আশির দশকে বাংলাদেশ ব্যাঙ ও ব্যাঙের ঠ্যাং বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে। নিশ্চিতই এটা একটা অটেকসই কাজ ছিল। ব্যাঙ বাণিজ্যিক ভাবে চাষ করে বিক্রি করলে সমস্যা ছিল না। তা না করে প্রাকৃতিক ভাবে বেঁচে থাকা ব্যাঙ নির্বিচারে নিধন করে প্রাকৃতিক খাদ্যচক্রকে নিঃশেষ করা হয়েছে।

প্রাণ ও প্রকৃতি সুরাক্ষার দিকগুলোকে অবহেলার চোখে রেখে যেনতেন ভাবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিবেশ বিধ্বংসী ধারা বর্তমানেও অব্যহত রয়েছে বাংলাদেশে। উদাহরণ স্বরূপ তৈরি পোশাক শিল্পের সুবিশাল ডায়িং বর্জ্য সহ অপরিশোধিত শিল্প বর্জ্যের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

ব্যাঙের ঠ্যাং বিক্রি করে পর্যাপ্ত ব্যাঙ মারা শেষে প্রাকৃতিক খাদ্য চক্র থেকে একটি স্তর নষ্ট করা হয়েছে। মাছ চাষের বাণিজ্যিক মডেলে পানির নিন্ম মধ্য ও উচ্চ স্তরের খাদ্য চক্র ভিত্তিক প্রাকৃতিক চাষ হারিয়েছে। পাতলা পলিথিনকে জেলিফিস ভেবে খেয়ে মরেছে প্রায় শত ভাগ প্রাকৃতিক কচ্চপ।

শিল্পের পানি দুষণ ও রাসায়নিক মাছ চাষের মডেলের বহু স্তরের ক্ষতিকর প্রভাবে বহু কীট পতঙ্গ ভোজী পাখিও মারা পড়েছে। এভাবে ভিন্ন ভিন্ন কারণে প্রাকৃতিক খাদ্য চক্রে ছেদ পড়েছে। ফলে পানির উপরি ভাগে পাড়া মশার ডিম খাবার জন্য নেই মাছ, নেই ব্যাঙ, নেই কচ্ছপ, নেই পাখি। এক একটি উন্মুক্ত জলাশয় যেন মশক প্রজননের সুবিশাল আঁধার, এক একটি মশা উৎপাদনের মেশিন।

ঢাকার জলাশয় ও ঝিল (লেইক) গুলো বিচ্ছিন্ন, জলপ্রবাহ নেই। সুয়ারেজ ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল বর্জ্য মিলে লেইকের পানি আবর্জনা ও দুর্ঘন্ধময়। অপ্রবাহমান স্থীর ময়লা পানি মশক প্রজননের জন্য অতি উপযুক্ত! ঝিল গুলোর নোংরা ও বিষাক্ত পানিতে মাছ বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব। উপরি ভাগে বিভিন্ন ভাসমান ও ফেনা জাতীয় ময়লার ভারী স্তর থাকার কারনে পানির উপরি ভাগে বাস করা ছোট মাছ (যেগুলা খাবার মাছ নয়) সেগুলাও নেই। ফলে মশার ডিম খাওয়ার কেউ নেই, না ব্যাঙ, না মাছ!

ঢাকার এখনও অদখলকৃত খাল ও পুকুর গুলো ময়লার ভাগাড়, মশক প্রজননের জন্য অতি উপযুক্ত!

ঢাকায় ও বড় বড় শহর গুলোতে এখনও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ময়লা সংগ্রহ করা হয়, ডাম্পিং উন্মুক্ত যা মশক প্রজননের জন্য অতি উপযুক্ত! প্রতিটি এলাকায় আছে ময়লার স্তূপ।

বাড়ি গুলোর তিন দিক উচ্চ ওয়ালে বেষ্টিত, মাঝের ফাঁকে সুয়ারেজের লাইন, স্যাঁতসেঁতে, সংকীর্ণ ঘিঞ্জি। অল্প কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া দুই বাড়ির দেয়াল বেষ্টিত এই ফাঁকা স্থান আবর্জনার স্তূপে ঢাকা থাকে। দেয়াল বেষ্টিত এই সংকীর্ণ স্থানগুলো মশক প্রজননের জন্য অতি উপযুক্ত!

