বাংলাদেশের প্রাচীন চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি সংক্রান্ত বৈষম্য নিরসন:
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই চারটি ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়। তবে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তির ক্ষেত্রে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম ও প্রক্রিয়া অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় জটিল এবং বৈষম্যমূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে শিক্ষার্থী এবং গবেষণা ক্ষেত্র উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ সমস্যা নিরসনের জন্য ইউজিসি-কে একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
বর্তমান সমস্যাগুলো:
১. চাকরির অভিজ্ঞতা ও এমফিলের শর্ত:
– এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তির জন্য ৪-৭ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা বা সরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ফেলোশিপ প্রাপ্তির শর্ত রয়েছে। অন্যথায় এমফিল করতে হয় এবং এমফিল থেকে পিএইচডি-তে রূপান্তর করতে হয়।
– অথচ অন্যান্য পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই শর্ত নেই। শিক্ষার্থীরা সরাসরি পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হতে পারে।
২. সমমানের ডিগ্রিধারীদের ক্ষেত্রে বৈষম্য:
– একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন এমফিল করার বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হচ্ছে, যেখানে অন্যরা সরাসরি পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে।
৩. পুরনো প্রথার অযৌক্তিকতা:
– এমফিল প্রোগ্রাম, যা ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার ধারাবাহিকতা, এখনও অব্যাহত আছে, যদিও বর্তমান অনার্স-মাস্টার্স প্রোগ্রামের কাঠামো এবং গবেষণার মান আগের তুলনায় অনেক উন্নত।
– বর্তমানে ৪ বছরের অনার্স ও ১.৫ বছরের থিসিস-সমৃদ্ধ মাস্টার্স প্রোগ্রাম এমফিলের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দেয়।
4. এসএসসি/এইচএসসি ফলাফলের অযৌক্তিক গুরুত্ব:
– পিএইচডি বা এমফিল প্রোগ্রামে ভর্তির যোগ্যতার ক্ষেত্রে এসএসসি/এইচএসসি গ্রেডের শর্ত আরোপ অপ্রাসঙ্গিক। গবেষণার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর পূর্ববর্তী প্রকাশনা, গবেষণার অভিজ্ঞতা, এবং দক্ষতাই প্রাধান্য পায়।
5. অর্থনৈতিক বৈষম্য:
– এমফিল প্রোগ্রামে ফেলোরা তুলনামূলকভাবে কম আর্থিক সহায়তা পান, অথচ তাদেরও গবেষণার জন্য সময় এবং সম্পদ প্রয়োজন।
প্রস্তাবিত সমাধান:
১. একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন:
– ইউজিসি একটি আইন বা নীতিমালা তৈরি করে, যেখানে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামের ভর্তি প্রক্রিয়া একীভূত করা হবে।
– চাকরির অভিজ্ঞতা বা এমফিলের বাধ্যবাধকতা বাদ দেওয়া উচিত। সরাসরি পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হতে শিক্ষার্থীর মাস্টার্স থিসিস এবং সংশ্লিষ্ট গবেষণার মান যথেষ্ট হওয়া উচিত।
২. গবেষণার যোগ্যতা নির্ধারণের আধুনিক পদ্ধতি:
– পিএইচডি প্রোগ্রামের ভর্তির ক্ষেত্রে এসএসসি/এইচএসসি ফলাফল বাদ দিয়ে প্রার্থীর গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতা, গবেষণাপত্রের সংখ্যা ও মান (impact factor) বিবেচনা করা উচিত।
– প্রকাশনার মান যাচাই করতে আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্র, কনফারেন্সে উপস্থাপন এবং রেফারেন্স উল্লেখ করা যেতে পারে। বাকৃবির সম্প্রতি (সুপারিশকৃত) আইন /নিয়মাবলী অনুসুরণ করা যেতে পারে।
৩. পিএইচডি ও এমফিল প্রোগ্রামের শর্ত সহজীকরণ:
– পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তির জন্য এমফিল বাধ্যতামূলক না রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা।
– বর্তমান অনার্স ও মাস্টার্স প্রোগ্রামের থিসিস সমন্বিত কাঠামোর ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের পিএইচডি প্রোগ্রামে প্রবেশাধিকার দেওয়া।
৪. আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধি:
– পিএইচডি ও এমফিল শিক্ষার্থীদের জন্য মাসিক স্কলারশিপের পরিমাণ পুনঃনির্ধারণ করে সমতা আনা।
– পিএইচডি শিক্ষার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে অংশগ্রহণ, ল্যাবরেটরি গবেষণার সরঞ্জাম এবং প্রকাশনার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রতি করা (সুপারিশকৃত) আইন বা নিয়মাবলী অনুসরণ করা
৫. ইউজিসি পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন: ব্যবস্থা**
– ইউজিসি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ও এমফিল প্রোগ্রামের নিয়ম এবং কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করবে।
– নিয়মিতভাবে গবেষণার মান উন্নয়ন এবং বৈষম্য দূর করার জন্য প্রতিবেদন প্রদান করবে।
৬. সংশ্লিষ্ট নীতিমালার আধুনিকায়ন:
– ব্রিটিশ আমলে চালু হওয়া এমফিল ধারণা পর্যালোচনা করা এবং বর্তমান গবেষণার চাহিদা অনুযায়ী পিএইচডি প্রোগ্রাম ঢেলে সাজানো।
৭. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি:
– ঐতিহ্যবাহী এবং নতুন প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে গবেষণার সুযোগ এবং সুবিধার সমতা আনা।
উপসংহার:
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা খাতে পিএইচডি এবং এমফিল প্রোগ্রামে বৈষম্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা, যা শিক্ষার্থীদের গবেষণায় আগ্রহ হ্রাস করছে। ইউজিসি-র নেতৃত্বে একটি সমন্বিত এবং বৈষম্যহীন নীতিমালা প্রণয়ন করে এই সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। এতে গবেষণার গুণগত মান উন্নয়ন হবে এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের গবেষণার অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে।
– মোহাম্মদ ইয়ামিন হোসেন
অধ্যাপক, ফিশারিজ বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়