গতকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের আন্ডারগ্রাজুয়েটের চতুর্থ বর্ষের ফলাফল নিয়ে নানাজনের মতামতে আমার নিউজ ফিড সয়লাব।

ফলাফলের পরিসংখ্যান নিয়ে যারা লিখেছে তাদের অধিকাংশই হয় বর্তমান অথবা শিক্ষার্থী।

পরিসংখ্যানটা কি? দুইদিন আগে চতুর্থ বর্ষের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এইটা কিন্তু গোটা অনার্স ৪ বছরের cumulative ফলাফল না।

চতুর্থ বর্ষে পরীক্ষা দিয়েছে ১২৯ জন এবং তার মধ্যে পাশ করেছে ৩৭ জন। তাই শতাংশের হিসাবে ২৮.৬৮% জন।

চতুর্থ বর্ষের ফলাফল

চতুর্থ বর্ষের ফলাফল

মোটা দাগে এই ফলাফল দেখলে যেকোন মানুষের মনে হবে ও মাই গড এবং প্রথম তীরটা তেড়ে আসবে বিভাগ তথা শিক্ষকদের উপর। এইবার আসুন এই ফলাফলের একটু ওপেন হার্ট সার্জারি করি।

প্রথমেই বলে রাখি যে এটি একটি disastrous ফলাফল। এই ফলাফলের জন্য বিভাগ, বিভাগের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, প্রশাসন, সরকার সবাই দায়ী।

কে কতটা দায়ী তার উত্তর নিচে খোঁজার চেষ্টা করব। কিন্তু মুদ্দা কথা হলো সবাই মিলে আমরা শিক্ষার যে পরিবেশ সৃষ্টি করেছি তাতে গোটা সিস্টেমই দায়ী।

দ্বিতীয়ত এই ফলাফল একটি খণ্ডিত চিত্র। ১২৯ জন যারা পরীক্ষা দিয়েছে তাদের অধিকাংশেরই প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের কোন এক বা একাধিক বিষয়ের রেজাল্ট বাকি।

দেখা গেছে মোট ১৩১ জনের মধ্যে ২ জন পরীক্ষা ক্যান্সেল করেছে, ৩৭জন পাস করেছে, ১৪ জন ফেল করেছে এবং ৭৮ জনের কারো না কারো প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের কোন এক বা একাধিক বিষয়ের রেজাল্ট ইনকমপ্লিট আছে।

এই ৭৮ জনের অধিকাংশেরই ৩য় বর্ষের ১/২ টি কোর্সের রেজাল্ট বাকী, কারও ২য় বর্ষের, আবার কারও কারও প্রথম বর্ষের রেজাল্টও বাকি থাকতে পারে!

কিন্তু এই ৭৮ জন ওই পরীক্ষাগুলো দিলে পাস করবেই। একবার ফেল করলে স্পেশাল দিবে। স্পেশাল দিয়ে ফেল করলে স্পেশালের স্পেশাল দিবে।

কিন্তু ভর্তি যখন বিশ্ববিদ্যালয় করেছে শিক্ষার্থীকে পাশ করানোর দায় যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের।

প্রশ্ন হলো প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষের সব বিষয়ে পাশ না করে চতুর্থ বর্ষে পরীক্ষা দিতে পারল কিভাবে। চতুর্থবর্ষের ফলাফলের ফাঁকিটা এইখানে।

উচিত হলো প্রথম বর্ষের সব বিষয়ে পাশ না করলে দ্বিতীয় বর্ষে উঠতে না দেওয়া, দ্বিতীয় বর্ষের সব পাশ না করলে তৃতীয় বর্ষের এবং তৃতীয় বর্ষের সব পাশ না করলে চতুর্থ বর্ষে পরীক্ষা দিতে না দিলে আজকে এই অনাকাঙ্খিত অবস্থায় পড়তে হতো না।

এইবার আসুন সমস্যার আরো গভীরে যাই। আসলে সমস্যাটা একদিনে তৈরী হয়নি। দিনে দিনে সমস্যা বাড়তে বাড়তে আজকে যেই অবস্থায় এসেছি এইটাকে বলা যায় হযবরল অবস্থা।

সমস্যার কেন্দ্র বিন্দু হলো প্রথম বর্ষ। আমাদের শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে তুমুল প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে নিজেকে যোগ্য প্রমান করে বিশাল স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রথম ধাক্কাটা খায় আবাসিক হলগুলোতে। সারা পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের আবাসিক সিট বরাদ্দের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়।

আর আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় এর উল্টা। যত বেশি সিনিয়র তত বেশি প্রায়োরিটি। সারা পৃথিবীতে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের আবাসিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয় কারণ এরাই সবচেয়ে vulnerable!