রাজধানীর রাস্তার ড্রেন যেখানে সেখানে ভাঙা ও উন্মুক্ত। সেখানে ময়লা জমে তৈরি হয় নিয়মিত জলাবদ্ধতা যা মশার প্রজনন ক্ষেত্র!
নাগরিক সুযোগ পেলেই চিপা চাপা থেকে শুরু করে যেখানে সেখানে সে কোন ধরণের ময়লা ফেলে। আমাদের হীন মানসিকতার ফলে মশারা দলে দলে পথেঘাটে ডিম ছড়াবার সুযোগ পায়। আমাদের স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পুর্ণাঙ্গ কিংবা বোধগম্য কোন ধারণা অনুপস্থিত।

অপরিকল্পিত ভবন, ছাদে জমা পড়া পরিস্কার পানি, এমনকি অপরিকল্পিত ছাদ বাগানও মশক প্রজননের জন্য দায়ী।

সুতরাং ঢাকায় দুটি সিটি কর্পোরেশন, ১০টি মশক নিধন অঞ্চল, নূন্যতম প্রায় ৬শ মশা মারা কেরানী,হস্তচালিত ও স্বয়ংক্রিয় মিলে ১৫৯৩ টি মশক নিধন মেশিন এবং প্রায় ৪৫ কোটি টাকার উপরে বাৎসরিক মশক নিধন বাজেট, সব মিলেও কেন কাজ হচ্ছে না। সহনীয় কিংবা অতি দুর্নীতি, ব্যাপক অবহেলার পরেও যেটুকু বরাদ্দ আছে তাতে কিছু কাজ হবার কথা ছিল কিন্তু সেখানেও রয়েছে লুটের থাবা। পুকুরচুরি করে আনা হয়েছে মেয়াদুত্তীর্ণ বাতিল মশার ঔষধ। এইধরনের হীনতা ও চুরির জন্য নেই কোন দায়বদ্ধতা ও শাস্তির ব্যবস্থা।

মশা নিয়ে এত আলোচনা হল, এত রোগী মারা গেল অথচ মশা মারার ঔষধই ছিটানো হল না। প্রতিরোধের অবকাঠামোতো নেই ই, নেই প্রতিকারের সাধারণ ব্যবস্থাপনাও।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণার (আইসিডিডিআরবি) সার্ভে বলেছে, মশক নিধন ঔষধ ঠিক কাজ করছে না। আমদানিকৃত মশক নিধন ঔষধ মেয়াদুত্তীর্ণ বলে প্রমাণিত হয়েছ। ধারণা করা হচ্ছে এডিস মশার নতুন জাত বের হয়েছে। ডেঙ্গুর নতুন যে সিম্পটম দেখা দিয়েছে তাতে খুব সম্ভব বাংলাদেশের সর্বসর্বা ভেজাল বিষচক্র ও সর্বময় দূষণের বিপরীতে নতুন জাতের মশক প্রজাতির বিকাশ হয়ে গেছে। ফলে এই বছরের ডেঙ্গু আসলে একটি নতুন জ্বর। পুরানো ডেঙ্গু ও চিকঙ্গুনিয়ার কোন প্রতিষেধক বের না হতেই পুরানো জীবাণুর নতুন বৈশিষ্টে বিকশিত হওয়া বেশ ভয়ংকর স্বাস্থ্য ঝুঁকির বার্তা দিয়ে যাচ্ছে।

ফলে মশাবাহিত রোগের এমন মহামারি শুরু হয়েছে। এত মশা আগে কেউ কখনও দেখেনি! ১৬ই আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার রোগী দেশের হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিয়েছেন এবং বেসরকারি হিসাবে মারা গিয়েছেন সংখ্যা ১১০ জনেরও বেশি। [আপডেট- ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত সারাদেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৭২৭৪৫ জন।] বাচ্চাদের পড়া শুনা, ঘুমানো থেকে শুরু করে ঘরে বাইরের সব কিছু যন্ত্রণাময় হয়ে উঠেছে! ডেঙ্গু, চিকুঙ্গুনিয়া সহ মশা বাহিত রোগে নগরজীবন ও জনস্বাস্থ্য বিপর্যস্ত, হাসপাতাল গুলোতে ডেঙ্গু রোগীর মিছিল, মেঝেতেও ঠাই হচ্ছে না রোগীর।

সরকারের সাময়িক তৎপরতায় ডেঙ্গু পরীক্ষার খরচ অর্ধেকে নেমেছে কিন্তু ঔষধ না ছিটিয়ে, মশক প্রজনন থামানোর কাজ না করে এবং মশক প্রজনন প্রতিরোধী অবকাঠামো অনুসন্ধান করে সমন্বিতভাবে রোগ প্রতিরোধ না করে এমন লোকদেখানো প্রতিকারে কি কোন লাভ হবে?

