৩), ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক বাংলাদেশ (১০৫১৮), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (১০৬৪৭), এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন (১০৬৬৭), ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম (১ ১০৪৩), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (১১১৪২), ঢাকা প্রকৌশলও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (১১২৩৫), খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (১১৪২২) এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় (১১৬৪৩)।
বলাই বাহুল্য, এই র্যাংকিং দেখে পত্রপত্রিকায় তুলকালাম কাণ্ড হয়ে চলেছে। ঢাবির এমন অবস্থা হবারই কথা, এরকম ইঙ্গিত গিয়ে ব্যাপারটাকে রাজনৈতিক রঙ দেয়ার চেষ্টা চলছে। আবার শিক্ষাখাতে ব্যয় বাড়ানো নিয়েও অনেকে কথা বলছেন। মানবজমিনের একটি রিপোর্টে ব্যঙ্গ করে লেখা হয়েছে,
র্যাংকিংয়ের দিক দিয়ে পাঁচ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান হয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। এমনকি বাংলাদেশের একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নিচে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান।

(২)
এই র্যাংকিং দেখে শুরুতেই খটকা লাগে, বিশ্ববিদ্যালয়ের Ranking করাটা বেশ কঠিন একটা কাজ। মার্কিন ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল গত চার বছর ধরে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের Ranking করার চেষ্টা করে এখনো তাদের রিপোর্ট বের করতে পারেনি, সেখানে CSIC কি না প্রতি বছর ১২০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং বের করে চলেছে! কৌতুহলবশত CSIC এর সাইটে গিয়ে তাদের র্যাংকিং এর কৌশল ঘাটতেই থলের বেড়াল বেরিয়ে এলো। এই র্যাংকিং আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের বিচার নয়, বরং তাদের ওয়েবসাইটের মানের বিচার!!
প্যারামিটার-
Size (S). Number of pages recovered from four engines: Google, Yahoo, Live Search and Exalead. For each engine, results are log-normalised to 1 for the highest value. Then for each domain, maximum and minimum results are excluded and every institution is assigned a rank according to the combined sum.
Visibility (V). The total number of unique external links received (inlinks) by a site can be only confidently obtained from Yahoo Search. Results are log-normalised to 1 for the highest value and then combined to generate the rank.
Rich Files (R). After evaluation of their relevance to academic and publication activities and considering the volume of the different file formats, the following were selected: Adobe Acrobat (.pdf), Adobe PostScript (.ps), Microsoft Word (.doc) and Microsoft Powerpoint (.ppt). These data were extracted using Google and merging the results for each filetype after log-normalising in the same way as described before.
Scholar (Sc). Google Scholar provides the number of papers and citations for each academic domain. These results from the Scholar database represent papers, reports and other academic items.
অর্থাৎ, চারটি প্যারামিটার হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইটে কতোটি ওয়েবপেইজ আছে, বাইরের অন্যান্য সাইট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে কতোটি লিংক এসেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইটে কতোটি পিডিএফ ফাইল রাখা আছে, আর গুগল স্কলারে বিভিন্ন একাডেমিক ডোমেইনের প্রতি কতোটি গবেষণাপত্র ও সাইটেশন পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে প্রথম তিনটিই হলো পুরোই ওয়েবসাইটের গুণাগুণ। এবার দেখা যাক, এই চারটি প্যারামিটারকে কীভাবে ফরমুলায় ব্যবহার করা হয়েছে,
Visibility (50%), size (20%), rich files (15%), scholar (15%).
অর্থাৎ, ফরমুলাতে মূল বিষয় হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইটে বাইরে থেকে কতোটি লিংক এসেছে। গবেষণার সাথে জড়িত একমাত্র প্যারামিটারটির গুরুত্ব মাত্র ১৫%।
এই ফরমুলাতে কী প্রকাশ পাচ্ছে তাহলে? এখানে প্রকাশ পাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির অনলাইন প্রেজেন্স, তথা ইন্টারনেটে উপস্থিতি কতটুকু। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট যথেষ্ট সমৃদ্ধ হলে, আর গাদায় গাদায় পিডিএফ বা ওয়ার্ড ফাইল দেয়া থাকলে, তাদের র্যাংকিং সামনের দিকে চলে আসবে এমনি এমনিই।
ওয়েবে উপস্থিতি কিংবা ওয়েবসাইটের অবস্থা মাপার এই ব্যাপারটিকে বলা হয় ওয়েবোমেট্রিক্স বা ওয়েব পরিমাপ। ফরমুলা থেকেই দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার মাপ আদৌ এই হিসাবে নেই, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার পরিমাণ অল্পই গুরুত্ব পেয়েছে। CSIC নিজেই বলছে, এই র্যাংকিং এর উদ্দেশ্য হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনলাইন উপস্থিতি বাড়ানো, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংক কম হলে যেনো তারা তাদের ওয়েবসাইটের মান বাড়ানোতে মনোযোগী হয়, সেটাতে উদ্বুদ্ধ করা, ইত্যাদি। কোনোভাবেই এটা দাবী করেনি CSIC নিজেও যে, এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদীক্ষার মানের পরিমাপ, অথবা গবেষণামূলক তৎপরতার হিসাব।
(৩)
CSIC এর র্যাংকিং এ আগে যাওয়ার উপায় কী? খুব সহজ। অল্প পয়সা খরচ করে ভালো একজন ওয়েব ডিজাইনার লাগবে, যার কাজ হবে ওয়েবসাইটে পাতার সংখ্যা বাড়ানো, আর বিভিন্ন জায়গা থেকে ওয়েবসাইটে ইন-লিংক বাড়ানো। ধরাযাক, বাদুরতলা ইউনিভার্সিটি চাইছে, চৌকিরতলা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতে র্যাংকে আগাতে। যেহেতু ফরমুলাতে মূল গুরুত্ব (৫০+২০=৭০%) এসেছে ওয়েবসাইটের লিংক এবং পাতার সংখ্যা থেকে, বাদুরতলার ওয়েবসাইট ডিজাইনারের কাজ হবে ওয়েবসাইটে পেইজের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়া, আর সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের মাধ্যমে অন্য বিভিন্ন সাইটে বাদুরতলার সাইটের লিংক যোগ করা। (উল্লেখ্য, CSIC এর ফরমুলাতে কিন্তু কোথা থেকে লিংক এসেছে, তার বিচার করা হয়না, বরং কয়টা লিংক আছে, তাই বিবেচ্য, সুতরাং ব্লগে ব্লগে বাদুরতলার সাইটের অজস্র লিংক যোগ করলে তাদের র্যাংক বাড়বে)। বাদুরতলার ওয়েব ডিজাইনারের পরের কাজটা হবে তাদের সাইটে হাবিজাবি পিডিএফ, ওয়ার্ড এসব ফাইল রাখা, বিভিন্ন পাতায় ওয়েবপেইজের মধ্যে সেগুলোর লিংক রেখে দেয়া। সেটার গুরুত্ব আবার ১৫%। সব মিলে ওয়েব ডিজাইনারের হাতে আছে ৮৫%। বাকি মাত্র ১৫% হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের গবেষণাপত্র গুগল স্কলারে কতটুকু এসেছে সেটা। কাজেই অল্প একটু খেটেই বাদুরতলা ইউনি টেক্কা দিতে পারবে চৌকিরতলা ইউনিকে।
অথচ বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়াতে এটাকে তুলে ধরা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মানের তুলনা হিসাবে। র্যাংকিং কেনো কম, এই নিয়ে ঢাবির শিক্ষকদের তলব করে কৈফিয়ত নেয়া হয়েছে, বিভিন্ন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি বিশাল গর্ব করেছে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরে আছে এই নিয়ে। কলামের পর কলাম লেখা হয়ে চলেছে এই নিয়ে। কিন্তু এতো সব লেখালেখি, এতো সব বিজ্ঞ ব্যক্তিরা, কেউই এটা কীসের র্যাংকিং, একবারও পড়ে দেখার প্রয়োজন অনুভব করেননি। কেউ খেয়ালও করেননি, এটা ওয়েবসাইটের র্যাংকিং, তা না করে সবাই বলে চলেছেন গেলো গেলো, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা রসাতলে গেলো!