এই vulnerable অবস্থায় থাকা শিক্ষার্থীদের যতটা মায়ামমতা দিয়ে তাদের দেখভাল করার কথা আমরা করি তার উল্টো।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই একটি সিটের জন্য এরা মারাত্মক টর্চারের শিকার হতে হয়।

মারাত্মক সিট ক্রাইসিসকে পুঁজি করে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো (বিশেষ করে যে যখন ক্ষমতায় থাকে সেই দল) তাদের কর্মী সংগ্রহে নামে।

হলে একটা সিট দেওয়ার আশ্বাসে তারা তাদের মিছিল মিটিং ইত্যাদিতে যেতে বাধ্য করে। নেতারা গেস্ট রুমে manner শেখানোর নামে টর্চার করে।

প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীরা পড়ার জন্য ন্যূনতম সুযোগ যেমন একটি টেবিল এবং ঘুমানোর একটি বিছানা তারা পায় না।

তাই আমাদের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ প্রথম বর্ষের পরীক্ষাতেই খারাপ করে ফেলে। এটাকেই বলা যায় শিক্ষার্থীদের dooms year!

এখানেই তাদের মাজা এমনভাবে ভেঙে দেওয়া হয় যেন শুধু পরীক্ষায় খারাপ করে তা না, তাদের শিরদাঁড়া ভেঙে তাদের ব্যক্তিত্বকেও ধ্বংস করে দেওয়া হয়। তারা আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

By the way, কারো কারো ক্ষেত্রে প্রথমবর্ষে খারাপ করার আরেকটি কারণ হলো তাদের আর্থিক অস্বচ্ছলতা। তারা অনেকেই প্রাইভেট টিউটর হিসাবে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের বাসায় গিয়ে পড়ায়।

ঢাকা শহরে জ্যাম জটের কথা ভাবলে একাধিক জায়গায় পড়ালে সেই ছাত্রের আর কোন এনার্জি থাকে না নিজের পড়া পড়ার। অনেকে আবার কোচিং সেন্টারেও পড়ে।

এরমধ্যে প্রথমবর্ষে কোন কোন বিষয়ে ফেল করলেও শিক্ষার্থীদের অনুরোধে, ছাত্রনেতা ও প্রশাসনের চাপে এদের দ্বিতীয় বর্ষে উঠতে হয়।

দ্বিতীয়বর্ষে পড়াকালীন সময়ের কোন এক সময় তারা প্রথববর্ষে ফেল করা বিষয়ে পরীক্ষা দেয়। দ্বিতীয়বর্ষে থেকে প্রথমবর্ষের পরীক্ষা দিতে গিয়ে দ্বিতীয়বর্ষের বিষয়গুলোতে পুরোপুরি মন দিতে পারে না।

ফলে দ্বিতীয়বর্ষেরও কয়েকটি বিষয়ে ফেল করে। এই পর্যায়ে কিংবা প্রথমবর্ষের পরই এক বা একাধিক বিষয়ে ফেল করা শিক্ষার্থীদের ধারণা জন্মায় তারা আর ভালো সিজিপিএ পাবে না অর্থাৎ পদার্থবিজ্ঞানে ভালো করবে না।

তখন থেকে তারা আসলে পদার্থবিজ্ঞান থেকে ছিটকে যায়। আর প্রতিটি বর্ষে রেজাল্ট ইনকমপ্লিট রেখে পরের বর্ষে উন্নীত হয়ে সমস্যা আরো ঘনীভূত হয়।

আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন প্রথমবর্ষের সব বিষয় ক্লিয়ার না করলে দ্বিতীয়বর্ষে উঠা গেলেও তৃতীয় বর্ষে উঠা যেত না। আর পুরো আন্ডার গ্রাজুয়েটে কতবার এবং কয়টি বিষয়ে ইম্প্রোভমেন্ট দেওয়া যাবে সেটাও নির্দিষ্ট ছিল।

শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যার কথা বিবেচনা করে ধীরে ধীরে নিয়মগুলো শিথিল করা হতে থাকে। আর এখন একবার ইমপ্রুভমেন্ট দিয়ে পাশ করতে না পারলে নিজস্ব অর্থে পরীক্ষা দিতে পারে।

নিয়মমাফিক একজন শিক্ষার্থী যতবার পরীক্ষা দিতে পারবে তার বেশি হলে শিক্ষক এবং প্রশাসনের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হয়।

এইখানে যদি একটা লিমিট না রাখা হয় শিক্ষকদের সারা বছর ধরে এইসব বিশেষ এবং বিশেষের বিশেষ পরীক্ষা নিতে থাকতে হয়।

তাতে শিক্ষকরা শ্রেণীকক্ষের পড়া এবং গবেষণায় মনোনিবেশ করতে পারেনা।

নিয়ম মানেইতো একজায়গায় থামতে হবে। রাজনীতির কারণে প্রশাসন নিয়মকে ঢিলা দিতে দিতে গোটা পরীক্ষা সিস্টেমকে একটা mockery-তে রূপান্তর করেছে।

তাছাড়া শিক্ষকদের গাফিলতিতো আছেই। আমাদের শিক্ষকদের কত শতাংশ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহিরে এক বা একাধিক চাকুরী করে? শুধু তাই না।

ঢাকার ৭টি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আসার পর থেকে শিক্ষকরা এখন আজকে এই কলেজের পরীক্ষাতো কালকে ওই কলেজের পরীক্ষা নিতে কলেজগুলোতে দৌড়ায়।

যেদিন কোন একটি কলেজে যেতে হয় সেইদিন আর তাকে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়কে সময় দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়।

শিক্ষকরা কেন এক বা একাধিক পার্ট টাইম পড়ায় তার উত্তর আশা করি সবাই জানে আর আমি নিজেও অনেকবার লিখেছি এই বিষয়ে।

এছাড়া আছে মান্ধাতা আমলের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন সিস্টেম, উত্তরপত্র মূল্যায়ন সিস্টেম। অর্থাৎ এইসব নিয়ম ১০০ বছর আগে যেমন ছিল আজকে ১০০ বছর পর ২০২২ সালে এসেও তেমনি।

একটি সিস্টেম যদি সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ভালোর দিকে পরিবর্তিত না হয় সেই সিস্টেম পঁচতে বাধ্য। পৃথিবীর কোন ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে এক্সটার্নাল এক্সামিনার সিস্টেম আছে?

উত্তরপত্রকে কোর্স শিক্ষকের বাহিরেও অন্য আরেকজন শিক্ষক দ্বারা মূল্যায়ন করা হয়। এতে শিক্ষকদের সময়ের অপচয় হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থের অপচয় হয় আর এর কারণে যেই সেশন জ্যাম হয় তাতে শিক্ষার্থীদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অপচয় হয়।

অথচ এই বিশাল জঞ্জাল নিয়ে কথা না বলে খণ্ডিত একটি চিত্র নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করা কি ঠিক?

আমাদের কি করা উচিত? আমরা যদি প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীদের একটি সুন্দর আবাসিক পরিবেশ দিতে পারি, অস্বচ্ছল পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপ দিতে পারি এবং নিয়ম করি পরবর্তী বর্ষে স্কলারশিপ পাওয়া নির্ভর করবে প্রথম বর্ষের রেজাল্টের উপর তাহলেই পড়াশুনার একটা বিশাল পরিবর্তন আসবে।

তাছাড়া আমরা যদি প্রথমবর্ষে অভিজ্ঞ এবং বিভাগের ভালো শিক্ষকদের প্রথমবর্ষে পড়াতে দেই তাহলেও একটা পরিবর্তন আসবে। এখন সমস্যা হলো বিভাগের কাউকে ভালো শিক্ষক বলা যাবে না বা আমরা ভালো শিক্ষক মাপার কোন ব্যবস্থাও রাখিনি।

ছাত্ররা যদি শিক্ষকদের মূল্যায়নের সুযোগ পেত সেই ভিত্তিতে আমরা ভালো শিক্ষক বলতে পারতাম। সারা পৃথিবীতে প্রতিবছর একজন শিক্ষককে সেরা শিক্ষক হিসাবে ঘোষণা করে। কিন্তু আমরা এমন কোন সিস্টেম চালু করতে পারিনি।