রাজধানীর নিন্মবিত্ত ও মধ্যবিত্ত এলাকা গুলোর প্রায় স্থায়ী জলাবদ্ধা, ড্রেন বদ্ধতা, বৃষ্টি জনিত জলাবদ্ধতা, নির্মাণ ধীরতা জনিত জলাবদ্ধতা, বাসা বাড়ি তৈরির অদুরদর্শী মডেল, প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষার সাথে সংযোগহীন শিল্প ও অবকাঠামো উন্নয়ন এবং একেবারেই হীনমান্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অভিশাপ হয়ে আছে আমাদের নগর স্বাস্থ্যে।

ঢাকার জলাশয় ও ঝিল (লেইক) গুলো পরস্পর সংযুক্ত করে লেইকের পানিতে মধ্যমানের কৃত্তিম স্রোত তৈরির সুযোগ আছে। ঢাকার পরিকল্পনাহীনতার মধ্যে দাঁড়িয়ে এরকম একটা মডেল নিয়ে কিছু প্রাথমিক কাজ করে বুঝতে পেরেছি এখানে ভূগর্ভস্ত সংযোগের দরকার হতে পারে। কিছুটা জটিল হলেও নেদারল্যান্ডের ডেনবোশ শহরে এমন মডেল ইতিমধ্যেই বাস্তবায়িত হয়েছে।

এতে করে জলধারণ, ভূগর্ভে পানি ফিল্ট্রেশন, নগর পর্যটন সহ অন্যান্য সুবিধার বাইরেও আন্তঃ সংযুক্ত লেইকের স্থানে স্থানে ফিল্টার দিয়ে মশক ও ডিম নষ্ট করা সহজ হবে যাবে। এর বাইরেও রাজধানীর ভূমিতে পানির ফিল্টারিং বাড়াতে ও নগরে জলাধার বাড়াতে লেইক গুলোকে সংযুক্ত করা খুব দরকার।

রাজধানীর বাড়ি গুলোর মডেল পরিবর্তন করে এমন করা যায় যেখানে নিচ তলা বাধ্যতামূলক ভাবে উন্মুক্ত থাকবে। একটি ব্লকের সব গুলো বাড়ির নিচতলা প্রাচীরবিহীন করে বিশাল যায়গা উন্মুক্ত করা হবে পার্কিং, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার স্থান সহ বাচ্চাদের খেলার যায়গা তৈরির জন্য। মাটির নিচে সমন্বিত বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ স্টোরেইজ কিংবা সমন্বিত সুয়ারেজ পানি পরিশোধন প্ল্যান্ট করা যাবে যাতে করে টয়লেট ফ্ল্যাশে ওয়াসার ভালো পানির পরিবর্তে রিসাইকেল্ড পানি পুনঃ পুনঃ ব্যবহার করা যায়।

ভবিষ্যতে নগরকে বাসযোগ্য করতে এগুলা লাগবে। স্থাপনা না ভেঙ্গেও শুধু পরিকল্পনা মাফিক দেয়াল ভেঙ্গে এসব করা যায়। বর্তমানে শুধু দেয়ালের কারণে মশার ঔষধ সব যায়গায় পৌঁছে না, দেয়াল গুলোর মাঝের যায়গা মশক প্রজনন কেন্দ্র।

মশা নিধনের জন্য যে স্প্রে করা হয়, তাতে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির রাসায়নিক উপাদান আছে, এমনকি কয়েলেও ক্ষতিকারক উপাদান আছে। মশার লার্ভা ধ্বংস করার ঔষধ বানিয়েছেন একজন দেশীয় বিশেষজ্ঞ, এইসব দেশীয় উদ্ভাবনকে খুব গুরুত্ব দেয়া দরকার। ডাক্তার, রাসায়নিক বিশেষজ্ঞ নিয়ে কাজ করে টেকসই পরিবেশ জনবান্ধব বর্জ্য ও ড্রেনেইজ ব্যবস্থাপনা টেকসই করা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে।

বাসাবাড়ি দোকান ও অফিস থেকে নির্বিচারে ময়লা নিয়ে উন্মুক্ত ভাবে তা ব্যবস্থা করার পরিবর্তে পচনশীল, অপচনশীল, কাগজ, প্লাস্টিক, রাসায়নিক বর্জ্য উৎসেই কিভাবে আলাদা করা যায় এবং আলাদা আলাদা করেই প্রক্রিয়াজাত করা যায় তা নিয়ে নগর প্রশাসনকে এখনই উদ্যোগী হতে হবে। দরকার সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে পরিমানমত মেয়াদযুক্ত সঠিক ঔষধ ছিটানোর ব্যবস্থাও।

তথাপি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা ও স্থির পানির লেইক ব্যবস্থাপনা বোধগম্য পর্যায়ে উন্নত না হলে, মশা বাহিত রোগ প্রতিরোধে আশু কোন সমাধান নাই!

১৬ আগস্ট ২০১৯ এর লেখা, (অপরিবর্তিত)