(৪)
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গু
লোর র্যাংক CSIC এর ওয়েবোমেট্রিক্স র্যাংকিং এ কম কেনো, তা কিন্তু সহজেই বোঝা চলে। অধিকাংশ সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের বেশ দুরবস্থা। প্রতিনিয়ত হালনাগাদ করা হয় না, বিভাগওয়ারী ওয়েবপাতা থাকলেও তাতে অল্প কিছু তথ্য/
পাতা তৈরী করেই শেষ। অবশ্য অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইটের বয়স খুব বেশি নয়, তাই অন্য সাইট থেকে তাদের প্রতি লিংকের সংখ্যাও কম। কাজেই ওয়েবোমেট্রিক্সের ফরমুলার মোটামুটি ৮৫% এ পিছিয়ে থাকার জন্য দায়ী হলো ওয়েবসাইট নির্মাণে অদক্ষতা – মোটেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা বা গবেষণার মান এখানে দায়ী নয়।
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং খুব দরকার। কিন্তু সেটা হতে হবে একাডেমিক র্যাংকিং। ওয়েবসাইটের র্যাংকিং এর মতো ফালতু ব্যাপারকে নিয়ে মাতামাতি করার মাঝে এই একাডেমিক র্যাংকিং এর ব্যাপারটা সবার নজর এড়িয়ে যায়। আর এই একাডেমিক র্যাংকিং এর কাজটা করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বা এদের মতো নিরপেক্ষ সরকারী কোনো সংস্থাকেই। একাডেমিক প্রকাশনার সংখ্যা, গবেষণাকর্মের ইম্প্যাক্ট, ছাত্রশিক্ষক অনুপাত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা অবকাঠামো — এসব কিছু বিবেচনা করে র্যাংক করতে হবে। US News and World Report নামের সংস্থাটি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংক প্রকাশ করে পড়াশোনার মান ও গবেষণার উৎকর্ষের ভিত্তিতেই। । সেটা না করে ওয়েবসাইটের পেইজের সংখ্যার ভিত্তিতে বানানো র্যাংককে নিয়ে মাথা ঘামানোটা অত্যন্ত দুঃখজনক।
উপসংহার
চিলে কান নিয়েছে শুনে ছুটেই চলেছি আমরা, আর স্পেনীয় চিল, ইন্টারনেট থেকে জানা গেছে শুনেই মাতম শুরু করেদিয়েছি, দেশের উচ্চ শিক্ষা রসাতলে গেছে বলে রায় দিয়ে চলেছি … অথচ আসলে কীসের র্যাংকিং, তা পড়ে দেখার ইচ্ছে কারো নেই। পরের মুখে ঝোল খেতেই সবাই ব্যস্ত। আসুন, স্পেনীয় ওয়েব চিলকে তার যথার্থ স্থানে রাখি, আর দৌড়ানো থামিয়ে একটু হাত দিয়ে দেখি কানটা আছে কি না, যথার্থ মাপকাঠিতেই মেপে দেখি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে। সোনালী ডানার চিল চলে যাক ওয়েবের নির্বাসনে …

রাগীব হাসান